“রথযাত্রা Special” প্রবন্ধে চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

মাহেশের রথের অজানা কথা

জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় পেলেন নবাব আলি খাঁ
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
এই বছর জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা হল না। রথের রশি ধরার লোক অনেক ছিলেন, কিন্তু করোনার ভয়ে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় আটকেছে। যাঁদের ছোঁয়ায় রথ চলে, সেই মানুষগুলি তো এখন রোজগারহারা ‘পরিযায়ী’ নাম নিয়ে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী, সেলফ কোয়ারেন্টিন। প্রভূ কি তাতে খুশি? তিনি কি রুষ্ট হলেন? অজানাই রয়েছে। প্রভূ নিজেও সম্প্রতি সেলফ কোরায়েন্টিন থেকে বাইরে এসেছেন। প্রতি বছর স্নান যাত্রার পরে জ্বর কাঁপতে কাঁপতে তাঁকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে হয়, কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়, তা সে পুরীতেই হোক বা মাহেশে।
পুরীর পরেই সবচেয়ে বিখ্যাত মাহেশের রথযাত্রা। মাহেশের রথযাত্রার কথাতেই মনে আসে বঙ্কিমের রাধারানীর কথা। রাধারানীর মর্মস্পর্শী কাহিনীতে প্রেক্ষাপট মাহেশ হলে আসল ঘটনাটি মাহেশের না। বঙ্কিমভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, নৈহাটি কাঁঠালপাড়ার একটি ঘটনায় দাদা এতটাই চিন্তিত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, পরে সেই ঘটনার অকুস্থল বদলে তিনি রাধারানী কাহিনী লেখেন। মূল ঘটনার সময়ে বেঁচে ছিলেন পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নৈহাটির রথের মেলায় পাড়ার এক বালিকা হারিয়ে যায়। পাড়ার তরুণ, যুবক, প্রৌঢ়রা বালিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। সেই দলে ছিলেন বঙ্কিমও। মেয়েটিকে পাওয়া যায়। কিন্তু ঘটনাটি বঙ্কিম-মানসে এতটাই প্রভাব ফেলে যে, তিনি দুমাসের মধ্যে লিখে ফেলেন ‘রাধারানী’।
মাহেশের এই মন্দির ঠিক কবেকার, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে নিঃসন্দেহে এটি বাঙলার এক প্রাচীন মন্দির। একটি তথ্যে জানা যায়, প্রথম এখানে রথযাত্রা হয়েছিল ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে। তারপর থেকে এর মধ্যে অন্তত একবার হলেও এই বছরের মতো রথ চলেনি। সেটা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ, বাংলা ১২২৫ সাল। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “২২ রবিবার রথযাত্রা হইল তাহাতে মাহেশের রথ অতি বড় এত বড় রথ এতদ্দেশে নাই লোক যাত্রাও অতি বড় হয় এইরূপ প্রতি বৎসর রথ চলিতেছে কিন্তু এ বৎসর রথ চলন স্থানে নূতন রাস্তা হওনে অধিক মৃত্তিকা উঠিয়াছে এবং অতিশয় বৃষ্টি প্রযূক্ত কর্দম হইয়াছে তাহাতে রথ কতক দূর আসিয়া রথের চক্র কর্দমে মগ্ন হইল কোন প্রকারেও লোকেরা উঠাইতে পারিল না শেষে লোকযাত্রা ভঙ্গ হইল ইহাতে রথ চলিল না।” (সমাচার দর্পণ, ১১ জুলাই, ১৮১৮)। (বানান ও বাক্যবিধি অপরিপর্তিত)
লক্ষ্যণীয়, সেই বছর পুরীতেও রথযাত্রা হয়নি। কেন হয়নি, তা এই লেখকের জানা নেই, অনুসন্ধানে পাওয়া যেতে পারে। পুরীর রথ যে সেবছর চলেনি, তার সাক্ষ্য দিচ্ছে সমাচার দর্পণ-এর সেই সংবাদই। তাতে লেখা হয়েছিল, “… কেহ কহিল যে উড়িষ্যাতে রথ চলে নাই অতএব এখানেও চলিল না। রথ না চলাতে অনেকের ক্ষতি হইল।”
