রম্য রচনায় সৈকত ঘোষ

বাইসাইকেল

ছড়ু খুব ভালো ছেলে, আমাদের পাড়ায় থাকে। এত জঘন্য ডাকনাম কোন বাবা মা দেয় না, এটাও পাড়ার লোকেরাই দিয়েছে। ছোড়ুর অদ্ভুত ক্ষমতা আছে জীবনের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোলমাল করে ফেলার। ছড়িয়ে ফেলে, তাই ও ছড়ু। তো সেই ছড়ু অনেক দিন ধরে এক গার্লস স্কুলের সামনে, যাকে বলে বডি ফেলে রেখে, অবশেষে পছন্দের গার্লকে খানিকটা বাগে আনতে পেরেছে। প্রথম ক’দিন পাশাপাশি হাঁটা, ডানদিকে ফেউ এর মতো থাকত ওর সেই সাইকেলটা, অনেককালের পুরনো, ঠিক পৈত্রিক নয়, তবে পৈতেতে মামা দিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল একটু আত্মবিশ্বাস বাড়লে আর হাত পা কাঁপা বন্ধ হলে নেক্সট স্টেজে বান্ধবীকে সামনে বসিয়ে সাইকেলে করে ঘুরতে বেরবে। এমন একদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সবে বান্ধবী কে বলেছে, আমি তোমাকে ঘচাং, শেষ শব্দ টা বেচারার প্রোপোজাল স্কিমের মধ্যে ছিল না, ওটা সাইকেলের চেন পড়ে যাবার শব্দ। বান্ধবী কে নামানো, নিজে নামা, চেন লাগানো, চলতে শুরু করা, আবার আবেগপ্রবণ ভাবে প্রোপোজ, এবং কী আর বলি, আবার ঘচাং, আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কয়েকবার এমন হবার পর, ইতিহাস যখন পাটিগণিত এর রেকারিং ডেসিমাল হয়ে ফিরে ফিরে আসছে, হতভাগ্য ছড়ু সাইকেল এর চেন তুলে দেখে ভাবী প্রেমিকা এই চেন পড়ার চেন রিএকশনে বিরক্ত হয়ে পাশের অটোরিকশা তে উঠে পড়েছে, চেনেই না এমন মুখ করে।
ছড়ুর কথা আলাদা। নাহলে ও আর ছড়ু হবে কেন। এমনিতে সাইকেল বড় চমৎকার জিনিস। সাইকেল কে আবিষ্কার করেছিলেন ভুলে গেছি, কিন্তু উনি আমার কাছে খুব সম্ভ্রমের। দুটো চাকাকে লম্বালম্বি জুড়ে দেওয়া একটা অদ্ভুত যান, যে নিজে ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারে না, অথচ চলতে শুরু করলে কেমন স্বাবলম্বী হয়ে যায়, এটা বেশ রোমাঞ্চকর লাগে। এমন অদ্ভুতুড়ে কিছু যে হতে পারে এটা ওনার মাথায় এলো কী করে, সেটা আবার আমার মোটা মাথায় ঢোকে না।
সে যাইহোক, বাঙালি র জীবনে সাইকেল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবন শুরু হয় ট্রাইসাইকেল দিয়ে। তারপর একটু তালেবর হলেই বাইসাইকেল। ইস্কুল জীবনে সাইকেল চালানো শেখেনি এমন মানুষ দুর্লভ।
আসলে সেই বয়সে ছেলেদের কাছে সাইকেল টাই ছিল পৌরুষত্ব দেখানোর স্ট্যান্ডার্ড। বাইসেপস যতই ট্যালট্যাল করুক না কেন একটা বাইসাইকেল দিয়ে সেসব ডেফিসিয়েন্সি ঢেকে যেত। সেই উদীয়মান বয়সে, যখন ছুটির পর বাড়ি যাবার রাস্তা বিস্তর ঘুরে এলাকার সব গার্লস স্কুল ছুঁয়ে যেত, তখন সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে যে পরিমাণ পার্সোনালিটির আমদানি হত, তার পাশে মার্সিডিজ এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো স্ট্যালোন কেও শিশু লাগত।
আন্তপাড়া প্রেমেও সাইকেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। পাড়ার দাদা সারথি কৃষ্ণের ভূমিকায়, রথ বাইসাইকেল। ফুরফুরে বিকেলে পাশের পাড়ার রাধিকার সাথে অভিসারে পাশে ল্যাংবোট হয়ে চলতে থাকে সাইকেল। প্রেমে গতি এলে সাইকেল ও গতিশীল হয়, রাধা কৃষ্ণ তখন রথে চড়ে বসে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
সাইকেল বোধহয় একমাত্র যান, যার স্ত্রী পুরুষ ভেদ আছে। এবং যে ক্রাইটেরিয়া তে এর স্ত্রী পুরুষ ভাগ করা হয়, সেটা বেশ বৈজ্ঞানিক এবং বায়োলজিক্যাল ও বটে!
