মেহফিল-এ-কিসসা নুসরাত রীপা

জীবনের পথে পথে

১)
দিনের সব হিসাব-পত্তর মেলাতে মেলাতে আতাউল আর একবার রাস্তার দিকে তাকালো। হাইওয়ে থেকে যে রাস্তাটা নেমে সোজা রাজপুর গাঁয়ের দিকে চলে গেছে সে রাস্তার ওপরই তার দি গ্রেট বেঙ্গল হোটেল। শীতের রাত। এগারোটা প্রায় বাজে। আজ আর কাস্টমার আসার সম্ভাবনা খুবই কম তবু আতাউল ডানে বাঁয়ে একবার চোখ বুলায়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো এ পথ দিয়েই আসা যাওয়া করে এবং প্রায়ই এর হেলপার ও ড্রাইভারেরা এখানে গাড়ি থামিয়ে রুটি আর ডাল খেয়ে যায়। এই রুটি আর ডাল স্পেশাল করে তৈরি এবং এর আলাদা কারিগর আছে। রুটি গুলো সাধারণের তুলনায় বড় ও পুরু আর ডালটা দু-তিন রকম ডাল মিশিয়ে ঘন ও ঝাল করে রাঁধা হয়। গরমের দিনে এ কারণেই রাত একটা- দেড়টা পর্যন্ত হোটেল খোলা রাখে আতাউল। তবে শীতকালে অন্য ব্যাপার। রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। রাস্তায় গাড়ি নামায় না চালকেরা। তবু কিছু রুটি আর ডাল রয়ে যাওয়াতে আতাউল কাস্টমার আশা করে।
কর্মচারীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। মালেক আর সাজু আছে। দোকানের সব কাজ শেষ হলে,হিসাব পত্তর মেলানোর পর দোকানের শাটার বন্ধ করে, তালা ঝুলিয়ে আতাউলের হাতে চাবি দিয়ে তবে তারা যায়। না, তখনও তারা থাকে। মধু রিক্সাওয়ালা রিক্সা নিয়ে এলে আতাউল বাড়ির পথ ধরলে তবে তারা যায়।

রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হোটেলের ভেতর তাকায় আতাউল। সাজু আর মালেক কান-মাথায় মাফলার জড়িয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আতাউল তাকাতেই সাজু বলে, আরো একটু থাকবেইন মামা?

নাহ্। আর থাকি কি হবে। আজ আর কাস্টমার আসার নয়। রুটি ডালটুকু নিয়ে যাও। স্কুল ঘরের বারান্দায় যে পাগলিটা থাকে ওকে দিয়ে দিও ।বলতে বলতে আতাউল চেয়ার ছেড়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়।

রাজপুর মফঃস্বল শহর। ডিশ,মোবাইল,ইন্টারনেট সুবিধা থাকলেও নেটওয়ার্ক বড়ই দুর্বল।ইলেক্ট্রিসিটির অবস্থা ও ভালো না। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্ট গুলো বেশিরভাগই নষ্ট। আতাউলের হোটেলের গা ঘেষে দুটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর,একটা মোটর সাইকেল সারাই এর দোকান। তারপর সামনে এগিয়ে ফটোকপির দোকান,সেলুন ইত্যাদি। রাস্তার উল্টোপাড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে সরকারি অফিসের উঁচু দেয়াল। সে দেয়ালের ধার ঘেষে কিছু ঝুপড়ি ঘর।পান-বিড়ির দোকান। সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার কর্মসূচি হিসাবে ঝুপড়ি ঘর গুলো আপাততঃ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে বাঁশ বেড়ার কঙ্কাল পড়ে আছে। এখন,শীতের এই রাত্তিরে দি গ্রেট বেঙ্গল হোটেল ছাড়া এদিকের আর সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য ফরিদের টিভি ফ্রিজ সারাই এর দোকানটা এখনো খোলা। দোকানের ভিতর থেকে লাল আলো এসে রাস্তায় পড়েছে। সেই সাথে টিভি বা মিউজিক প্লেয়ারে বাজা হিন্দি গানের অস্পষ্ট সুরও ভেসে আসছে।
দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আতাউল একটা সিগারেট ধরাতে যাবে ঠিক সেই সময়ই ল্যাম্পপোস্ট এর ম্লান আলোয় হাল্কা কুয়াশার মাঝে অস্পষ্ট এক মানব মূর্তিকে হেঁটে আসতে দেখা যায়।

