মেহেফিল -এ- কিসসা নুসরাত রীপা

আলেয়া

দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। শীতের বেলা দ্রুত ফুরোয়। সূর্যের তেজ ম্লান হয়ে এসেছে। সিকদার বাড়ির উঠোনে বিকেলের ছায়া ঘন হয়ে আসছে। নারকেল পাতার ফাঁক গলে এক ফালি হলুদ আলো ঘরের দেয়াল ঘেঁষে নেমে এসেছে উঠোনে। তার বিষন্ন হলুদে কেমন যেন থম থম করছে চারদিক। অনেক দূরে কোথাও আপন মনে একটা ঘুঘু ডাকছে। আরো দূর কোথাও হতে নরম শিশু কন্ঠের কোলাহল ভেসে আসছে।

পূবের ঘরের দাওয়ায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে আলেয়া।দুই চোখে তার অসীম শূন্যতা।

কিছু আগে ভেঙে যাওয়া সালিশে মাজেদ এর সাথে আলেয়ার তালাক হয়ে গেছে।অভিযোগ,আলেয়া চরিত্রহীনা।

মাজেদের সাথে আলেয়ার বিয়ে হয়েছে বছর দুই হবে। নিরুদ্দেশ বাপ, মৃত মা, সেই আলেয়া বড় হয়েছে মামা বাড়িতে।গেরস্ত বাড়ির আনাচে কানাচে অবহেলা অযতনেও পুঁইলতা যেমন লকলক করে বেড়ে ওঠে ঠিক তেমনি আলেয়াও বেড়ে উঠেছে আগাছার মতোই অনাদরে, অবহেলায়, দিনভর কাজ আর আধপেটা খাওয়া- এই ভাবে সতেরো বছর কেটে গিয়েছিলো। মামাতো ভাই বোনদের সাথে অবশ্য ভাব ছিলো খুব। আলেয়া ওদের চুলে তেল দিয়ে দিতো, হাত রাঙাতে মেহেদী বেটে দিতো, কাঠালের মুচি পেড়ে এনে পেয়ারা আর তেতুঁল দিয়ে ভর্তা বানাতে আলেয়ার জুড়ি ছিলো না। তাই মামাতো বোনেরা যে কোনো কাজে আলেয়াকেই ডাকতো। বোনেদের সাথে গল্প,খেলার সুযোগ ছিলো বলে অন্য কষ্টগুলো গায়ে লাগতো না।

জন্ম থেকেই যারা দুঃখী তাদের কষ্ট সহ্য করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে। আলেয়ার ও আছে। তাই ছোট মামা যখন ঋনের টাকা শোধ করতে না পেরে মাজেদের সাথে আলেয়ার বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, মজিদের প্রথম পক্ষ থাকা সত্বেও আলেয়া টু শব্দটি করেনি। কেবল বড় মামীকে বলেছিলো, ঐ ব্যাডার বলে বউ আছে।

বউ ছাড়া ব্যাডা কি তরে যৌতুক ছাড়া বিয়া করবো? মামীর উল্টো প্রশ্নে চুপ করে গিয়েছিলো আলেয়া।

অতপর এক শুক্রবার জুম্মার পর কয়েকজন ময়মুরুব্বি নিয়ে আলেয়াকে ঘরে তুলে এনেছিলো মাজেদ।

প্রথম দিনেই আলেয়া বুঝেছিলো ও আসলে বউ না। কাজের বেটি। বড় বউ প্রায়,প্রায়ই কোমড় ব্যথায় বিছানায় পড়ে থাকে। বিশাল সংসারের নানা গ্যাঞ্জাম নিজের লোক ছাড়া সামাল দেয়া কঠিন। আর এ সব কাজ করার জন্যই এ বাড়িতে আলেয়ার প্রবেশ।

বিয়ের পূর্বে আর বিয়ের পরের পার্থক্য কেবল একটাই তা হলো আগেরটা ছিলো মামা বাড়ি আর এটা স্বামীর।

২)

মাজেদের মা আমেনা বেগম কে ভালো লাগতো আলেয়ার। মহিলা আর দশজন শ্বাশুড়ির মতো নয়। এই সংসারে আলেয়ার হাড় ভাঙা খাটুনির কষ্টটা সেই কেবল বুঝতো। সময়ে অসময়ে সেই  ডাক খোঁজ করে, কাজ রেখে খেয়ে নিতে বলতো। আলেয়া তাই আমেনা বেগমের সেবা শুশ্রূষা একটু বেশি করতো। সেসব ভেবেই হয়তো আমেনা বেগম লুকিয়ে মাটির মালসায় করে খানিকটা ভাত আর ডাঁটার তরকারি দিয়ে গেছে কিছু আগে । সে মালসা তেমনই পড়ে আছে। আলেয়া ছুঁয়েও দেখেনি। ওর এখন ক্ষিদের অনুভূতি নেই।

