তিনজনের পরে সিটের একধারে কোনও মতে বসেছিলাম। হকাররা গায়ে প্রায় ধাক্কা মেরেই চলে যাচ্ছিল। লেডিজ কামরার হকার আধিক্য সর্বজনবিদিত। এক আঙুর বিক্রেতার ঝুড়িটা এত জোরে হাতে লাগল যে না বলে আর পারলাম না, “দাদা, একটু সাবধানে ঝুড়ি নিয়ে যান।”
বেশ বিনীতভাবেই বলেছিলাম, কিন্তু আঙুর বিক্রেতা অত্যন্ত উদ্ধতভাবে জবাব দিলেন, “এতটুকুতেই অসুবিধে হলে গাড়িতে করে গেলেই পারেন। ট্রেনে গেলে একটু অ্যাডজাস্ট করতেই হবে।”
ভাবনায় পড়লাম। সত্যি কত কিছু যে আমাদের অ্যাডজাস্ট করতে হয় প্রতিদিন, প্রতি নিয়ত! একদিন এই লেডিস কম্পার্টমেন্টেই জোর আলোচনা শুরু হয়েছিল সংসারে মেয়েদের কর্তব্য নিয়ে। সহযাত্রীদের মধ্যে পরিষ্কার দুটো দল ভাগ হয়ে গেছিল। একটা আমার সম বয়সী অর্থাৎ অল্প বয়সীদের, অপরটা মা কাকীমাদের বয়সীদের। আলোচনা বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। একজনের এক কথার উত্তরে এক বয়স্কা সহযাত্রী উত্তর দিলেন, “মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছ তখন সারা জীবন অ্যাডজাস্ট করেই চলতে হবে।”
মুখে এসে গেছিল, “মেয়ে হয়ে নয়, মানুষ হয়ে জন্মেছি,” কিন্তু না বললাম না। কারণ ওই ভদ্রমহিলার বদমেজাজী এবং কলহপ্রিয় বলে যথেষ্ট ‘সুনাম’ আছে। তাই চুপ করে গেলাম। সত্যি কথা হচ্ছে গোলমালের ভয়ে অ্যাডজাস্ট করে নিলাম।
এই অ্যাডজাস্ট করার তালিকা দীর্ঘ। এক বিয়েবাড়ির অভিজ্ঞতা বলি। খাবার জায়গায় দেখলাম শুধু বুফের ব্যবস্থা। ভালো কথা। আমি এমনিতেও বুফেতে খেতেই পছন্দ করি। কিন্তু সেখানে দেখলাম দু তিনটে আইটেমের সামনে বেশ ভিড়, ঠেলাঠেলিও হচ্ছে। একখানা ফিস ফ্রাই সবে প্লেটে তুলে নিয়ে আসছি এমন সময় এক মোক্ষম ঠ্যালা। ফিস ফ্রাই ফুরিয়ে আসছে দেখে এক ভদ্রলোক প্রায় দৌড়চ্ছেন! তাঁর ঠেলায় আমার প্লেট মাটিতে প্রায় পড়ে আর কী! হাতে প্লেট ব্যালেন্স করার আমার কসরত দেখে আর একজন সহাস্যে বললেন, “এখন রাশটা তো বেশি, তাই এরকম হচ্ছে, একটু অ্যাডজাস্ট করে নাও।”
সেবার পুজোর ক’দিন আগে পড়ে গিয়ে মার বাঁ হাতে কলিস ফ্র্যাকচার হল। সার্জারির দুদিন পরে ডাক্তারবাবু ড্রেসিং করে প্লাস্টার করে দিয়ে বললেন, “একটু অসুবিধে হবে প্রথম প্রথম, তবে ক’দিনেই অ্যাডজাস্টেড হয়ে যাবেন।”
অ্যাডজাস্টমেন্টের ঝক্কি চলল দেড় মাস ধরে। আমি প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে জিজ্ঞেস করতাম, “মা, কতটা অ্যাডজাস্টেড হলে?”