আবছায়া মূর্তিটি হেঁটে আসছে। যতো কাছে আসছে ততো স্পষ্ট হচ্ছে এটা এক নারীর অবয়ব। রাজপুরের বহু ছেলে মেয়ে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।রাত বিরাতে এ এলাকায় একা কোনও মেয়েকে রাস্তায় হাঁটতে দেখাটা এখানে এখন কোন দূর্লভ দৃশ্য নয়। কিন্তু কে এটা, ভেবে আতাউল ভ্রু কুঁচকায়। সাজু শাটার টানতে শুরু করতে সে চেঁচিয়ে ওঠে, এখুনি লাগাস না।একটু থাম।

(২)
বড্ড ঝাল ডাল দিয়ে মোটা রুটি খেতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। আতাউলের নির্দেশে সাজু চা ও বানিয়ে দিয়েছে। এই রাতে হোটেলে দুধ নেই। লেবু নেই। কেবল গরম পানিতে চা পাতা সেদ্ধ করে ওতে চিনি মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অখাদ্য কী না তা পরখ করতে আতাউলও এক গ্লাস চা নিয়েছে।
মেয়েটার নাম টুসী। রাজপুরে সে এসেছে রজত এর খোঁজে।
ডালে ভেজানো এক টুকরো রুটি দীর্ঘ সময় ধরে চিবিয়ে নিয়ে ওটা একচুমুক চা দিয়ে গিলে নিলো টুসী। দরজার একপাশে সাজু আর মালেক বসে আছে। মনে মনে ওরা বিরক্ত। শীতের রাত,এখন বাসায় গিয়ে লেপ কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমানোর সময়। আর কোথা থেকে উটকো ঝামেলা এসে হাজির!
মনে মনে বিরক্ত হলেও তার প্রকাশ নেই তাদের মধ্যে।কারণ আতাউল কে ভালো করেই জানে তারা। যা করতে চায়,তাই সে করে।
কালো,হালকা পাতলা গড়ণের শরীর। মাথার কোঁকড়ানো চুল ঈষৎ ফিকে হয়ে আসছে। শ্যামল কঠিন মুখটার কোথায় যেন একটা মায়া ছড়ানো।সারাদিন হোটেলের ক্যাশে বসে থাকায় এই বয়সেই একটু ভুড়ি গজিয়েছে। তবে দেখতে যাই হোক সে হলো এক কথার মানুষ। একই সাথে জেদি এবং কোমল হৃদয় তার। টুসী নামের মেয়েটা যখন হোটেলটার সামনে তিনজন পুরুষমানুষকে দেখতে পায় তখন সে ভীষণই ভয় খেয়ে গিয়েছিলো।
অচেনা জায়গা,শীতের প্রায় মধ্য রাত। সে একটু দূরে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিলো। সে সময় আতাউলই কথা বলে উঠেছিলো। কে আপনি? আসেন এদিক্। ভয় নাই।আমি এ হোটেলের মালিক। এরা আমার কর্মচারি।
মেয়েটা এগিয়ে এসেছিলো। হোটেলের আলোয় মেয়েটাকে হালকা এক নজর দেখেই আতাউল বুঝে গিয়েছিলো ভদ্র বাড়ির শিক্ষিত মেয়ে। তবে এ গ্রামের নয়। মেয়েটার প্রথম কথাই ছিলো,আপনার হোটেল কি বন্ধ হয়ে গেছে? প্রায় পনেরো ঘন্টা খাইনি। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
অতঃপর আতাউল মেয়েটিকে ভেতরে এনে বসায়। খাওয়ার বন্দোবস্ত করে। মেয়েটি হাত মুখ ধুতে চাইলে আতাউল একটু অস্বস্তিতে পড়ে। তার এখানে বেশির ভাগই খুব সাধারণ লোকজন বা এলাকার মানুষ আসে। ওয়াশরুম তেমন ব্যবহৃত হয় না। হোটেলের বাইরে লাগানো সিরামিকের বেসিনটাতেই লোকজন হাত মুখ ধুয়ে নেয়। আতাউল মনে মনে ঠিক করে ওয়াশরুমটা নতুন করে সাজাতে হবে।

