মেহেফিল -এ- কিসসা এম উমর ফারুক (গদ্য)

বলা হলো না

এই রিকশা দাঁড়াও। জোরে ব্রেক কষলেন রিকশাওয়ালা। সামনের দিকে পড়ে যেতে ধরলেন মেয়েটি। ভ্যানিটি ব্যাগটা সামনে নিয়ে বললেন, এভাবে কেউ ব্রেক করে। আমি তো পড়ে যেতাম। রিকশাওয়ালা চুপ হয়ে ভাবছেন, জায়গা মতো দাঁড়ালেও দোষ, আবার না দাঁড়ালেও দোষ। সবি ভাগ্য।
আপনার কাছে ৫০০ টাকার খুচরা হবে?
-আপা এতো বড় নোট হইব না।
মেয়েটিকে এই রিকশার হুডের ভেতরেই কেমন একটু অস্থির মনে হলো। আমি অপেক্ষা করছি মেয়েটিকে কখন দেখতে পাবো। মেয়েটি রিকশা থেকে নেমে এলো।
তাকে দেখে বুকে ভেতর আলাদা একটি অনুভূতি নাড়া দিল। মেয়েটি পরনে সাদা রংয়ের শর্ট কামিজ। কালো রঙের টাইস জিন্স। কাজলের প্রলেপ দু’নয়নজুড়ে।
আমি ঠিক গেটটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আর রিকশা যেহেতু এই বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়েছে সেহেতু মেয়েটা এই বাড়িতেই থাকে।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটা রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি তাহলে একটু বসেন আমি ভেতর থেকে টাকা নিয়ে আসি।
ঠিক আছে ম্যাডাম যান।
তালতলার জনতা হাউজিংয়ে থাকি আমি। আমার এই এলাকাতে বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য এসেছে আমার বন্ধু লিজা। তাই আমার রুমমেট সজীব আর লিজা তিনজন মিলে বাসা খুঁজছি। ষষ্ঠ তলা বাড়িতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া হবে দেখে দাঁড়িয়েছি। ওই বাড়ির গেটের দিকে ফিরল মেয়েটি। আমার পাশ দিয়েই যাচ্ছে। আর আমার দিকে তাকাল কয়েক মুহূর্তের জন্য। হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
-এক্সকিউজ মি?
মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল।
চোখে চোখ পড়ল।
কি যেন একটা হয়ে গেল।
আমিও একটু অবাক হলাম। ভাবলাম আমি তো ডাকিনি তাকে। তবে কে ডাকল। গেটের সামনের সিঁড়ি থেকে লিজা বলল আমি ডেকেছি আপনাকে।
মেয়েটি বলল
জি বলেন?
আপনি এই বাসায় থাকেন?
মেয়েটি যেন একটু অপ্রস্তুত হলো। মুখটা ঈষৎ লাল হয়ে গেল। মনে হয় অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মেয়েটির কথা বলে ঠিক অভ্যাস নাই। তবুও জবাব দিল মেয়েটি।
-জি ! এখানে থাকি।
আসলে আমরা এই বাসাটা ভাড়া নিতে চাচ্ছি। আপনি কী বলতে পারেন বাসাটি সম্পর্কে।
হ্যাঁ বলুন কী জানতে চান।
আমরা ব্যাচেলর নই। ফ্যামিলি থাকব। বাসাটা ভাড়া নিলে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর বাসার ভাড়া কত হবে।
দেখুন এ বাড়িটির একটি ফ্ল্যাট আমাদের নিজস্ব। তাই অন্য ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া কত তা বলতে পারব না। এ জন্য কেয়ারটেকার আছে তার সঙ্গে কথা বলুন।
সরি, বিরক্ত হবেন না। আমি ভাবছিলাম আপনি জানেন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
না। ঠিক আছে, সরি বলতে হবে না।
এটা কোনো ব্যাপার না।
এরপর লিজার সঙ্গে বেশ কথা বলতে থাকে। আর আমি অপলক চাহনীতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কথা শেষ করে মেয়েটা চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর বললাম
শোন লিজা এই বাড়িতে ভাড়া নিতে হবে।
মুচকি হাসি দেয় লিজা। সজীব অট্ট হাসি দিয়ে বলল
কি রে বাসা ভাড়ার সঙ্গে অন্য কিছু ভাড়া পাওয়া যাবে না কি?
