রম্য রচনায় যশোবন্ত বসু

অধরে মাধুরী

কোনও ঘটনার মতো কোনও বিশেষ গন্ধও স্মৃতিতে অবিকল থেকে যায়।
জনপ্রিয় স্প্যানিশ লেখিকা ইসাবেল অ্যাজেন্ডে ২৫ এপ্রিল, ১৯৯৮-এর ‘দ্য টাইম্স’ পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ চল্লিশ বছর আগের একটি চুমুতে লেগে থাকা চ্যুয়িং গাম, তামাক আর বিয়ারের স্বাদ আমার এখনও মনে আছে, যদিও যে আমেরিকান নাবিকটি সেই চুমু খেয়েছিল, তার মুখটা আমি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি।”

চুম্বনের এমনই মাহাত্ম্য !
তার নিরীহ,নিষ্পাপ হামি থেকে রোমাঞ্চকর চুমু হয়ে ওঠার পর্বে মন ও হর্মোন ওতপ্রোত জড়িত। থিয়োরিটিক্যাল ব্যাখ্যায় চুমু হল ভালবাসার উচ্ছ্বসিত পেলব স্পর্শ।রকমফেরে শ্রদ্ধা বা আনুগত্য প্রদর্শনেরও। এই যেমন, খ্রিস্টানরা ধর্মগুরু পোপের হাঁটুতে চুমু খান, বিশপরা আংটিতে চুমু খান, ফাদাররা চুমু খান পবিত্র ক্রসে। জোয়ান অব আর্ক নাকি তাঁর তলোয়ারে চুমু খেতেন, যেমন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করার পর ব্যাটে বা মাঠে চুমু খান। জুডাস তো চুমু খেয়েই ধরিয়ে দিয়েছিলেন যিশুকে। ইহুদিরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থ পাঠের শেষে টোরাকে চুমু খান। নমাজ পড়ার পর মসজিদের মেঝেতে চুমু খাওয়ার রেওয়াজ আছে মুসলমানদের। আর সম্মান জানাতে হাতে চুমু খাওয়া তো প্রাচীন পাশ্চাত্য প্রথা।

এসবে কোনও আড়াল নেই। আড়াল তখনই দরকার পড়ে যখন প্রথা ছেড়ে প্রেম হয়ে উঠতে চায় চুমু।রোমাঞ্চ সেখানেই, আর রোমান্স ও রোমাঞ্চ তো গায়ে-গায়েই যায় !

একসময় ভারতীয় সিনেমার সাবালক বা সাহসী হয়ে ওঠার প্রাথমিক মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছিল চুম্বনের প্রত্যক্ষ প্রদর্শন।
ওহ্, তার আগে হাওয়ায় দুটি ফুলের ঠোকাঠুকি, ফুলে ভ্রমর এসে বসার ছবি কিংবা দুটি পাখির ঠোঁট ঠেকাঠেকি – কত বালখিল্যপনা-ই না হয়েছে ! পরে অবশ্য বলিউড এবং তারও পরে আমাদের টলিউড হলিউডের অনেকখানি-ই রপ্ত করে ফেলেছে ।

এখন আলোচনার এই জায়গাটায় এসে যদি বলা হয়, চুম্বন আদতে হল মুখের চৌত্রিশটি পেশি এবং একশো চোদ্দটি পসচুরাল মাসলের একটি সুসংবদ্ধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আর এই কাজে সব থেকে দরকারি পেশির নাম অরবিকুলারিস ওরিস, যা কিনা দুজোড়া ঠোঁটকে মিশে যেতে সাহায্য করে, তাহলে তুমুল রসভঙ্গ হবে !

তার চেয়ে বরং রবীন্দ্রনাথে আসি। ইন্টারনেটে রবীন্দ্ররচনাবলী ঘেঁটে দেখছি, রবীন্দ্রনাথের রচনায় ১৪৮বার ‘চুম্বন’ ও দু্বার ‘চুমু’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে।

এবার ‘চুম্বন’ কবিতা থেকে কয়েক লাইন উদ্ধৃত করি,

“অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে,
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।”

যাঁরা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে চাওয়ার অনুযোগ করেন, তাঁরা এই লাইনগুলি দুবার পড়ে দেখতে পারেন।চুম্বনের স্বরূপ ও প্রকৃতির এত কাব্যময় ব্যবহার আর কি কেউ করেছেন ?

” দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা “…. বড় সুন্দর বর্ণনা ! তবে কিনা এই নিবিড়, অন্তরঙ্গ সাক্ষাতের আগে দুজনকেই দুজনের যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। স্পর্শের সেই তো প্রাথমিক শর্ত। তা না-হলে অনর্থ।

একসময় পশ্চিমের দুনিয়া যেরকম চুমু দেখেছে ও চেখেছে, আমাদের প্রাচ্য সেরকম পারেনি।
প্রযুক্তির হদ্দমুদ্দ জাপানে, চিনে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার চল ছিল না মোটেই। ওদের সিনেমাগুলিও ছিল চুম্বনদৃশ্যবর্জিত। একসময়ে তো রঁদ্যার ভুবনখ্যাত ভাস্কর্য ‘ দ্য কিস ‘- এর প্রদর্শনী পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি জাপানে। অথচ ইতিহাসের কী বিচিত্র লীলা ! দীর্ঘতম চুমুর বিশ্বরেকর্ডটি হল কিনা সেই পুবের দেশ থেকেই ! থাইল্যান্ডের দম্পতি এক্কাচাই তিরানারাত ও লাকসানা তিরানারাত ২০১৩ সালের ১২-১৪ ফেব্রুয়ারি পাটায়ায় একটানা আটান্ন ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট আটান্ন সেকেন্ড চুমু খেয়ে বিশ্বরেকর্ড করে ফেললেন ! ভাবা যায় !

চিকিৎসাশাস্ত্রের সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, একটি আবেগঘন চুম্বনে প্রতি মিনিটে তিন থেকে চার ক্যালোরি পোড়ে।
স্বাস্থ্যসচেতন দম্পতিরা এই আবিষ্কারকে ক্যালোরি পোড়ানোর ব্যায়াম হিসেবে ব্যবহার করবেন কিনা ভেবে দেখতে পারেন। তাতে অবশ্য রোমান্স শেষ অবধি বেঁচে থাকবে কিনা তার গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না ! বিশ্বরেকর্ড-গড়া ওই দম্পতি অতখানি ক্যালোরি ঝরিয়ে কেমন আছেন কে জানে ?

তবে ‘ হামি ‘ যতটা ছোটদের, ‘ কিস ‘ ততটাই বড়দের। ইংরেজি আর হিন্দি সিনেমা দেখে বাঙালি একসময় এই বোধিজ্ঞান লাভ করেছিল। কিন্তু যে-বাঙালি মা-কে ‘ মাম্মি ‘ বানায় সেই বাঙালিই কিস-কে শিশুসুলভ ‘ কিসি ‘ বানিয়ে ছেড়েছে !

এই পর্যন্ত তবু না-হয় সহ্য করা যাচ্ছিল। ইদানীংকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ করা যাচ্ছে, একটি মেয়ের পোস্ট করা কোনও ছবিতে অন্য একটি মেয়ে আবেগাপ্লুত মন্তব্য লিখছে, ” চুমু দিলাম ” ! আবেগের পর্দা আরও চড়ে গেলে লেখা হচ্ছে ” মুয়া “, ইংরেজিতে ” Muahhhh” ! মেয়েরাই করছে, কোনও ছেলেকে এখনও এমনটা করতে দেখিনি।

পিটুলি-গোলা যেমন দুধ নয়, ফ্লাইং-কিস-ও তেমন চুমু নয়। যে-চুম্বন নিবিড় অনুপম আবেগের ও আদরের, অধর যার প্রকৃত আধার, স্পর্শসীমার বাইরে তাকে এমন অকাতর বায়বীয় ও ‘ ট্রেন্ডি ‘ তথা পানসেপারা হয়ে উঠতে দেখলে খারাপ লাগে।

আড়াল না-থাকুক, তার নিজস্ব মর্যাদাটুকু তো থাকবে ।

বিংশ শতাব্দীর মার্কিন কবি ও গীতিকার ই ওয়াই হারবার্গের চারটি লাইন দিয়ে এই চুমু-চর্চা গুটিয়ে ফেলবো। চুম্বনের যে-কোনও আলোচনায় এই লাইনগুলি একেবারে মোক্ষম রেফারেন্স।

১৯৬৫ সালে লেখা এই ছোট্ট কবিতাটির নাম ‘Inscriptions on a Lipstick’…

লাইনগুলি হল :

” Oh, innocent victims of Cupid,
Remember this terse little verse:
To let a fool kiss you is stupid.
To let a kiss fool you is worse.”

সত্যিই মনে রাখার এবং ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো দামি পরামর্শ !

[ তথ্যসূত্র : সুচিত্রা ভট্টাচার্যের নিবন্ধ ‘ চুমু ঘিরে নানা ধমক-চমক ‘/ ‘ দেশ ‘, ১৭ নভেম্বর, ২০১৪ ;
Oxford Dictionary of Quotations and Proverbs এবং ইন্টারনেট ]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।