খেতে খেতেই মেয়েটা কথা বলে। ঢাকায় থাকে। দুই মাস হলো মাস্টার্স এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। রজত নামে একটা ছেলের খোঁজে এতদূর আসা। ছেলেটা একটা ওষুধ কোম্পানীতে চাকরি করতো।

করতো মানে? আতাউল প্রশ্ন করে।

টুসী বলে,মানে গত সপ্তাহে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা আমি জানি না।

রজত মেয়েটির কে হয় একথা সে মুখে না বললেও আতাউল আন্দাজ করে নেয়।

মেয়েটি বলে,রজতকে ফোনে পাচ্ছি না। শেষে বাসায় কাউকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে এলাম। ওর বাড়িতে যাবো। অন্তত যোগাযোগ করছে না কেন সেটা জানতে।

কেন যোগাযোগ করছে না সেটা আপনি বুঝছেন না?

আতাউলের প্রশ্নে মেয়েটা চুপ করে থাকে।

আতাউল প্রসঙ্গ ঘোরায়। খেতে কষ্ট হচ্ছে,না? যা হোক পেটে কিছু দেন। এত রাতে আপনি কই যাবেন?

বাস এতো লেট করবে বুঝতে পারি নাই। মেয়েটা রুটির টুকরো দলা পাকাতে থাকে। ভেবেছিলাম দিনে এসে পৌঁছাবো।
এখন এই রাতটা কোথায় কাটাবে ভেবে সে উৎকন্ঠিত হয়। একটা আবাসিক হোটেল কি আছে আশে পাশে? জানতে চায়।
আতাউল বলে,যদি কিছু মনে না করেন আপনি আমার সাথে আমার বাসায় যেতে পারেন। রাত টা কাটিয়ে সকালে আপনার কাজে বের হবেন। অবশ্য যাবেন কী না সেটা আপনার ইচ্ছে।

টুসী বলে, যাবো। এতো রাতে নইলে আর কই থাকবো।

আতাউল চিৎকার করে সাজুকে বলে,মধু রে বল চলে যেতে। আমি হেঁটে বাসায় যাবো।

(৩)
পূর্ণিমা তিথি। শীতের রাত হলেও কুয়াশা চাঁদটাকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে নি। নরম ঝাপসা একটা আলো লেপ্টে আছে প্রান্তর জুড়ে। দু’পাশে ফসলের ক্ষেতের মাঝখান চিরে ইট বসানো পথ ধরে ওরা হাঁটছে। চারিদিকে থই থই নির্জনতায় কে বলবে দিনের বেলা এ রাস্তা ধরেই লোকজন বাজারে যায়, স্কুল কলেজ যায়, শহরে যায়। এরাস্তায়,রিক্সা,ভ্যান,সাইকেল চলে।
হোটেলের সাটার লাগিয়ে আতাউলের হাতে চাবি দিয়ে সাজু আর মালেক চলে গেছে। আতাউলের বাসা হোটেল থেকে রিক্সায় মিনিট কুড়ি লাগে।হাঁটতে হাঁটতে আতাউল বলে,রিক্সা বিদায় দিলাম,আমার মতো অপরিচিত কারো সাথে রিক্সায় উঠবেন না সন্দেহে।
টুসী বলে,ভালো করেছেন। হাঁটতে বেশ লাগছে।
আপনার তো ক্ষিদা আছে, বাসায় গিয়ে ভাত খাবেন তো?
না,না আমি আর কিছু খাবো না। একটু রেস্ট নিতে পারলেই হয়। জীবনে এতো পথ জার্নি করি নাই। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
টুসীর কথায় আতাউল একটু আস্বস্ত হয়।এত রাতে বাসায় কে আয়োজন করবে ভেবে মনে উদ্বিগ্ন ছিলো।

টুসী একটু চুপ থেকে বলে,আসলে এভাবে অচেনা জায়গায় চলে আসাটাও আমার ঠিক হয় নি।

আতাউল সে কথার উত্তর দেয় না। বলে,একটু সাবধানে হাঁটেন। ইটের রাস্তা, উঁচু নীচু কোথাও হোঁচট খেতে পারেন।