দুর্গাপুজো প্রায় বাড়ি বন্দী হয়ে কাটল। শেষ বিরক্ত হয়ে কালীপুজোয় ঠাকুর দেখতে বেরোল মা। সঙ্গে আমি। এক জায়গায় প্যাণ্ডেলের সামনে বেশ লম্বা লাইন। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত লাইনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম দুজনে। একটু পরে অকারণেই ঠেলাঠেলি শুরু হল। মার হাতে পাছে লেগে যায় এই ভয়ে আমি মার পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রমহলাকে বললাম, “প্লিজ ঠেলবেন না, মার হাতে লেগে যাবে।”
তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তর দিলেন, “ঠাকুর দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে এইটুকুও যদি অ্যাডজাস্ট করতে না পারেন তাহলে বেরিয়েছেন কেন? বাড়িতে থাকলেই পারতেন।”
কাছেই দাঁড়ানো এক স্বচ্ছাসেবকের কী মনে হল জানি না সে আমাদের দুজনকেই লাইন থেকে বার করে নিয়ে গিয়ে শর্ট কাট প্রাস্তায় সোজা প্যাণ্ডেলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। এই অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্যে তাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। ফেরার পথে মাকে বেশ চিন্তিত লাগল, জিজ্ঞেস করলে বলল, “অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কখন, কোথায় কী অ্যাডজাস্ট করব আর কতটাই বা করব একদমই বুঝতে পারছি না।”
শীতকালে বাগানে, টবে নানান মরশুমি ফুলের গাছ লাগাই আমরা। এ যে শুধু আমাদের অনেক বছরের অভ্যেস তা নয়, আমাদের শখও বটে। বাগান ছাড়াও প্রায় গোটা পঞ্চাশেক টবে ইনকা, পিটুনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ইম্পেশেনস, জিরেনিয়াম, প্যাঞ্জি বারান্দার লাগোয়া আমাদের ছোট্ট রকটাকে আলো করে রাখে। একদিন সকালে আবিষ্কৃত হল ইনকার বারোটার টব হাওয়া। খুব, খুব মন খারাপ হয়ে গেল। খারাপ হওয়ারই কথা। সেই ছোট্ট ছোট্ট দু পাতার চারাগাছ এনে লাগানো, তারপর কত যত্নে তাদের বরো করা। পাড়ার একজন সব শুনে টুনে বললেন, “এসব নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। এসবে অ্যাডজাস্টেড হয়ে যেতে হবে।”
চমকে উঠলাম! চুরির সঙ্গেও অ্যাডজাস্টমেন্ট! শেষ পর্যন্ত ভেবেচিন্তে সিন্ধান্ত নেওয়া হল যে এবার থেকে টবে ইনকা আর করব না, মাটিতে লাগাব। এও এক ধরণের অ্যাডজাস্টমেন্টই তো বটে।
নাটক দেখতে গেছি। আলিবাবা। হল পুরো ভর্তি। অনেক বাচ্চারাও আছে। আমাদের সিটের পেছনের সারিতে বসা এক ভদ্রমহিলা নাটক চলাকালীনই ছেলেকে আলিবাবার গল্প বলে চলেছেন, ছেলেও নানান প্রশ্ন করছে। আশপাশের কয়েকজন চুপ করতে বলছেন। ইন্টারভ্যালের সময়ে দেখলাম ভদ্রমহিলা খুব রেগে গেছেন, “আপনারা এইটুকুও অ্যাডজাস্ট করতে পারছেন না? আমার ছেলের কত জানার ইচ্ছে সেটা তো দেখছেন না? বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা নেই মনে হয়, তাই বাচ্চার সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারছেন না। মাত্র দু ঘন্টার ব্যাপার তাও পারছেন না!”
বুঝলাম নাটক দেখতে দেখতেও এবার থেকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কীসে কীসে অ্যাডজাস্ট করতে হবে ভাবতে গিয়ে দেখলাম কীসে কীসে হবে না সেটা বরং ভাবা সহজ। সেটারই একখানা লিস্টি করা যায় কীনা ভাবছিলাম। তবে রোজ রোজ অপরদিকে এত ভিন্ন ভিন্ন বিষয় যোগ হচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত আর এ লিস্টি হবে কীনা তাই সন্দেহ।
এই তো লিখছিলাম, হঠাৎ বেলা সাড়ে এগারোটার সময়ে খেয়াল হল দশটায় সেই যে আলো চলে গেছে এখনও তো আসেনি। ফোন করলাম সাব স্টেশনে। যিনি ধরলেন তিনি বললেন, “একটা গাছ কাটার কথা হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই, বড়ো গাছ, তার ডালপালা ওভারহেড তারে খুব ডিস্টার্ব করছে। সেটাই কাটা হচ্ছে। বিকেল চারটের আগে পাবেন না। দুপুরের জলও আসবে না।”
“বিকেল চারটে!” আমি বললাম, “কিছুই তো জানি না। আগে থেকে জানিয়ে দিলে আমাদের সুবিধে হয়।”
“তা তো হয়। আমরা তো অনেক সময় মাইকিং করি, এস এম এসও পাঠাই। তবে এবার আর করা হয়নি। সাড়ে এগারোটা তো বেজেই গেল, আর মাত্র সাড়ে চার ঘন্টা। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিন।”
সেই থেকে মানিয়ে গুছিয়েই নিচ্ছি, অন্তত চারটে অবধি তো নিতেই হবে। তারপর আবার কী হয়, কী কী মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয় দেখি।