সালিশ ভেঙে যাবার পর মেলা সময় গড়িয়েছে। লোকজন চলে গেছে। মাজেদও ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। আলেয়া তবু বসে আছে। বসে না থেকে কী করবে। কোথায় যাবে?  মামার বাড়িতে সালিশে আসার জন্য খবর দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কেউ আসেনি। দুশ্চরিত্রা মেয়ে কে ঘরে ফিরিয়ে নিতে কে ই বা চায়! আলেয়া তাই ঝুম মেরে পড়ে আছে।

একটা সামান্য বিষয় এতো বিশাল হয়ে উঠবে আলেয়া বোঝেনি। মাজেদ আলেয়াকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্ত আলেয়ার সাথে তার সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। দাসী মালিকের মতো।কাজ করতে আলেয়ার কষ্ট নেই কিন্তু স্বামী যদি স্বামীর মতো না হয় নারীর জীবনে সে বিশাল কষ্ট। সে কষ্ট সহ্য করার নয়।

পুকুরে কাপড় কাচতে গিয়ে আলেয়া শুনেছিলো পাশের গ্রামে এক বুজুর্গ এসেছেন। তিনি ভরা মজলিসে মাইকে ফুঁ দিয়ে পানি পড়া দেন। যে যেই নিয়তে সেই পানি পান করে তার সেই মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
বিষয়টা শোনার পর থেকেই মাথায় ঘুরছিলো আলেয়ার। ঐ পানি এক শিশি পেলে স্বামীর নজর তার প্রতি ফিরতো! কিন্তু পাশের গ্রামে সে যাবে কীভাবে? ঠিক সে সময়ই তার আরবাজের কথা মনে পড়লো।

আরবাজ মাজেদের চাচাতো ভাই। কাছে পিঠেই তাদের বাড়ি। বয়সে মাজেদের চাইতে বেশ ছোটো হলেও দু’জনের সম্পর্ক বন্ধুর মতন। কাম কাজ কম থাকলে মাঝে মধ্যেই সন্ধ্যাবেলা আরবাজ আসে। বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে মাজেদ আর আরবাজ বসে গল্পগুজব করে।  পান সিগারেট খায়। মাজেদের বড় বউ মাঝে মাঝে গিয়ে সে আসরে হাসি মশকরা করে। সংসারের কাজ বাজ ছাড়াও মাজেদের বড় বউ এর ঘরের তিন ছেলেমেয়ের দেখভালের দায়িত্ব ও আলেয়ার। সে বাচ্চাদের খাওয়ায়। ইসকুলের জামাকাপড় সাজায়ে দেয়,মাস্টার আসলে চা নাস্তা দেয়। বাচ্চারা বার বাড়ির ঘরে পড়ে। তাদের পড়ার সময় আলেয়া ঐ ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। বাচ্চারা যাতে ভয় না পায়,সেজন্য। আলেয়া বারান্দার আলো নিভিয়ে বসে থাকে। বসে বসে আকাশ কুসুম ভাবে। কখনো কান পেতে উঠোন থেকে ভেসে আসা হাসি গল্প শোনে। আর সে সব কথা বার্তা শুনেই আলেয়ার মনে হয় আরবাজ ছেলেটা বেশ ভালো। মানুষের প্রতি তার হৃদয়ে মায়া মমতা আছে। আলেয়ার সাথে তার একাকি যে কয়বার দেখা ও কথা হয়েছে সে সেসব মাজেদ কে বলেনি। আলেয়া তাই সিদ্ধান্ত নেয় আরবাজকেই সে গোপনে এক শিশি পানি পড়া এনে দিতে বলবে। পানি পড়া কেন আনছে,সেটা বলবে না। আরবাজ নিশ্চয়ই এনে দেবে।

৩)

পরশুদিন সন্ধ্যাবেলা সেইরকম গল্পের আসর বসেছিলো। পরদিন শুক্রবার, স্কুল বন্ধ বলে বাচ্চারা টিভি দেখছিলো। আলেয়া দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে বাড়ির পেছনের সরু রাস্তাটার ধারে কুমড়ো মাচানের অন্ধকারে একটা ছোট শিশি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। আরবাজ আড্ডা শেষে রাতে এ পথেই বাড়ি ফেরে।

কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়। আরবাজকে দাঁড় করিয়ে পানি পড়া আনবার বিষয়টা আলেয়া কেবল বলতে শুরু করেছিলো ঠিক তখুনি ওদিক থেকে মাজেদের কথা শোনা গেলো। আরবাজ গেছো গা?
মাজেদের কন্ঠ শুনেই”ভাবী মাজু ভাই আসতাসে,আপনারে আমার লগে এইখানে দেখলে সে খারাপ ভাববো, আমি এহন যাই। কাল দিনে আইসা কথা কমু নে” বলেই আরবাজ দ্রুত অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেলো।

আলেয়া কোনো কথা বলার সুযোগই পেলো না।  ও কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখলো হাত পাঁচেক দূরের মাজেদকে। এই রাইতে অন্ধকারে কী করোস? মাজেদ কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো। আলেয়া কী বলবে বুঝতে পারছিলো না। আরবাজের কথা বলা যে ঠিক হবে না সেটা জানে। ও তাই আমতা আমতা করে বললো, এমনেই। ঘরে ভাল্লাগতেছিলো না। এর লাইগা–”
আলেয়ার কথা শেষ হয় না, মাজেদ হুংকার দিয়ে ওঠে, হারামজাদি ক’ কোন মরদের লগে নষ্টামি করতে আইছিলি?”