বাঙলার প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায় স্মার্ত পণ্ডিত ও ধর্ম ব্যবস্থাপক রঘুনন্দনের ‘তীর্থতত্ত্ব’ গ্রন্থে। রঘুনন্দন এরপর রথযাত্রা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর ‘যাত্রাতত্ত্ব’ গ্রন্থে। লক্ষ্যণীয়, এই একই সময়ে পণ্ডিত গোবিন্দাচার্য-র ‘বর্ষক্রিয়া কৌমুদি’ গ্রন্থে রথযাত্রার কোনও উল্লেখ নেই। বৈষ্ণবদের কাছে রথযাত্রা এখন বিশেষ উৎসব। কিন্তু বৈষ্ণবদের প্রামাণ্য তথা বিশেষভাবে পূজিত ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে রথযাত্রা সম্পর্কে কোনও কথাই পাওয়া যায় না। পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরেই সজ্ঞানে নিমাই চৈতন্যকে হত্যার সম্পর্কে লোকশ্রুতিই তার কারণ কি না, জানা নেই। তবে, লোকশ্রুতি সত্য হলে, এটা খুব অস্বাভাবিক নয় যে, সেই সময়ের চৈতন্য ভক্তরা জগন্নাথকে পছন্দ করবেন না।
মাহেশের রথের কথায় আসি। লোকশ্রুতি, ধ্রুবানন্দ নামে এক ব্রহ্মচারী শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীক্ষেত্র গিয়েছিলেন। সেখান থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মাহেশে আসেন গঙ্গাস্নানে। গঙ্গার তীরে পলিমাটির নিচ থেকে তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি উদ্ধার করেন। তারপর তিনিই এই মূর্তিগুলি একটি ছোট্ট মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিগুলি ওখানে কিভাবে এল বা তিনিই কি পুরী থেকে মূর্তিগুলি এনে এখানে পুঁতেছিলেন কি না, সেসব প্রশ্ন আজ অবান্তর। তবে প্রথম যে পাকা মন্দিরটি তৈরি হয়, তাঁর সেবায়েৎ ছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূর পার্শ্বদ কমলাকর পিপলাই। মন্দিরের গায়ে শ্বেতপাথরে লেখা আছে, “শ্রীপাট মাহেশের শ্রীশ্রী ঁজগন্নাথদেবের প্রথম সেবায়েৎ, দ্বাপর যুগের ব্রজধামের ৫ম গোপাল এবং শ্রীমৎ মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম অন্তরঙ্গ পার্শ্বদ শ্রীল শ্রীকমলাকর পিপলাই চক্রবর্তীর স্মৃতি-ফলক।”
এখানে আবার এক ধন্দ্ব আছে। চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্যের কথা সত্য জেনেও কমলাকর পিপলাই কি করে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েত হলেন? চৈতন্যদেব মাহেশ সংলগ্ন শ্রীরামপুরে এসেছেন। জগন্নাথদেবের ‘মাসীর বাড়ি’ বলে খ্যাত গুঞ্জাবাড়ি এই শ্রীরামপুরের সীমান্তেই। কথিত আছে, শ্রীরামপুরের এক মন্দিরে এক অত্যুৎসাহী ভক্ত চৈতন্যদেবের পাশে শ্রীরাধার মূর্তি রেখেছিলেন। চৈতন্যদেব ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের মূর্তিটি তুলে নিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই মন্দির আজও ‘বিধবা রাধার মন্দির’ নামে উল্লেখিত হয়। কিন্তু, চৈতন্যদেব মাহেশে জগন্নাথ মন্দিরে আসেননি।
তবে, জগন্নাথ মন্দিরের গায়েই একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে। কমলাকর পিপলাই সেই মন্দিরের সেবায়েৎ ছিলেন। এখন সেই মন্দিরে রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আর নেই, সেটি রক্ষিত আছে জগন্নাথ মন্দিরে। অনেক প্রবীণ মানুষ বলতেন, তাঁরা বংশানুক্রমে শুনেছেন, কমলাকর পিপলাই জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েৎ হয়ে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ সেখানে স্থাপন করে চৈতন্যদেবের মৃত্যু রহস্যের মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সত্য মিথ্যা জানা নেই, তাই স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথে– “শূন্য পথা চাই/আজ তাঁর কোনও চিহ্ন নাই/নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো/ যুগে যুগে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের আলো।”