শীতের রাত হলেও, পরণে ভারি গরম কাপড় থাকায় ঠান্ডাটা ওদের কারোই খারাপ লাগছিলো না। বরং ফসলি খেতের,শুকনো খড়ের,ঝরা পাতার গন্ধ মাখা হাওয়ার স্পর্শটা কেমন যেন ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।
আগে কখনো এভাবে শীতের রাতে গ্রামের পথে হাঁটেনি টুসী। পাশে অপরিচিত পুরুষ। অথচ ভয়ের বদলে ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে পড়েছিলো ও। রজতের কথা, এখানে আসার কথা সব মন থেকে উধাও যেন।মনের অজান্তেই টুসী একটা গান গুন গুন করতে শুরু করলো। রাতের নির্জনতায় সেই মৃদু সুর অদ্ভূত এক মোহময় আবেশ ছড়িয়ে দিলো।
গানের সুরে নিমগ্ন হয়ে দুজন অপরিচিত মানুষ অনেকদিনের পরিচিতের মতো পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।
গান একদম শেষ না করে টুসী হঠাৎ থেমে গেলো। তারপর লাজুক গলায় বললো, বড্ড বেসুরো গাইলাম।হিহি!!

আতাউল নিজেও গান জানে। বললো তা কেন! বেশ লাগছিলো শুনতে।সে গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। তার কথা বলার ভঙ্গীটি ভারী মিষ্টি। টুসীরও আতাউলের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিলো।কথায় কথায় কখন যে বাড়ির দরজায় চলে এসেছে টেরই পায় না ওরা।
আতাউল ঘড়ি দেখে। সোয়া একটার কিছু ওপরে বাজে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
মস্তবড় উঠানের দুইপাশ জুড়ে বিল্ডিং। সামনে লম্বা টানা বারান্দা। বারান্দার এক পাশ দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। আতাউল টুসীকে নিয়ে দোতলায় উঠে আসে। বিশাল ছাদের একপাশে দুটো ঘর। আতাউল একটা ঘরের তালা খুলতে খুলতে বলে,আমি এখানে থাকি। এটা আমার ঘর। আপনি রাতে এখানে ঘুমাবেন। আমদের গ্রাম-গঞ্জে কারো বাসায় গেস্ট রুম কিছু থাকে না। বাসায় বেশ কটা ঘরই খালি আছে। কিন্তু লোকজন থাকে না। তাই তেমন পরিষ্কার নয়। হঠাৎ একটা বন্ধ ঘর খুলে দিলেও থাকতে পারবেন না। মশা পোকামাকড় ঝামেলা করবে।
বলতে বলতে ঘরের আলো জ্বালে আতাউল। ভেতরে আসেন,দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে টুসীকে ভেতরে ডাকে। টুসী ভেতরে ঢুকবে কী না একটু ইতঃস্তত করে। আতাউল হেসে ফেলে। ভয় পাচ্ছেন? তাইলে আসার দরকার নাই। আপনি ছাদে হাঁটাহাটি করেন। ঐ যে দেখেন টবে একটা গন্ধরাজ গাছ আছে।পুরো ছাদে ঐ একটাই গাছ। কেন জানেন?
বলতে বলতে আতাউল টুসীর পাশে এসে দাঁড়ায়।
টুসী অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে, কেন?
আতাউল বলে, পরীদের জন্য।
যাহ্। মিছে কথা।
মোটেই মিছে নয়। সত্যি। দেখছেন না ছাদটা কতো বড়। এখানে মাঝে মধ্যেই জ্বীন পরীরা এসে বিশ্রাম নেয়।
টুসীর ভূত প্রেতে তেমন ভয় নেই। ও পুরো ছাদটায় দৃষ্টি বোলায়। ছাদটা অনেক বড়। এক প্রান্তে কি একটা গাছ ছাদের ওপর বেশ অনেকটুকু ঝুঁকে একটা গাঢ় ঝাঁকড়া অন্ধকার সৃষ্টি করেছে। মধ্যরাতে, কুয়াশায় ঢাকা রহস্যময় আকাশের নীচে সে অন্ধকার বুকে একটু কাঁপন তোলে বৈ কি। আর তা ছাড়া গ্রাম-গঞ্জের ব্যাপার। অনেক রকম ঘটনা তো না শোনা নয়!