কিন্তু শাড়ী পরিহিতা দের জন্য না হয় লেডিজ সাইকেল, তাহলে যারা লুঙ্গি বা ধুতি পরেন তারাও তো এটা ইউজ করতে পারেন। সমস্যা হল তাদের কেউ বারণ করে নি, কিন্তু আমাদের সিস্টেমে চালু প্রথা অনুযায়ী ছেলেরা লেডিজ সাইকেলে চাপলে হাসির খোরাক হয়, যদিও উল্টোটায় না। যেমন মহিলারা শার্ট পরতে পারেন, পুরুষ রা ফ্রক না। এই নারীতান্ত্রিক পটভূমিতে সেইসব হতভাগ্য পুরুষকে হয় রিস্ক নিয়ে সামনের দিক দিয়ে উঠতে হয়, নয় অশ্লীল ভাবে পিছন দিকে লুঙ্গিসহ পা তুলে।
সাইকেলে ওঠাটাও বেশ দেখার মতো জিনিস। প্রথমে প্যাডেলে পা দিয়ে কবার লাফিয়ে নিয়ে তারপর পুরোপুরি উঠে পড়া। আমাদের যিনি খবরের কাগজ দেন তিনি লাফাতে লাফাতেই আবার একবাড়ি থেকে পরের বাড়ি পৌছে যান, পুরো ওঠার দরকার হয় না। ইন ফ্যাক্ট আমরা ওনাকে কখনও ডিসেন্ট ভাবে সাইকেল চালাতে দেখিনি, এটাই ওনার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে কিনা কে জানে। যারা লম্বা বা যাদের হাল ফ্যাশনের স্টাইলিস্ট সাইকেল তাদের এই কসরতের দরকার পড়ে না, কিন্তু ছোটখাটো মানুষদের এই লাফিয়ে ওঠা জানতেই হয়।
আমাদের পাড়ার বীরুদা খুব দাপুটে তখন, একদিন দেখি সাইকেল নিয়ে হেঁটে আসছে। কৌতুহলী হয়ে বললাম, খারাপ হয়ে গেছে? এদিক সেদিক দেখে বলল না রে, উঠতে পারছি না, আমি আবার একটু উঁচু জায়গা না পেলে উঠতে পারি না।
ক্যারিয়ারে একটা টুল বেঁধে রাখতে পারো তো।
বীরুদা রাগল না, অমায়িক হাসি হেসে বলল একটু হেল্প করবি?
