মেহফিল-এ-সফর, হুমায়ুন কবীর ঢালী

বইয়ের সাম্রাজ্য নিউইয়র্কের স্ট্র্যান্ড বুক স্টোর

জুনের দুই তারিখ। নিউইয়র্কের আকাশে মেঘেরা উড়াউড়ি করছিল। এই নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে কোনো সময় মেঘেরা উড়ে দূরে গিয়ে সূর্য বাহাদুরকে পাঠিয়ে দেবে রোদ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। নিউইয়র্কের আবহাওয়া অভিমানী প্রিয়ার মতো। তাই বৃষ্টি আসতে পারে এই ভয়ে ঘরে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আগে থেকেই ফোনে যোগাযোগ করে জ্যাকসন হাইটস-এ সবাই জড়ো হয়েছি। কোথায় যাবো এই ভাবনা অনেক আগেই চুকে গেছে। ম্যানহাটনে যাবো। স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরে। গতবছর বন্ধু লেখক নসরত শাহ এই স্টোরের কথা বলেছিলেন।
ঢালী ভাই, স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরে গেলে আপনার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। অন্তত একবার ঘুরে আসেন স্টোরটা।
কিন্তু এমন এক সময় খবরটা পেলাম, যাওয়ার আর জো ছিল না। কারণ পরের দিনই আমার ঢাকায় ফেরার ফ্লাইট।
গতবছর সময়ের অভাবে যেতে না পারলেও এবছর মিস করতে চাই না। বন্ধু আদনান সৈয়দও জোড়ালো মতামত দিলো স্ট্র্যান্ডে যাওয়ার পক্ষে। ফলে মেঘযুক্ত বিকেলেই গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। এ যাত্রায় নালন্দা জুয়েল, সন্দেশের লুৎফর ভাই, ইত্যাদির জুয়েল ছাড়া আমাদের গাইড কাম দলনেতা আদনান সৈয়দ তো আছেই।
গাড়ি কিছুদূর এগোতেই যথারীতি বৃষ্টিকন্যা আদুরে বর্ষণে আমাদের ভিজিয়ে দিতে শুরু করল। সম্ভবত ভুল বললাম, আমাদের ঠিক নয়, আমাদের বহন করে ছুটে চলা গাড়িটাকে। যার নিয়ন্ত্রণ আদনান ভাইয়ের হাতে। আমরা আরামে বসে চাপাবাজি করছিলাম নবাব বাহাদুরদের মতো। বিকেল হলেও গোধুলিবেলার অন্ধকার চারপাশে বিরাজ করছিল। সম্ভবত আমরা ব্রুকলিন ব্রীজের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম।
 আমাদের গাড়ি যখন ব্রীজের ঠিক মধ্যখানে তখন মনে হচ্ছিল আমরা বোধহয় মেঘরাজ্যের ভেতর দিয়ে নতুন কোনো গ্রহের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। কী অপরূপ বৃষ্টিস্নাত বিকেল! প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা ব্রীজ পার হয়ে ম্যানহাটনে পৌঁছে গেছি। বৃষ্টির দাপট কমে এসেছে। অন্ধকারের মাত্রাও আগের চেয়ে অনেকটা নিচের দিকে। আমাদের গাড়ি স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরের কাছাকাছি চলে এলো। তার আগে ক্যাফে ওয়া কফি হাউজের পাশ দিয়ে আসতে আসতে আদনান সৈয়দ জানাচ্ছিল এই কফি হাউজের ইতিহাস। নোবেল লরিয়েটসহ বিশ্ব বিখ্যাত লেখকরা এখানে আড্ডা দিয়েছেন। যেমনটি কলকাতার কলেজ ষ্ট্রীটের কফিহাউজ। কফি হাউজে যেতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু সময় বড় কৃপণ। চলে যেতে জানে। মুঠোভরে দিতে জানে না।
স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরের গা ঘেষেই পার্কিংয়ের স্পেস পেয়ে গেলাম আমরা।
 ৮২৮ ব্রডওয়ের পূর্ব কর্নার ১২ স্ট্রীটে অবস্থিত স্ট্র্যান্ড বুক স্টোর। ম্যানহাটনের পূর্ব ভিলেজে যার অবস্থান। দুই ব্লক দক্ষিণেই ইউনিয়ন স্কয়ার।
গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল বুক স্টোরের বারান্দায় পুরনো বইয়ের সারি। দুই ডলার থেকে শুরু করে আট/দশ ডলারে বিখ্যাত লেখকদের সব বই। কোনটা রেখে কোনটা নেব অবস্থা। আদনান ভাই বললেন, দোকানের ভেতরে গেলে তো পাগল হয়ে যাবেন দেখছি। আগে ভেতরে চলেন।
যথাআজ্ঞা মহারাজ!