লিজা বলল শোন তোরা যাই বলিস মেয়েটা কিন্তু আসলেই সুন্দরী। আর আমার বন্ধু শাহরিয়ার যেহেতু পছন্দ করেই ফেলেছে, সেহেতু ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে।
সজীব বলল যাক, বাসা ভাড়া নিতে এসে যদি শাহরিয়ার একটা গতি হয় সেও ভালো। কতো মেয়ে তো আশপাশে থাকল কোনোদিন কাউকে মুখ ফুটে ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি। এ মেয়েকেও পারবে কি না সন্দেহ। একটু লজ্জা পেল শাহরিয়ার। এরপর তিনজন মিলেই সিদ্ধান্ত নিল এ বাসাটিই ভাড়া নেয়া হবে।
এখন কেয়ারটেকার নাই। নামাজ পড়তে গেছে। তার জন্য অপেক্ষা।
রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।
এগিয়ে শাহরিয়ার রিকশাওয়ালার কাছে।
ভাড়া কত মামা?
৩৫ টাকা।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে বলল এবার চলে যাও মামা।
রিকশাওয়ালা টাকা নিয়ে চলে গেল।
লিজা বলল
এটা কি হলো?
কিছু না।
কিছু না মানে। মন পাওয়ার জন্য ইনভেস্ট করলি।
এর পর কেয়ারটেকার পরে বাসার মালিক আন্টির সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত করা হলো।
পরের মাসে লিজারা ওই ফ্লাটে ওঠে। সজীব আর আমি সারাদিন খেটে খুটে লিজার বাসায় গুঁছিয়ে দিলাম। বিকাল বেলা নিচে নামতেই সেদিনের সেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি লিফট দিয়ে নামছিলাম। পরের তলায় নামতেই মেয়েটা লিফটে উঠে এলো। আমাকে দেখেই চমকে গেল মেয়েটি।
আমার দিকে তাকিয়ে এবার বলল
আপনারা চলে আসলেন।
আসলে আমি ঠিক আসি নাই। সেদিন যে মেয়েটা আপনার সঙ্গে কথা বলল ওরা এসেছে। আমি পাশেই জনতা হাউজিংয়ে থাকি। এই দুই গলির পরে। আমি আর লিজা এক সঙ্গে পড়ালেখা করি। এই জন্য আর কি।
লিজা?
হ্যাঁ। আমার বন্ধুটির নাম লিজা।
কেন?
মেয়েটা একটু লজ্জা পেল। মুখটা সেদিনের মতো আজও একটু লাল হয়ে রইল।
আসলে আমার নামও লিজা। আপনারা যে ফ্ল্যাটে উঠেছেন সেটা আমার ছোটা চাচির ফ্ল্যাট।
ও তাই নাকি? ভালোতো। সেদিন আপনার চাচীর সঙ্গে কথা বলার সময়ে আপনার কথাই তাহলে উনি বলছিলেন লিজা।
মেয়েটা আরও একটু লজ্জা পেল।
শুভ সময়গুলো দ্রুত চলে যায়। এ কারনে আমাদের লিফট জার্নি শেষ। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট এসে হাজির। মেজাজ খানিকটা খারাপ হয়ে গেল।
আমরা দুজনেই গেটের কাছে বের হয়ে এলাম।
বাসায় যাবেন এখন?
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম
হ্যাঁ! আপনি?
এই তো একটু সামনে যাব।
আচ্ছা দেখা হবে।
আমার যদিও যেতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে একটু হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে গেলাম। সবে তো মাত্র শুরু। এখনই যদি মেয়েটার কাছে বেহায়ার মতো আচরণ করি তাহলে সামনে গিয়ে মেয়েটা হয়তো পাত্তাই দিবে না, যা করার আস্তে আস্তে করতে হবে। মনের কল্পনাতে অনেক কিছুই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। আচ্ছা লিজাকে ভালোলাগার কথাটি কী এখনই বলে দেব? না থাক। আগে জানতে হবে তার জীবন সম্পর্কে। কেননা, তার জীবনে তো কোনো বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। কিন্তু আমার যে খুব ভালো লেগেছে। বয়ফ্রেন্ড থাকলে তো আমার চাওয়া পাওয়া দুটোই বৃথা। আবার তার বয়ফ্রেন্ড নাও থাকতে পারে। দেখি ভাগ্যে কি আছে। সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
হঠাৎ চারপাশে লোকজনের চিৎকার। তন্দ্রা ভেঙে যায় আমার। দেখি একটু দূরেই অনেক জটলা বেঁধে আছে। ওই জটলার দিকে এগোতে থাকি। কাছাকাছি যেতেই দেখি একজন অন্যজনকে বলছে মেয়েটাকে বাস চাপা দিয়েছে। মাথাটা থেঁতলে গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ নেই।
মেয়ে এক্সিডেন্ট করছে। শুনেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মানুষের জটলা ভেদ করে ভেতরে গিয়ে দেখি সেই মেয়েটি। যার সঙ্গে একটু আগে লিফটে কথা হলো। সেই লিজার নিথর দেহ পড়ে আছে পিচঢালা পথে…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।