কী আর করি, দাদুরা যেমন উবু হয়ে নাতিকে পিঠে চাপিয়ে হাতিঘোড়া খেলে আমিও তেমন করতে যাচ্ছিলাম। বীরুদা ভীষণ লজ্জিত হয়ে বলল, ছি ছি, করিস কী, সাইকেল টা শক্ত করে ধর তাহলেই হবে। আমার পিঠ আর পাড়ায় বীরুদার সম্মান দুটোই বেঁচেছিল সে যাত্রা।
সাইকেল চালানোর মত চালাতে শেখানোও একটা মস্ত বড় আর্ট। এটা এমন একটা কাজ, ট্রেনি র থেকে ট্রেনারকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। অন্য সব খেলায় ট্রেনি পরিশ্রম করে মরে, ট্রেনার চেয়ারে বসে পিক পিক বাঁশি বাজায় আর হেলথ ড্রিঙ্ক খায়। আর এখানে? ট্রেনি সাইকেলে দিব্যি বসে থাকে, সাইকেল ঠেলা আর তার সাথে ঠায় জিভ বার করে দৌড়ানো ট্রেনারের কাজ। সাইকেল শিখতে গিয়ে আছাড় খায় নি, হাত পা ছড়ে যায়নি, দুএকজন নিরীহ মানুষের ঘাড়ে গিয়ে পড়েনি, নালা নর্দমায় সেঁধিয়ে দেয়নি, এমন সজ্জন সাইক্লিস্ট খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, সম্ভবত নেই। সাইকেল শিক্ষার্থীর বোধিলাভ হত সেদিন, যেদিন গুরুদেব প্রাণপাত করা দৌড় থামিয়ে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যেত আর শিষ্য টলমল করে এঁকেবেঁকে সাইকেল চেপে এগিয়ে যেত। অবশ্য সেটা খেয়াল করলেই দড়াম করে বরাদ্দ আছাড়খানা খেয়ে নিয়ে গুরুদক্ষিণা দিত।
এই ট্রেনারের থেকে সাইকেল চালাতে শিখে যাবার মুহূর্ত হাইলি সিম্বলিক। অনেক সিনেমাতে এই সব সিন থাকে, নায়ক বালখিল্য দশা থেকে বড় হয়ে গেছে বোঝাতে।
এক বন্ধুকে দেখেছিলাম সাইকেলে রিক্সার ভেঁপু লাগিয়েছে। অকাট্য যুক্তি ছিল পিছন থেকে এটা প্যাঁকপ্যাঁক করে বাজালে রিক্সা ভেবে জনগণ অনেকটা সরে দাঁড়ায়, ভীড়ে চালাতে সুবিধে হয়। সাইকেল চাপা দুধওয়ালাদের ও দেখেছি এই পলিসি নিতে।
আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম, এখন আর দেখি না, টানা তিনদিন সাইকেল এ থাকার খেলা। খুব অবাক হয়ে যেতাম, ভাবতাম টানা বাহাত্তর ঘন্টা সাইকেল এ থাকবে, বাপরে বাপ, কী স্ট্যামিনা। নকুলদা ছিল, কোন কিছুতেই অবাক হতো না আর সবাইকে বলত প্র‍্যাকটিকাল ভাবনা ভাবতে, তো এখানে স্কিল স্ট্যামিনা ছেড়ে নকুলদার প্র‍্যাকটিকাল ভাবনা ছিল তিনদিন হিসু কিভাবে করবে, পটি কিভাবে করবে।
পাড়ার স্পোর্টস এ সাইকেল রেস কম্পালসারি ছিল। কে কত আস্তে চালাতে পারে। ব্রেক লুজ করে দেওয়া হতো। সে হেব্বি মজার ছিল। ফার্স্ট এ গেলে লাস্ট আর লাস্ট এ গেলে ফার্স্ট। যারা সারাদিন রাস্তায় প্রবলবেগে ফাঁইফাঁই করে ঘুরে বেড়ায় তারা কে কত আস্তে চালাতে পারে, ব্রেক চাপতে না পেরে দাঁত চেপে ধরছে, শেষে আর না পেরে পাশের জনের ঘাড়ে, দুজনেই পপাত চ মমার চ।
মাতাল আর সাইকেল এর কোনদিন সদ্ভাব নেই। সাইকেল এমনিতেই টলোমলো প্রকৃতির, এরপর আরোহীও টলোমলো হয়ে পড়লে সেটা খুবই বাজে এবং বিপজ্জনক কম্বিনেশন হয়। সেজন্য যারা হিসেবী মাতাল, এইসব নিয়ে যারা ওয়াকিবহাল, কক্ষনো সাইকেল নিয়ে শুঁড়িখানার প্রোগ্রাম করে না। একবার এক মাতালকে দেখেছিলাম হন্যে হয়ে সাইকেলের চেন খুঁজতে, যুক্তি ছিল সেটা না জেনে কীভাবে সাইকেল চালানো সম্ভব। আর একজন, এটা শোনা গল্প, সারা রাস্তা সাইকেল উল্টোদিকে ঠেলে নিয়ে আসছিলেন। এরা তবু ঠিক আছে, কিন্তু যারা নিজেরাই বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা নিশ্চিত থাকেন না তাদের আবার সাইকেল।
