• Uncategorized
  • 0

যোসেফ স্তালিনের জন্মদিনে লিখলেন – মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির গল্প

একটা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের মানুষ। সে দশলক্ষ মানুষকে জেলে পাঠিয়ে ছিল, আর সাত লক্ষ মানুষকে মৃত‍্যুদণ্ড দিয়ে ছিল। সারা জীবনে লোকটা প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
লোকটা নিজের খুব সম্মানিত ও খুব উচ্চপদস্থ ব‍্যক্তিত্বদের খুন করাতে দুবার ভাবত না। যাতে নিজেকে বেঁটে না দেখায়, তাই বক্তব্য রাখার সময়ে একটা টুলের উপর উঠে পড়ত। মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে করতে সে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত বোধ করছিল। দেশের একটা শহরের নাম বদলে নিজের নামে বানিয়ে ফেলেছিল। আর লোকটার মৃত্যুর পর আবার সেই শহরের নাম গেল বদলে। তার নাম মুছল। দেশের সেরা স্থানে তার সমাধি রচনা হয়েছিল। সেখান থেকে তার দেহাবশেষ পর্যন্ত তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল।
আমি জুগাশভিলির কথা বলছি। কি বলছেন, চেনা গেল না? তাহলে আসল নামের বদলে ছদ্মনাম টাই বলতে হয়। নিজেকে ইস্পাতের মতো কঠিন ভাবত লোকটা। আজকের দিনে তার জন্ম। ১৮৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। রাশিয়ার টিফলিস এর গোরি তে। ১৯১৩ সালের বারোই জানুয়ারিতে লোকটা নিজের নাম রাখে স্টালিন, স্টালিন মানে স্টীলের মতো কঠিন, কঠোর, নির্মম। স্টীলের মতো হৃদয়হীন।
স্পষ্টত‌ই আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্টালিনের কথা বলছি। আজ এই নির্মম হৃদয়হীন একনায়কের জন্মদিন।
দুনিয়া কাঁপানো দশদিন। শুরু হল সাত নভেম্বরে। ১৯১৭ সাল। বিপ্লবে বদলে গেল রাশিয়া। জারতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা হল রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশিয়ালিস্ত রিপাবলিক। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হল পিপলস্ কমিশারদের প্রথম কাউন্সিল।
লেনিন ছাড়া সেখানে র‌ইলেন লিও ট্রটস্কি, আর জোসেফ স্টালিন। বলা দরকার, এই ট্রটস্কি রেড আর্মি গঠন করেছিলেন।বিপ্লব সংহত করতে ১৯১৯ সালের তেইশ মার্চ রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে পাঁচ সদস্যের পলিটব্যুরো তৈরি হয়। পলিটব্যুরোয় র‌ইলেন লেনিন, ট্রটস্কি, স্টালিন, লেভ কামেনেভ, নিকোলাই ক্রেসতিনস্কি।
বিপ্লব সংগঠিত হবার পর লেনিন সামান‍্য দিন সুস্থ সবল ছিলেন। ত্রিশ আগস্ট, ১৯১৮ তারিখে দক্ষিণ মস্কোতে মাইকেলসন আর্মস ফ‍্যাকটরি নামে একটি অস্ত্র কারখানার কাছে শ্রমিকদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে গেছেন লেনিন। কাপলান, ফ‍্যানি এফিমভনা কাপলান, বছর ঊনত্রিশ বয়স তার, লেনিনকে পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনিই লেনিন? লেনিন বললেন, “হ‍্যাঁ। কেন?”
