পেশা শিক্ষকতা। অরণী বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
প্রকাশিত হয়েছে এই পৃথিবী এই দেশ ও নিভৃত পরবাস নামে দুটি কবিতার বই। টাইমমেশিন ও গুপ্তহত্যা অতঃপর নামে দুটি বড় গল্পের বই।
মূলত উপন্যাস লিখছেন। বর্তমানে ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন।
ঢাকায় বসবাস করেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা “আনন্দ ভৈরবী”
পর্ব – ৬
পদ্য বাউল প্রোডাকশনটির সবগুলো কবিতাই সকলকে পড়তে হয়েছিল নিবিষ্ট মনে। রিহার্সেলের কল থাকতো সকাল ১০ টায়। আমরা সকাল সাড়ে নটা পৌণে দশটায় পৌঁছাতাম টি এস সিতে। শুরু হতো পড়া। সবগুলো কবিতা একটা একটা করে শুধু রিডিং পড়া হতো প্রথমে। কার ভয়েজে কোনো কবিতাটি কতটা যায়। কোন কবিতা কার কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে। এসব দেখা হতো। তারপর যার যার কবিতা সিলেক্ট করবার পর শুরু হতো নির্মাণ।কবিতাটি প্রথম পড়ি আর প্রথম লাইনটি শুনবার সাথে সাথে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে ২২ বছর ধরেও আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি তার
-আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এই একটি লাইন কতভাবে যে মনের ভেতর আলোড়ণ তুলতো তা কেবল আমিই জানি। কি অর্থ এর! কি আছে এই শব্দকতকের আড়ালে! যদি তার সাথে কথা বলা যেত! কাকে লিখেছেন কবি! কাকে এঁকেছেন! কি লিখেছেন! কি বলেছেন! কি অসাধারণ এক নতুন ভাষা…। একই শব্দ একই বর্ণ এ যাবতকাল বাঙালির বাংলা যা যা পড়ে এসেছি যা লিখে এসেছি তাই এখানে লেখা আছে অথচ কী যে অপরূপ দুর্ভেদ্য অন্যরকম এক র্যাপআপ। কী এক দূর্বোধ্য রহস্য কিন্ত ভীষন আকর্ষণে কেবলেই গভীরে টানে। কেবলই ভেতর পোড়ায়। ছবি কেমন করে এলায়ে পড়ে! ক্লান্ত হয়ে পথিক শরীর এলিয়ে দেয় বটের ছায়ায়। কোনো রূপসীর একঢাল লম্বা ঘনকালো চুল এলিয়ে পড়ে ঘাড় বেয়ে আবেশে আলস্যে। এইতো জানি এক জীবন অবধি। বেদনার গভীরতা! যাতনার স্তব্ধতা! বিলাসের বিধুরতা! ক্ষতের যাতনা! ২২ বছরের এক মানবীর পক্ষে এই বিধুর বিচ্ছেদী আর অসামান্য বিরহের অসাধারণ ভিজ্যুয়ালাইজেশন করা কী আদৌ সম্ভব? তবু বুকে কোথায় যেন ছলছল কেঁদে ওঠে বেদনার নদী। ঢেউগুলো তার যেন ভেঙে ভেঙে পড়ে এসে আমারই মনের গহীনে। আর পড়তেই থাকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে…। খুব ছবি দেখার চেষ্টা করি। ছবিটি কি ক্যামেরায় ফ্রেমে বাঁধানো ফটো? নাকি মনের পর্দায় ছাপ ফেলে দেয়া, এঁকে দেওয়া এক অপরূপ মনোহরণ! কেমন করে এলায়ে পড়ে ছবি? কেমন করে………….. এই রহস্যের জটাজালের আজও হয়নি কোনো ভেদ। কবিতাটি নিজের দখলে রেখেছিলেন প্রযোজনাটির পরিচালক আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান। মনে পড়ে সেই পাগলামী সেই গভীর ভালোবাসা কবিতার জন্য। মনে পড়ে কবিতার জন্য সেই সুগভীর প্রেম আবৃত্তিকারের। মাসুদভাইকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি। খুব গভীর আর নিগুঢ় তার বাঁধন কবিতার