মোটর বাইক থেকে ফাইটার প্লেন, এতসব মারকাটারি স্মার্ট যানের দাপটেও সিনেমাতে সাইকেলের একটা জায়গা আছে। সপ্তপদীর ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু কে দেখেছি সাইকেলে করে ডাক্তারি করতে, রীনা ব্রাউন এর কাছে ঝাড় খাবার পরে। উত্তমকুমার থেকে শুরু করে প্রায় সব হিরোই, এমনকি কলেজ পড়ুয়া হিরোইনরা, গুছিয়ে সাইকেল চালিয়েছেন। একালের সিনেমায় কাঁচা প্রেম পাকাতে সাইকেল সিরিয়াস রোল প্লে করেছে। সাথে একটা লাগসই ঝিঙ্কু গান। স্কার্ট পরা বিনুনী ঝোলানো নায়িকা বন্ধুদের সাথে স্কুল থেকে ফিরছে। এদিকে নায়কও বন্ধুদের নিয়ে সাইকেল চেপে হাজির। গানের তালে সম্ভাব্য সব রকম উপায়ে নায়িকাকে বিরক্ত করা দেখে ডাকসাইটে ইভটিজার ও ফ্রাস্টু খাবে। নায়িকা চোখ মুখ কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটবে, আপনারও ইচ্ছে হবে নায়কের কাঁধ অবধি নামা চুলের মুঠি ধরে দু ঘা দিতে। যদিও গানের শেষ দিকে বিব্রত নায়িকা আচমকা বিনা নোটিশে প্রেমে পড়ে যাবেন এবং পত্রপাঠ নায়কের সাইকেলে বসে পা দোলাতে দোলাতে পাহাড়ের কোলঘেঁষা রাস্তায় হারিয়ে যাবেন। অবশ্য সাইকেল চেপে ডেলিকেট প্রেম সাথে মন ভরানো গান এসবও অনেক আছে।
রিল লাইফ ছেড়ে রিয়েল লাইফেও সলমন খান কে দেখি সাইকেল চালিয়ে বডিগার্ড নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন, কিন্তু সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
যখন গাড়ি চালানো শিখি, ট্রেনার পই পই করে শিখিয়েছিলেন, সাইকেল খুব ভালো, মহিলারা আরো ভালো, কিন্তু সাইকেলের ওপর মহিলা খুব বিপজ্জনক। কারণ বলেননি। নিজে গাড়ি চালাতে গিয়ে দেখেছি কেন বলেছিলেন। আপনার গাড়ি র সামনে যে মহিলা সাইক্লিস্ট, হাজার হোক তার নারীর মন তো, প্রকৃতির নিয়মেই আপনি বুঝতে পারবেন না তিনি ঠিক কী করতে চাইছেন। তিনি যেকোন সময় এদিক সেদিক টার্ণ নিতে পারেন, আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন, সব সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা নিয়েই আপনাকে তার পিছনে থাকতে হবে।
নারী পুরুষ নির্বিশেষে এমন অনেকে আছেন, দেখবেন জগত সংসার রাস্তা ট্রাফিক এসব থেকে উদাসীন হয়ে নির্মোহ ভাবে ধীরেসুস্থে রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। পিছনের গাড়ি যতই হর্ণ দিক হয় খেয়াল করবেন না, খুব দয়ালু হলে ঘাড় কাত করে করুণাভরে একবার পিছনে তাকিয়ে আবার যেমন যাচ্ছিলেন তেমনই যেতে থাকবেন।
সবশেষে সাইকেলে প্রেম, আর একবার। তবে এবারে আর তেমন মর্মান্তিক নয়। এক উদীয়মান প্রেমিক তার প্রেমিকাকে সাইকেল শেখাচ্ছে। মোটামুটি শিখেই গেছে, প্রেমিকা সাইকেল চালাচ্ছে, পাশে প্রেমিক কাম ট্রেনার দৌড়চ্ছে। প্রেমিক আপ্লুত হয়ে বান্ধবীকে উৎসাহ দিতে দুবার পিঠ চাপড়ে দিল, অমনি মেয়েটি বলা নেই কওয়া নেই দড়াম করে আছাড় খেল। ছেলেটি প্রেমিক ঠিকই কিন্তু কঠোর ট্রেনার ও বটে। অনুসন্ধান করতে বসল এই বিপর্যয় এর। উত্তর যা পেল খুবই মর্মস্পর্শী ; সবার সামনে তুমি আমার পিঠে হাত দিলে, মাগো, আমি তো লজ্জায় মরে যাই, দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলেছিলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।