টুসী আতাউল কে বলে, চলেন ভেতরে যাই।
দুজনে ঘরে আসে। সাদা আলোয় টুসী ঘরের ভেতর চোখ বোলায়। বই পত্তর,কাপড় – চোপড়ে তুলকালাম। অগেছালোর চূড়ান্ত। বিছানার ওপর শার্ট লুঙ্গি পড়ে আছে। আতাউল সে গুলো দ্রুত হাতে তুলে নিতে নিতে নিজে নিজেই বলে, কয়দিন ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে। গোছগাছের সময় পাচ্ছি না। তারপর দরজার সামনে গিয়ে বলে, রাত প্রায় দুটা বাজে। আমি তো ছয়টায় বেরিয়ে যাই। বাসায় বলা থাকবে। আপনি নাস্তা করে বের হবেন। আর প্রয়োজন হলে বাসার কাউকে বলবেন,আমাকে ডেকে দেবে।
এবার দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর হা, ঐ পাশে বাথরুম আছে।
আতাউল বের হয়ে যায়। নীচে বসবার ঘরে রাতটা কাটিয়ে দিবে ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে।

(৪)
ঘরটা বিশাল। একপাশে একটা ছোট্ট তেপায়ার ওপর একটা টিভি। পাশে একটা পানির জগ,গ্লাস। ঘরের একদিকে চওড়া জানালা,খোলা। সরষে রঙা পর্দা গোটানো। জানলার বাইরে অন্ধকার ঝুলে আছে। সেই দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যায় টুসী।

বসবার ঘরে একটা বিছানা পাতা আছে। আতাউলের বাবা দিনের বেলা এ বিছানাতেই বিশ্রাম নেন। আতাউল উঠোনের কোণের চাপাকল থেকে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমানো প্রয়োজন।
কিন্তু চোখ বুজতে গিয়েও মোবাইলটা অন করে। ফেসবুক এ গিয়ে টুসী নামে সার্চ দিতে থাকে। অনেকগুলো টুসী আসে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাসার দোতলায় ঘুমাতে রেখে আসা আগন্তুক টুসীকে পাওয়া যায় না। সার্চ দিতে দিতে ক্লান্ত আতাউল আপন মনেই মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,কী বোকা আমি! হয়তো মেয়েটা অন্য নামে আইডি খুলেছে।আর আমি —!!– ওর ফেসবুক আইডির দরকারই বা কি আমার !
ফোনটা বালিশের পাশে রেখে পাশ ফিরে শোয় সে।

আতাউল চলে যাবার পর টুসী অনেক ক্ষণ চুপ করে বসে রজতের কথা ভাবছিলো। রজতের সুন্দর মুখশ্রী ও সুমিষ্ট বচনে ও এতোটাই বিমোহিত হয়েছিলো যে,তার সম্পর্কে কোন কিছু জানার কথা মনেই হয় নি কোনদিন। এ গ্রামের নামটা কথায় কথায় একদিন রজত বলেছিলো। তার বাড়ির ঠিকানা বা কে কে আছে অথবা আর কোন ভাই বোনের নাম কিছুই জানা নেই টুসীর। কি সূত্র হাতে নিয়ে রজতকে খুঁজবে টুসী? গ্রামে লোকদের কাছে গিয়ে জনে জনে জিজ্ঞেস করবে রজতকে চেনে কি না?
পরিবারের লোকদের কাছে নিঃসন্দেহ থাকতে নিজের স্মার্ট ফোনে রজতের একটা ছবিও সেভ করে রাখেনি । এসব চিন্তার পর টুসী একটা সিদ্ধান্তেই এসেছে ও আর রজতের খোঁজ করবে না। সকাল হলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।বাসার সবাই নিশ্চয়ই ভাবছে। টেনশন করছে। পুলিশে খবর দেওয়াও অসম্ভব নয়। বাসাতে ফিরে যাবে ও। তার আগে অবশ্য বাসা থেকে না বলে বেরোবার একটা কারণও বানাতে হবে।

টুসীর ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করে। প্রচন্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা আসছে। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে বিছানার কোণে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। একসময় আর শুয়ে থাকতে পারে না। ওর মনে হয় এখুনি মনের ইচ্ছাটা কারো সাথে শেয়ার করা উচিত। মোবাইলে বন্ধুবান্ধবদের নাম গুলো এক এক করে দেখে। কিন্তু কারোকেই নিজের মনের কথাগুলো বলার উপযুক্ত মনে হয় না। তারচে’ সদ্য পরিচিত,একদম অচেনা এক গ্রাম্য হোটেলের মালিক আতাউলকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়। মনে হয় এই লোকটার সাথে নিজের সিদ্ধান্তটা শেয়ার করা যেতে পারে।