 স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম আমরা। আহ, কী মিষ্টি বইয়ের ঘ্রাণ! বইয়ের নান্দনিক সাম্রাজ্য। জীবনে আর কী চাই? বইয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে জীবনে? মানব জীবনে বইয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করে টলস্টয় বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।’
বুক স্টোরে ঢুকেই মনের উপর দিয়ে ভালোলাগার ফুরফুরে হাওয়া বয়ে গেল। ইস, না এলে কী বড় মিস হয়ে যেত। এমন দূর দেশে কি বার বার আসা যায়? কাছেপিছে হলে না হয়, কিছু মিস করলেও পরে এসে সেটা পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের কিছু মিস হলে কি আর পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে? এই ক্ষেত্রে ‘না’ জয়যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
যাহোক, ভেতরে ঢুকে কোনটা রেখে কোনটা দেখব অবস্থা। সারিসারি বই। তাকে তাকে বই। এমন কোনো বিষয় নেই যে, ওই বিষয়ে বই নেই ওখানে। তবুও চোখ মিস করলে, কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ করলে ওরা আন্তরিকতার সাথে বইটি খুঁজে দিচ্ছে। এখানে কর্মী রয়েছে ২৪০ জন। শুধু কর্মীর বহর দেখলেই অনুমান করা যায়, কত বড় স্টোর এটি।
ঘুরে ঘুরে বই দেখছি। পাতা উল্টাচ্ছি। ঘ্রাণ নিচ্ছি। প্রোডাকশন দেখছি। নানা দেশের সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সংস্কার, বাণিজ্য, খেলাধুলা, পরিবেশ, আবহাওয়া, প্রাণি… হেন বিষয় নেই যে বিষয়ের বই নেই এখানে।
আমাদের দলের কে কোথায় হারিয়ে গেছে বই দেখতে দেখতে কেউ জানি না। আমাদের সময় কম। তাই ইচ্ছে থাকলেও মনযোগ দিয়ে পছন্দের বইটা দেখতে পারছি না। আর এটা সম্ভবও নয় এক যাত্রায় পুরো স্টোরটাকে দেখা। তাই এদিক-ওদিক ঘুরে সোজা চলে গেলাম চিল্ড্রেন কর্নারে। পছন্দের অঞ্চলে। শিশুদের জন্য কত সুন্দর ও আকর্ষণীয় বই থাকতে পারে, তা না দেখলে বোঝা মশকিল। শিশু কর্নারে বই নিয়ে বুদ হয়ে আছি। নালন্দা জুয়েল এসে বলল, ঢালী ভাই ছবি তোলেন। এমন একটা বুক স্টোর। স্মৃতিটা অন্তত ছবিতে ধরে রাখি। তাই তো। আমার অবস্থা হয়েছে, পাগলা সাঁকো নাড়িস না, খুব ভালো মনে করিয়ে দিয়েছিস… অনেকটা সেরকম। সচেতন হলাম ছবি তুলতে। সেলফি, গ্রুপ, স্টোর কর্মীসহ কিছু ছবি তুললাম।
১৯২৭ সালে বেঞ্জামিন বাস নামে এক বইপ্রেমি প্রথম যাত্রা শুরু করে এই স্টোরের। পরবর্তীতে সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটিয়ে আজকের এই অবস্থা। এখন স্টোরের মালিক হিসেবে আছেন বেঞ্জামিন বাসের ছেলে-মেয়ে। ফ্রেড বাস ও ন্যান্সি বাস। ভাই-বোন দায়িত্ব নেওয়ার পরও স্টোরের প্রতিনিয়ত উন্নতি ঘটছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ অনুযায়ী স্টোরের বইয়ের সংখ্যা ২.৫ মিলিয়ন। ২০১৫ সালে এসে যোগ হয়েছে আরও অনেক বই।
এক বিকেলের যাত্রায় এই থেকে কতটা বই আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব! তাই মুভি ক্যামেরার চোখের মতো ল্যান্ডস্ক্যাপে চোখ যা ধরা পড়ছে, তাই দেখা অনেকটা। এতে মন ভালোলাগা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেও এখন মনে হচ্ছে বিষাদ ছুয়ে যাচ্ছে। ভারী হচ্ছে, পছন্দের বই দেখে কিনতে না পারায়। এক যাত্রা কত বই আর কেনা যায়!
সময় হলো বেরিয়ে যাওয়ার। আদনান সৈয়দ এতক্ষণ বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। এখন প্রায় ছুটে এলো বইয়ের অচেনা গলি থেকে। এসেই বলল, ঢালী ভাই, আপনাদের একটা ম্যাসেস দেওয়া হয় নি। জানেন কিনা জানি না। এই স্টোরেই জব করতেন আমাদের তারেক মাসুদ।
তাই নাকি!
 তথ্যটা আসলেই আমার জানা ছিল না। জেনে বিষাদে বিষাদে মন ভারি হয়ে গেল পাথরের মতো। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে অন্তত কিছু কেনা উচিত। পকেটের ওজন বুঝে বইও কিনলাম এক-দুইটা। সেই সাথে ছেলেমেয়ের জন্য কাঠপেন্সিলসহ লেখার কিছু উপকরণ। স্টোরের লগোসমেত উপহার সামগ্রী।
 আদনান সৈয়দ মন খারাপ করে দিয়েছে। এরপর আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। মনের ভেতর কষ্টের কালো মেঘ। তাই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে দেখি মনের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরো ঝরো ঝরছে…।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।