মাহেশের যে রথটি এখন চলে, সেটি অতিপ্রাচীন রথটি নয়। প্রথম কাঠের রথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন হুগলি জেলের বড়া গ্রামের বাসিন্দা দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু। কৃষ্ণরামের পুত্র গুরুচরণ যখন প্রবীণ, ততদিনে রথটি জরাজীর্ণ হয়েছে। সকলের আবেদনে সাড়া দিয়ে গুরুচরণ বসু নতুন একটি কাঠের রথ বানিয়ে দেন। কয়েক বছর পর এক দুর্ঘটনায় গুরুচরণের অর্থানুকূল্যে তৈরি রথটি আগুনে ভষ্মীভূত হয়। আবার নতুন রথ বানিয়ে দেন গুরুচরণের পুত্র রায়বাহাদুর কালাচাঁদ বসু। এই রথটি দীর্ঘদিন চালু থাকার পর জরাজীর্ণ হলে কালাচাঁদ-পুত্র বিশ্বম্ভর বসু নতুন আরেকটি রথ বানিয়ে দেন। বাংলা ১২৯২ সালে সেই রথটিও ফের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর বিশ্বম্ভর বসুর ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু প্রথম এখানে লোহার তৈরি রথ বানিয়ে দেন, যাতে আর আগুনে ছাই হওয়ার বা জরাজীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।
আরও অনেক অনেক এমন কাহিনি আছে এই জগন্নাথ মন্দির ও মাহেশের রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে। রাধারানী ছাড়াও অনেক কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ আছে মাহেশের রথকে কেন্দ্র করে। অন্য কোনও সময়ে বলা যাবে। একটি তথ্য দিয়েই এই লেখার যবনিকা টানি। মন্দিরের বর্তমান সেবায়েৎদের পদবী ‘অধিকারী’। অবশ্য এটিও তাদের পাওয়া উপাধি, যা এখন পদবী হয়ে গিয়েছে। তাদের এই উপাধি পাওয়া একটি ঘটনায়, যা আজকের দিনে বলাটা খুব জরুরি।
সকলেই জানেন, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে হিন্দু ছাড়া কারও প্রবেশ নিষেধ। এমনকি হিন্দুদের মধ্যেও নিম্নবর্ণের মানুষ হলে প্রবেশাধিকার নেই। গত বছর দলিত বলে ভারতের রাষ্ট্রপতিকেও এই মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াত স্বামী হিন্দু হলেও তাঁকে মুসলমান বলে প্রচার করে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ফলে, ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই মন্দিরে প্রবেশে বাধা পান।
আর মাহেশের জগন্নাথ ঠিক তাঁর উলটো। ১৬৫০ সাল। হুগলির সপ্তগ্রামের নবাব তখন আলি খাঁ। নবাবদের যেমন মর্জি, বর্ষার মরশুমে গঙ্গায় বাজরায় প্রমোদ ভ্রমণে বের হলেন। তখন আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বানী হতো না। নবাবের প্রমোদ সফরকে আতঙ্কে পরিণত করে উঠল প্রবল ঝড়। বাজরা ডুবে যাওয়ার দশা। মাঝিরা কোনওরকমে পাশের এক ঘাটে বাজরা ভেরালেন। নবাব ততক্ষণে ভিজে ঢোল। এদিকে, ঘাটে কোনও প্রতিরক্ষা নেই। নবাবকে কোথাও আশ্রয় নিতেই হবে। অগত্যা দেহরক্ষীরা নেমে খানিক এগিয়ে একটি মন্দির দেখতে পেলেন। নবাবকে সেখানেই আনা হলে তৎকালীন সেবায়েৎ রাজীব সাগ্রহে নবাবকে আপ্যাহন করে আশ্রয় দেন। তাঁর সিক্তবসন বদলের ব্যবস্থা করেন, গরম দুধ পান করিয়ে নবাবের দেহের তাপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন।
নবাব আলাপ করে জানতে পারেন, এই মন্দিরের জমি দিয়েছেন শেওড়াফুলি নিবাসী আড়ষা পরগণার জমিদার রাজা মনোহর রায়। তিনি শুধু মন্দির নয়, ওই এলাকার বিরাট জমিকে জগন্নাথপুর নামকরণ করে মন্দিরের আয়ের ব্যবস্থা করেছেন। ঝড় থামার পর নবাব ফিরে গিয়ে রাজা মনোহর রায়কে ডেকে আলোচনা করে জগন্নাথ মন্দিরের জমি ‘নিষ্কর দেবোত্তর’ ঘোষণা করেন। সেইসঙ্গে মন্দিরের সেবায়েতদের উপাধি দেন ‘অধিকারী’। এর ফলে, রাজা মনোহর রায়ের আয়ের যে ঘাটতি হবে, তা আড়ষা পরগনা থেকে সংগ্রহের অনুমতিও দেন।
বেতালের মতো প্রশ্ন করি — কোন জগন্নাথ ভালো? পুরীর না মাহেশের?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।