মেহফিল -এ- কিসসা ধারাবাহিকে মৃদুল মাহবুব

ভাষা ও সাহিত্য – ৩

৬.

ইয়েটসের একটা লাইন আছে Ô in dreams begin responsibility.Õ’ ভাবি এমন একটা লাইন লেখার পর মরে যাওয়া যেতে পারে।
এর সাথে সাথে আরো দুটো কবিতা পড়ব।
ভাষার কাছে চিন্তা কীভাবে পরাজিত হয়! জীবনানন্দের ‘ইহাদের কানে’ পড়ি আসেন।এই সকল অতি পুরুষবাদী কবিতা বছরের পর বছর ভালো কবিতা হিসেবে সাধারণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কবিতা নিয়ে বোদ্ধারা কী ভাবে সে সমস্তের তেমন একটা দাম নেই আমার কাছে। কারণ তাদের অধিকাংশ চিন্তাই অপর দ্বারা প্রভাবিত, আরোপিত। নানা জনের দেড়-দুই লক্ষ শব্দের গদ্য পড়ে পাঁচ ছয় হাজার শব্দের গদ্য লিখবে। এর মধ্যে বেশির ভাগের নিজের কথা বলে কিছু নেই।তার যদি লক্ষ লক্ষ শব্দ পড়ে বিশ-ত্রিশ লাইনে একটা সামারি লিখতে পারত তবে কাজের কাজ হতো। বাদ থাক তাদের কথা। আসুন কবিতা পড়ি।
‘একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে একবার বেদনার পানে
অনেক কবিতা লিখে চলে গেল যুবকের দল;
পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা এইসব বধির নিশ্চল
সোনার পিঙ্গল মূর্তি : তবু, আহা, ইহাদেরি কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল :
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে একবার বেদনার পানে।’
সোনার পিঙ্গল মূর্তি হলো আধুনিক কালের গালি। নারীটিকে এই সাধুপুরুষ গালিগালাজ করেছেন কেমন ভদ্রভাবে।প্লাটিনাম পিঙ্গলমূর্তি পুরুষের কান তা শুনছে না। শোনার কথাও না। ফালতু টাইপের হাহাকার, হ্যাংলামি, আনস্মার্টনেসে ভরা জীবনানন্দের নারী বোধ। জীবনানন্দ তো ইউরোপের জারণ, তার বহু কিছু ধার করা।ধরা যায়, তার সময়ের নারীবাদী চিন্তার সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। তবে কি ভারত সমাজে নারীদের যেভাবে দেখা হয় সেই ভাবে দেখে কালোনিয়াল চিন্তার বাইরে যেতে চেয়েছেন। মনে হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে কবিতা কি দর্শন? কবিকে সে দায় কেন নিতে হবে। সেকথা আগামীতে লেখা যাবে। আগে জীবনানন্দের চিন্তার উচ্চতাকে মাপ দিই।
জীবনানন্দ তার কবিতায় ইউরোপের প্রকরণটা গ্রহণ করেছেন মাত্র।তাদের চিন্তা থেকে তিনি বহুদূর দিয়ে গেছেন।
আসেন, কাজী নজরুল ইসলামের আরো একটা কবিতার অংশ পড়ি :
‘সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণ কর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেকতার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
কাকে আপনার চিন্তায় আধুনিকতম লাগে? কাকে আপনার প্রয়োজনীয় লাগে? সাহিত্য মানে যে ভাষা, প্রকাশ, প্রকরণ গত কারণে জীবনানন্দ আপনার আমার কাছে বড় কবি। এর কারণ আপনি জীবনানন্দ বড় কবি শুনে শুনে সাহিত্য করা শিখেছেন।কানফার্মেশন বায়সনেস কাজ করছে আপনার।আপনি জীবনানন্দের ওপর যা যা পড়ছেন তা আপনার তাকে বড় কবি হিসেবে দেখতে চাওয়াটাকে আরো বেশি ভ্যালিড করছে। কিন্তু ভাষা নতুনত্বই নতুন কবিতা না। চিন্তার প্রকাশও কবিতা।ভাষার কারণে জীবনানন্দ বেদিতে ফুল আর ফুল। জীবনানন্দের কবিতায় চিন্তা নাজুক, হালকা।দৃশ্যের পর দৃশ্যই যদি সত্য হয় তবে আর বলার কী আছে! ইমেজে বাঁচুন আপনি।
বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম ‘পোলাকবি’টিকে শুদ্ধতর বলা হয়, তার কারণ কবিতাকে চিন্তা থেকে বিযুক্ত করার ফলাফল হিসেবে। এগুলো নিয়ে একটু ভাবা যায় এখন।
এমন বহু বহু ছোট চিন্তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের বড় কবি জীবনানন্দ। ব্যবহারিক ভাবে এগুলো অকেজো এই কালে।

৭.