আলেয়া যতই বলে “কেউ না” মাজেদ ততোই চিৎকার করে। সে অন্ধকারে বিলীয়মান পুরুষের ছায়া দেখেছে তবে সেটা যে আরবাজ তা বোঝেনি কিন্তু সেই ছায়া দেখেই আলেয়ার চরিত্র ভালো না-ঘোষনা দিতে তার একমুহূর্ত ও দেরি হয় নি।

অনেক বকাঝকা মারধোরের পরও আলেয়া কেবল একটা কথাই বলে গেছে, আমি কোনো পুরুষ মানুষের কাছে যাই নাই,ঐহানে কেউ আছিলো না”।
কিন্তু মাজেদ সে কথা বিশ্বাস করে না।

দু একজন শুভাকাঙ্ক্ষী মাজেদকে বললো, সালিশ ডাকতে।

সালিশই ফয়সালা করে। আলেয়া যেহেতু কোনো পুরুষের নাম বলে নাই,আবার মাজেদও আলেয়াকে রাখবে না তাই তালাকই আলেয়ার শাস্তি।

৪)

সিকদার বাড়ি এখন সুনসান। উঠোনের আলো জ্বলে নি। বাড়িতে আজ ঝামেলা ছিলো বলে নিত্যদিনের রুটিনে আজ তাই ছেদ পড়েছে। কাজের লোকজন, ফসল কাটার কামলা, মাদ্রাসার ইমাম সবাই বার ঘরে বসে টিভি দেখছে। বাচ্চারাও ওখানে আজ। দূরে কোথাও মাইকে ওয়াজ হচ্ছে।
ঝুপঝুপ করে অঘ্রানের কুয়াশা মাখা বাতাস শব্দ তুলছে চাল লাগোয়া কড়ুই এর ডালে।
রান্না ঘর থেকে তরকারি পোড়ার গন্ধ আসছে। অন্যদিন এসময় আলেয়ার নিশ্বাস নেয়ার সুযোগ থাকতো না। এমন পোড়া গন্ধ পেলে বড় বউ ‘আলেয়ার কাজে মন নাই’ বলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতো। কিন্তু আজ কোথাও কোন শব্দ পাওয়া যায় না।

আলেয়ার মনে এখন কোনো ভাবনা নাই। শূন্যতা হুহু করছে বুকের ভেতর।এখন কী করণীয় বুঝতে পারছে না।

“তুমি অহনও আছো?” মালেকার মায়ের কন্ঠে চমকে ওঠে আলেয়া। মালেকার মা প্রতিদিনের মতো মাজেদের বড় বউ এর গতর টিপে ফিরে যাচ্ছিলো ।আলেয়াকে দেখে দাঁড়িয়েছে।
মালেকার মায়ের কথা শুনে আলেয়াও উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো,” কই যামু ভাবতাসি।”

“যাইতে তো অইবোই। মামার বাড়িই যাও।তারা আসে নাই তো কী! তুমি গ্যালে তো ফালায় দিবো না!….যৌবনে নিজেরে সংযত রাখতে হয়। শরীর, মন কতোকিছু চাইবো। সংযত না অইলেই বিফদ।” আলেয়াকে বোঝানোর ছলে বলে মালেকার মা। তারপর ঝট করে নিজের কৌতূহলটাও প্রকাশ করে ফেলে, “পোলাডা কেডা আছিলো?” নিচু স্বরে জানতে চায়।

আলেয়ার ঠোঁটে মৃদু ম্লান হাসি, এসেই মিলিয়ে যায়।অন্ধকারে সেটা মালেকার মা দেখে না। সে আবার প্রশ্ন করে। আলেয়া জবাব না দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে মালেকার মায়ের কন্ঠ শুনতে পায়, “ইস্ নষ্টা বেডির দেমাগ কতো।”
আলেয়া বোঝে এই গ্রামে আর থাকা যাবে না।  সিদ্ধান্ত নেয় শহরে চলে যাবে। টিভি আর সিনেমায় দেখা সামান্য অভিজ্ঞতা বাদে শহর কী, কেমন কিছুই জানা নেই । তবে এটা শুনেছে, ওখানে কাজ আছে ৷ আর আছে কাজের বিনিময়ে পয়সা।  আলেয়া মরতে চায় না, বাঁচতে চায়। ও রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে।

সামনে নিকষ রাত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।