সাথে। এই ধারাবাহিক লিখতে লিখতে বার বার নানা ভাবে আসবে তার কথা। কারণ কবিতায় কবিতায় তার সাথে আমার গড়ে উঠেছিল এক অপরূপ বাঁধন। আজও যা অমলিন। আমি তাকে বলি জাত আবৃত্তিকার। তিনি হয়তো কবি হতে পারতেন। লিখতে পারতেন দারুণ কোনো সাহিত্য। তার পড়া কবিতার দৌড়াত্ম সংখ্যায় ব্যপক। কবিতার সাথে অন্তর্নিহিত এক মোহন বেদনার বিধুরতা কিংবা ক্ষীপ্রতা কিংবা দ্রোহ কিংবা লাস্য তার তৈরী হয় খুব সহজেই। এটা আমার বরাবর মনে হতো। মনে আছে আমরা ‘পদ্য বাউল‘ প্রযোজনাটি মঞ্চস্থ করবো ঠিক হলো যাখন ত খন সবে জন্ডিস সেরে উঠেছেন তিনি। বাড়ি থেকে ফুটানো পানি নিয়ে এসে বসতেন সেই চিরকালের খুব গুরুত্বের সাথে ইঙ্গিতবহ আসন করে। সেটা না দেখলে বুঝিয়ে বলা ভীষন কঠিণ।বসতেন নিশাত আপা। বসতাম আমি সোহেলী আপা, শারমিন, মাহফুজ, মাসুম, শিফা আপা, সোহেল ভাই আর সোহাগ ভাই। তৈরী হতো সূক্ষ্ণ গভীর আর তুখোর অথচ নিয়ন্ত্রিত এক আবেগের নৈবেদ্য। চিরে চিরে পড়তাম আমরা কবিকে। তার বেদনাকে। তার ভালোবাসাকে। পড়তাম তার ভাষাকে। তার উপমা রূপক আর চিত্রকল্পকেও। মাসুদভাই পড়তেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। আমরা যখন নতুন নতুন এক একটা ফর্ম ধরে পড়তে শিখছি মাত্র তখন তাকে দেখেছি ফর্ম ভাঙছেন। পড়ছেন নিজস্ব এক ঢঙে…..
যেখানে এলায়ে পড়েছে তার ছবি জানিনা কে সে? তবু সর্বগ্রাসী হাহাকার দিগন্তে প্লাবন আনে। যে ঘর আজ শুন্য। যে ঘরে প্রেম নেই। শুন্য সে চরাচরে বটের মূলে রাখাল বসেনা। একসময় রাখালের বাঁশির সুরে কেঁদে কেঁদে সারা হতো যে বটের মূল আজ সেখানে প্রেম নেই। শুন্য গৃহাঙ্গনে কেবল এলায়ে পড়ে থাকে একটি মুখের ছবি। এই অবধি হাারানোর না পাওয়ার না দেখার অথচ গভীরে অস্তিত্বশীল এক মানব কিংবা মানবীর ছায়া ছায়া মুখ ভাসে। অসম্ভব সুন্দর উপমা বিধৌত করে তুলে এনেছেন এক পরিশীলিত আবেগ আর তৈরী করেছেন এক অসাধারণ চিত্রকল্প – এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে/বিদ্যুৎ রেখা মেলে
তারপর শুরু হয় একটি দূর্দান্ত অভিমানের অবিষ্মরণীয় এক ইনিংস। মাত্র আটটি লাইনে যেন উঠে আসে এক সুদূরগ্রাসী ব্যাপক বিধুর বিস্তর অভিমান।আর তার পরতে পরতে আঁকা রয়েছে অপরূপ সব চিত্রকল্প। মাসুদভাইর খুব সাদামাটা কন্ঠ। সাধারণ আবৃত্তিকারদের মতো ভরাট নয় যা। অথচ যখন পড়তে শুরু করেন তখন অন্য এক মানুষ বের হয়ে আসেন ভেতর থেকে। এ যেন সত্যিকারের সেই লেখক। যার বুক চিরেই উঠে আসছে দীর্ঘশ্বাস। তার বেদনা চিরে চিরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক একটি শক্তিশালী অভিমান। তার শব্দ উচ্চারণের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছে যত যাতনার বিশেষ। এইভাবে নির্মান করেছেন তিনি এক একটি কবিতার শব্দ থেকে বাক্য। বেদনা থেকে বিচ্ছেদ। প্রেম থেকে আনন্দ। আর বিশেষকে করে তুলেছেন সবিশেষ –
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলনা আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা পিড়ীত ফুল
আনন্দ ভৈরবী।