কবিতায় চিন্তার ধারাবাহিকতা আমরা নষ্ট করে দিয়েছি ত্রিশের ভুল ব্যাখ্যায়। শিল্প কোনো শ্রেষ্ঠত্ব হয় না।পরপস্পর বিরোধী নানা ধারার স্রোতে তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ত্রিশকে আমরা ওয়েট দিয়েছি অধিক বেশি। কবিতার নানা বৈচিত্র্যকে তারা রহিত করছে। রবীন্দ্র বিরোধিতা ও ম্যানিফেস্টো মূলক কবিতার চর্চা শেষ পর্যন্ত শিল্পের নানা পথকে অল্প কিছু সম্ভাবনার সাথে সাথে অবরুদ্ধ করে। বাংলা কবিতাকে বহু কিছু বর্জনের ভেতর দিয়ে ত্রিশের কবিতা হয়ে উঠতে হয়েছে। ফলে ত্রিশের শক্তিটা সংঘবদ্ধ। ব্যতিক্রম জীবনানন্দ। এছাড়া ব্যক্তির বিশালত্ব অতটা না। জীবনানন্দ কাল্ট হয়ে উঠতে পেরেছেন সময়ের প্রেক্ষিতে।অথচ ত্রিশের মেধাবীদের অস্বীকার করার মতো মেধা বাংলা ভাষায় তারপর আর আসেনি।আজ অব্দি ত্রিশে মাত্র একজন কবি গ্রেট হয়ে আছেন অনেক দিন। কীভাবে? প্রতিভা সংকট।আমাদের পূর্বসূরিদের
তৈরীকৃত পথটাকে অস্বীকার করতে না পারার ভুল বিচার বাংলা কবিতার ক্ষতি করেছে আমি বলব। জীবনানন্দের চিন্তাহীন ভাষা কীভাবে পঞ্চাশ-ষাট বছর রাজত্ব করে আমি বুঝিনা। আমরা চিত্র রূপময়, নির্জনতার কবিকে বছরের পর বছর তার সঠিক মূল্যায়ন ছাড়াই মাথায় তুলে রাখলাম।বাংলা কবিতার ভাষা জীবনানন্দের ভাষা থেকে খুব বেশি আগ্রসর হয়নি। কারণ কী? জীবনানন্দের কবিতায় দুনিয়ার আধুনিকতম চিন্তার সংযুক্তি কম। তিনি যেই সময়ের কবি সেই সময়ে দুনিয়ায় চিন্তার জগতে বড় বড় বিপ্লব হয়ে গেছে।কিন্তু তার কবিতায় না আছে পশ্চিম, না আছে পূর্বচিন্তার সঠিক গতিপথ। পূর্বটা মাপতে হলে রবীন্দ্রনাথকে সাথে রাখতে হবে।তিনি ইউরোপ বাহিত বাংলা ভাষার কবি, কিন্তু তার চিন্তার নির্যাসটা নেই। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বৈচিত্র্যের তুলনায় জীবনানন্দের ভাবনাকে অনেক গরিব লাগে। নজরুলের হৃদয়েও আনন্দ আছে, জীবনানন্দ হাহাকারময়। জসীমউদ্দীনে গ্রাম্য ব্যথাট্যথা আছে, এটাতেই তিনি বেটার। নজরুল যতটা জনসংযুক্ত, জীবনানন্দ ততটাই বিচ্ছিন্ন।এই সহজ ভাষা নির্ভর ইমেজের জয়ের মধ্য দিয়ে কবিতায় চিন্তার একটা বড় পরাজয় ঘটে গেছে।আমরা মেনেও নিয়েছি।ফলে এই সময়ের দুর্দান্ত বড় কবি উৎপল কুমার বসু ও জীবনানন্দ সৃষ্ট ইমেজের বাইরে যেতে পারেন নি। তিনি জীবনানন্দের ভাষা ও ইমেজের শেষ এক্সটেনশন।শেষদিকে উৎপল এই সমস্ত থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। তার শেষদিকের বইগুলো পড়লে এটা ধরা যায়। তিনি আরো বেশি সুর আর উইট মেশাতে চেয়েছেন কবিতায়।শুধু ইমেজ আর ভাষার দিন শেষ এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কবিতায় চিন্তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।বাংলা কবিতার ইতিহাস চিন্তারই ইতিহাস। কবিতা জনমানুষের চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত। কবিতা যে শুধু ভাষার চর্চা না তা অনেকেই উপলব্ধি করেছে।শিল্প একটা ব্যবহারিক বিষয়। কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ বা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ কি শুধু শিল্প? এর কোনো ব্যবহারিক উদ্দেশ্য নেই?

৮.

মহাকালের সাহিত্য করার বাসনা নিয়ে যারা আছেন, তাদের জন্য জীবনানন্দ কোনো উদাহরণ না, বরং এক্সেপশন।সাহিত্য সমকালের জন্যই করতে হয়। জীবদ্দশায় তিনি কোনো ভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন না। সেই সময় রেডিওতে কয়জন কবিতা পড়তে যেতো? লাবণ্য দাসের স্মৃতিকথায় এগুলো পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসু কাদের কবিতা ছাপতেন? ফলে, জীবনানন্দকে তার সমকালে যতটা অগুরুত্বপূর্ণ করে দেখানো হয় তিনি ততটা গুরত্বহীন ছিলো না। গরীবের শিল্প সাহিত্যের বিচারে কে কী চাকুরী করে, কত ইনকাম ইত্যাদির একটা হিসাব বহুদিন হলো চলে আসছে। ফলে, বৈষয়িক ও পারিবারিক জীবনে ব্যর্থতা দিয়েও জীবনানন্দের কবিতার সাফল্য মাপা হয়েছে। অনেক কিছু খুব নিরপেক্ষ ভাবে দেখা দরকার।

৯.