ঘুম কিছুটা গাঢ় হয়েছিলো বুঝি। দরজাতে ধাক্কা শুনে তা টুটে গেলো। আতাউল ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখে টুসী দাঁড়িয়ে। আতাউলের বিস্ময় দৃষ্টিকে লক্ষ্য না করে টুসী ঘরে ঢুকে বসতে বসতে বলে, আমি ঠিক করেছি আমি আর রজতকে খুঁজবো না। আপনি সকালে হোটেলে যাবার আগে আমাকে একটু বাসে তুলে দিবেন, প্লিজ।

আতাউল বিরক্ত হয়ে বলে,সকাল হতে তো আরো দেরি। আপনি নাস্তা খাওয়ার সময়ও কথাটা বলতে পারতেন।

আমি নাস্তা খাবো না। তার আগেই যাবো।

সে তো হবে না। গেরস্থ বাড়ি থেকে সকাল বেলা কাউকে না খেয়ে বেরোতে দেওয়া হয় না।

ছিঃ! ছিঃ! তুমি শেষ পর্যন্ত ঘরে মেয়ে নিয়ে এসেছো– নারী কন্ঠের ছিছিক্কারে আতাউল এবং টুসী দুজনেই চমকে ওঠে। দরজার সামনে আতাউলের স্ত্রী নাঈমা দাঁড়িয়ে আছে। এলো চুল, ঘুম ভাঙা চোখে রাগ জ্বলছে।

আতাউল আর নাঈমার প্রেমের বিয়ে।পরস্পরকে চোখে হারায়। আবার মাসে তিন চারবার ঝগড়া হয় ওদের। আর সে সময় নাঈমা আতাউলকে ঘরে ঢুকতে দেয় না। আতাউল তখন দোতলার ঘরে শোয়। আজ তিনচারদিন সেইরকম ঝগড়া-কাল চলছিলো। ঝগড়া চলাকালীন আতাউল কে বিব্রত করার চেষ্টায় থাকে নাঈমা। মূল উদ্দেশ্য স্বামীকে চাপে রাখা। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর বাগানে যাওয়ার জন্য উঠানে নেমে হঠাৎ বসারঘর খোলা দেখে এগিয়ে এসে আতাউল আর টুসীকে গল্পরত দেখতে পেয়ে সে ধরেই নিয়েছে টুসী আতাউলের প্রেমিকা। নাঈমার থেকে দূরে থাকার সুযোগে প্রেমিকাকে ঘরে নিয়ে এসেছে আতাউল।

নাঈমার রাগের কারণ বুঝে আতাউল তাকে বোঝাতে থাকে, টুসী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। একরাতের অতিথি মাত্র। ঝগড়ার কারণ বুঝে টুসী হতভম্ব হয়ে পড়ে। ও বিব্রত কন্ঠে বলে সরি,আপু আপনি আমার কথা শুনুন।

কিন্তু কোন কথাই শোনে না নাঈমা রাগী কন্ঠে আতাউলকে বকা দিতে দিতে বেরিয়ে যায়। আতাউলও নাঈমার পেছন পেছন ঘর ছাড়ে।

টুসী কিছুক্ষণ কী করবে বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে থাকে। ইস ওর জন্য একটা সংসারে ঝগড়া বেঁধে গেলো! নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগতে থাকে।সকাল সাড়ে ছয়টা বাজে। কিন্তু গাঢ় কুঁ?কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু তাই বলে এ বাসায় বসে থাকাটাও ভালো লাগে না।

ব্যাগটা হাতে তুলে কুয়াশার মধ্যেই রাস্তায় নেমে পড়ে টুসী।

(৫)
হোটেলে এসেই বাস স্টপেজে টুসীর খোঁজে সাজুকে পাঠিয়েছিলো আতাউল। সাজু টুসীর দেখা পায় নি।

ক্যাশ কাউন্টারে বসে কাস্টমারের কাছে থেকে পেমেন্ট বুঝে নিতে নিতে আতাউল ভাবে টুসীর সাথে এই জীবনে আর কোনদিনই হয়তো দেখা হবে না। পৃথিবীতে একজীবনে ক্ষণিকের জন্য কতো মানুষের সাথেই না পরিচয় হয়। যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু স্মৃতিতে ঠিকই থেকে যায়।

(এ গল্পের চরিত্র ও কাহিনী পুরোটাই কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।