প্রশ্নের উত্তরে লেনিনকে গুলি করে কাপলান। ব্রাউনিং পিস্তল থেকে ক্লোজ রেঞ্জের তিন তিনটি গুলি।
লেনিন কিন্তু আহত হবার সাথে সাথেই মারা যান নি। কিন্তু গুরুতর জখম হয়ে প্রায় অকর্মণ্য হয়ে পড়লেন। লেনিনের অসুস্থতা আর কোনো ক্রমেই সারল না। ১৯২৪ এর শীতে জানুয়ারির একুশে লেনিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লেনিনের আততায়ী কাপলান কিন্তু যে সে মেয়ে ছিল না। সে ছিল সোশিয়ালিস্ত রেভলিউশনারি দলের একনিষ্ঠ কর্মী।
১৯২২ সালের তেসরা এপ্রিল অসুস্থ গুলিবিদ্ধ লেনিন রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদের দায়িত্ব অর্পণ করেন পলিটব্যুরোর অন‍্যতম নেতা স্টালিনকে। তার পর শুরু হয় নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার দখল নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ।
বিপ্লবের উপাসকদের কাণ্ড কারখানা দেখে অসুস্থ অশক্ত লেনিন মনোবেদনায় ভারাক্রান্ত হন। রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির হাতে লেনিন তুলে দেন নিজের ইচ্ছাপত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসন ব‍্যবস্থায় কিছু বদল চাইছিলেন লেনিন। স্টালিন, ট্রটস্কি আর অন‍্য নেতাদের কাজের রকম সকম দেখে লেনিন কড়া সমালোচনাও করেন।
তারিখটা ১৯২৪ সালের একুশে জানুয়ারি। ওইদিন লেনিনের দেহাবসান হল।
স্টালিনের সাথে ট্রটস্কির সম্পর্কের উন্নতি তো হল‌ই না, বরং অবনতি ঘটে চলল। ১৯২৭ সালের বারোই নভেম্বর, বিপ্লবের অন‍্যতম কাণ্ডারী ও রেড আর্মির প্রতিষ্ঠাতা, পলিটব্যুরো নেতা ট্রটস্কিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করলেন জোসেফ স্টালিন।
নির্বাসিত হয়েও ট্রটস্কি স্টালিনের অমানবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
পরে লোক নিয়োগ করে স্টালিন এই বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী ব‍্যক্তিত্বকে খুন করান। ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট ছিল তারিখটি। মেক্সিকোয় খুনির কুড়ি বছরের কারাদণ্ড হয়। স্টালিন ওই সাজাপ্রাপ্ত খুনি ব‍্যক্তিকে “অর্ডার অফ লেনিন” সম্মানে ভূষিত করেন।
ট্রটস্কির মতো তাত্ত্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রতিভাশালী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকে দূর করে দিয়ে স্টালিন উদগ্র ভাবে পার্টির সমস্ত ক্ষমতা ও রাশ নিজের অধিকারে নিয়ে নিলেন। শুরু হল একনায়কের লৌহকঠিন নিষ্পেষণ।
দুই বছর পরেই আরেক শীতের দিনে, ১৯২৯ সালের সতেরোই নভেম্বরে আরেক পলিটব্যুরো নেতা নিকোলাই বুখারিনকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিলেন স্টালিন।
তার তিন বছর পর, ১৯৩২ সালে, শীতের গোড়ায়, অক্টোবরের নয় তারিখে স্টালিন দূর করে দিলেন দুজন শীর্ষস্তরের নেতা লেভ কামেনেভ আর গ্রিগরি জিনোভিয়েভকে। মনে রাখবেন, লেভ কামেনেভ ছিলেন ১৯১৯ এর মার্চ মাসে অষ্টম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরো সদস্য।
পার্টির মধ্যে নিজের ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে অনড় ছিলেন স্টালিন। ১৯৩৪ সালের ১ ডিসেম্বরে লেনিনগ্রাদের মেয়র সের্গেই কিরভ খুন হন।
রাশিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের অভ‍্যুত্থানের অন‍্যতম সংগঠক ও পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন লেনিনগ্রাদের মেয়র সের্গেই কিরভ। ১৯৩৪ সালের ১ ডিসেম্বরে লেনিনগ্রাদের পার্টি অফিসে তাঁকে গুলি করে খুন করেন এক বিশিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ নিকোলায়েভ। অবশ‍্য লিওনিদকে সের্গেই হত‍্যায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন সর্বোচ্চ সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন নিজেই।