সবসময় নতুন, ভিন্নতর কবিতা লেখার দরকার নেই। কবিতা লেখার প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগ ভিন্ন ভিন্ন।কবিসমাজ জীবনানন্দের কবিতা দ্বারা বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি তৈরিতে কবির কোনো ভূমিকা নেই। সকলই বোদ্ধা কর্তৃক সৃষ্টিকৃত।কবিতা লিখতে এসে আপনি প্রথমেই যে সূত্র শিখেছেন তা হলো আপনাকে আলাদা কবিতা লিখতে হবে। এমন ভাষা আপনার চাই, যা অভিনব। তথাকথিত বোদ্ধা ও সমালোচকদের এই সমস্ত ভিন্নতর চাহিদা আপনাকে কবিতাই লিখতে দেবে না সারাটি জীবন।সমালোচকদের কোনো রকম কবিতা লিখতে না পারার ফলাফল হলো তাদের অতি ভিন্ন কবিতার প্রত্যাশা।কবিতা তাই, যা অনুভূতি তৈরি করে। দুনিয়ার এক্সেটেনশন তৈরি করে। দেখার নতুন বোধ সৃষ্টি করে। প্রপোরশন আর শিল্পাঙ্ক মেপে মেপে কবিতা হয় না। অন্যরকম কবিতার প্রতি অতি দুর্বলতা কবিতা লিখতে না দেওয়ার ফাঁদ।অতি ভিন্ন কবিতার চেষ্টা আর কসরৎ করতে করতে আপনি আপনার মূল ফোকাস সরিয়ে ফেলেছেন।ভিন্ন রকম কবিতার দরকার আছে তবে তা কবিতা করে তোলার জন্য অবধারিত কিছু না।এই যে নতুন কবিতা মানেই আলাদা ট্রেন্ড ভাঙা কবিতা তার উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ বাদে আপনি কাকে দাঁড় করাতে পারবেন! যে কোনো ভাষায় একই প্রকরণের দুই-তিনজনের বেশি কবি থাকে না।প্রতি একশ বছরে কেউ কেউ ভিন্ন ভাষা পাবে যখন মূল ভাষাটা অনেক বদলে যাবে আগের ভাষা থেকে। ভাষা যৌথ ভাবে পরিবর্তন হয়।সেই পরিবর্তিত ভাষায় আবার অতি নতুন ভাষার কবির জন্ম হয়। বড় বড় কবিরা নতুন ভাষা তৈরি না করেই বড় কবি।আলমাহমুদ বা জয় গোস্বামীর ভাষা চিরায়ত, তাদের টেকনিক অ্যাজ ইউজ্যুাল। তবে? জীবনানন্দের পর নতুন ভাষার কবিতা মাত্র উৎপলের কলমের নিচে। এর মাঝখানে যা কিছু বড় সৃষ্টি, মহৎ কবিতা তা খুব ট্র্যাডিশনাল। ভেবে দেখবেন। বাংলা ভাষার শেষ আধুনিকতম কবি আল মাহমুদ নতুন কোন ভাষা লিখতে আসেন নাই কবিতায়। তার ভাষা ট্রেডিশনাল, গড়পড়তা। তবে তিনি তাই কবিতা করে তুলতে পেরেছেন। এটাই তাদের বড়ত্ব। সেই কারণে কবিতা মানে শুধু নতুর নতুন শব্দ জট, প্রকাশ পদ্ধতি, ইমেজ বা ব্যাকরণ না।৭০ বা ৮০ কবিতাকে রাজনৈতিক আপ্তবাক্য বলে খারিজ করার পদ্ধতির ও চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে আমি খুব ক্রিটিক্যালি দেখি। কেননা সময়ই নির্ধারণ করে কবিতায় কী লেখা হবে এবং কীভাবে। ৭০ বা ৮০-র মতো ব্যবহারিক কবিতা বাংলা ভাষায় এর আগে লেখা হয়নি। শিল্প-সাহিত্য একটা ব্যবহারিক জিনিস।ব্যবহারিক কবিতা, কবিতার একটা প্রকরণ এটাও ভুললে চলবে না।

১০.

বাংলা কবিতার মুক্তি হলো ভাষা সংগ্রামের বাইরে যাওয়া।জীবনানন্দমূলক যে কবিতা শিক্ষা কার্যক্রম কবিতা স্কুলে বিদ্যমান তা থেকে বের হয়ে নিজের সময়ের কবিতাটি লিখতে হবে। জীবনানন্দ অনুপ্রেরণা হোক, অনুকরণীয় যেন না হয়ে ওঠে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।