ওই লেনিনগ্রাদের মেয়র সের্গেই হত‍্যার ছুতো ধরেই পরবর্তী চারটি বছর ধরে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে পার্জ করার নামে খুন করালেন স্টালিন। অথবা নির্বাসনে। অথবা জেলে।

একে একে রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিভাবান ব‍্যক্তিত্বদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করে, নির্বাসনে পাঠিয়ে, খুন করিয়ে স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলেন। ১৯৪১ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভকেও সরিয়ে দেন তিনি।
শুধু রাশিয়ার মধ‍্যে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের খুন করানোয় স্টালিনের অমানুষিক নির্মমতা প্রকাশ পায় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও ব্রিটেনের সাথে তাঁর সখ্যতা এতদূর বাড়ে যে, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আশ্বস্ত করতে ১৯৪৩ সালে, পনেরোই মে তারিখে বিশ্বজোড়া শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আন্দোলন গড়ার আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিনটার্ন বা থার্ড ইন্টারন‍্যাশনালকে ভেঙে দেন।

এরপর আর বছর দশেক একনায়কসুলভ অত‍্যাচারের ঠেলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করেন জোসেফ স্টালিন। ১৯৫৩ সালের পয়লা মার্চ, নিজের একেবারে কাছের উপদেষ্টাদের সাথে সারা রাত ধরে সিনেমা দেখতে দেখতে, পান ভোজন ফূর্তি করতে করতেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে কোমায় চলে যান স্টালিন। চারদিন কোমায় থেকে জীবনদীপ নির্বাপিত হয় এই নিষ্ঠুর নৃশংস একনায়কের। পাঁচ মার্চ থেকে নয় মার্চ, ১৯৫৩, এই চারদিন রাষ্ট্রীয় শোকপালন হয়।
এহেন ইস্পাত কঠিন একনায়কের মৃত্যুর পর তিনটি বছর অতিক্রান্ত হবার আগেই, ১৯৫৬ সালের পঁচিশে ফেব্রুয়ারি তারিখে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে স্টালিনের অত‍্যাচারী রক্তপিপাসু ভূমিকার তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করেন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ। আরো বছর পাঁচেক বাদে ১৯৬১ সালের ত্রিশে অক্টোবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে, স্টালিন যেভাবে লক্ষ লক্ষ পার্টি কর্মীকে জেলে পাঠিয়েছেন, বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই যেভাবে লক্ষ লক্ষ পার্টি সংগঠককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের ভূমিকা অস্বীকার করে রাষ্ট্রের ইতিহাসকে নিজের হুকুমে লিখতে বাধ‍্য করেছেন, তাতে তাঁর মরদেহকে লেনিনের সমাধির পাশাপাশি রাখা চলে না। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিনের সমাধির নিকট থেকে একনায়কের মরদেহ অপসারণ করে ক্রেমলিন ওয়াল নেক্রোপলিসে জঞ্জালের পর্যায়ে ফেলা হয়। ১৯২৫ সালে স্টালিনের চাপে ভলগা নদীর তীরে যে গুরুত্বপূর্ণ নগরীর নাম রাখতে হয়েছিল স্টালিনগ্রাদ, বছর ছত্রিশ পরে ১৯৬১ তে সেই নগরীর নতুন নাম হল ভলগোগ্রাদ। এরপর একদিন দেশবাসী মৃত স্টালিনের বিরাট ধাতব মূর্তির গলায় শিকল বেঁধে টেনে নামালো, ধাতুখণ্ডকে নিয়ে চলল কারখানা ঘরে। অপ্রয়োজনীয় মূর্তির ধাতু গলিয়ে জাতির কাজে লাগাতে।
একনায়কের‌ও মৃত্যু হয়। আর মৃত্যুর পর তার প্রতি নির্যাতিত জনতার ঘৃণার শেষ থাকে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।