• Uncategorized
  • 0

মুক্ত গদ্যে বিশ্বজিৎ লায়েক

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

‘রাস্তা সেই দিকেই যাবে যে দিকে তুমি…’

রাত দশটা। অফিস ছুটির পর শেষ ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরি। বাড়ি ফিরে টিভিতে নিউজ দেখি। খাবার খেতে খেতে ভাবি যদি আগামীকাল থেকে অফিস যাওয়া ছেড়ে দেওয়া যায়! তারপর… রাতদিন কবিতা লিখব। লিখব নিজেকেই। বউকে বলব, ‘এই নাও, তোমাকে দিলাম এক বুক নদী / যার তলপেট থেকে গতরাতে এনেছিলাম স্রোত।’ বউ বলবে, ‘এইসব কথার কী ছিরিছাঁদ! ভাবছো ভাব। আমাকে নিয়েই ভাব! এবার আমাকে নিয়েই একটু চিন্তা করো।’
ঘুম থেকে উঠি। চা খাই। সকালের বাজার করি। ভাত খাই। অফিসে যাই। রাতের প্রতিজ্ঞা সকালে আর মনে থাকে না। আয়নার সামনে দাঁড়াই। টেরি বাগিয়ে বলি, ‘বিশ্বজিৎবাবু, তুমি একটা ভীতুর ডিম!’
আয়নার ভিতরের আমি বলে, ‘ ডিম ফেটে বাচ্চা হলে ছানাটাও ভীতু হবে!’
-‘আলবৎ।’
-‘কেন!’
-‘আরে আমড়া গাছ লাগিয়ে আপেল খাওয়ার স্বপ্ন দেখো!’
আয়নার বাইরের আমি আর আয়নার ভিতরের আমি দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই।
সত্যি কি তাই নাকি কবিতা লিখতে লিখতেই ঝলসে গেছে আঙুল। পুড়ে গেছে মন, আর্ধেক হৃদয়! ঘনঘোর অন্ধকারে জেগে উঠেছে আলো। জীবনের অমেয় আলো ঠিকরে পড়েছে আনাচে কানাচে। আমি কুড়িয়ে পেয়েছি নতুন নতুন কবিতা। ‘ভালবাসলে একটা স্বপ্নের ভিতর আরেকটা স্বপ্ন / জেগে ওঠে / যেমন একটা জীবনের ভিতর আরেকটা জিবনের জন্ম হয়।…’
আমার এই যে জীবন! একপাশে আনন্দের লাভা উদ্গিরণ করে আর অন্যপাশে বিষাদের জল গড়িয়ে গড়িয়ে নামে। দুঃখ আর দারিদ্র। সুখ আর ভোগ। পাশাপাশি হাঁটছে মানুষ। মানুষের পাশে পাশে হাত ধরে আছে কি মানুষ! অনিত্য জীবনের এই এক সত্যতা। মনে হচ্ছে, ‘সেদ্ধ মানুষের মুখ ভয়ানক দুমড়ে মুচড়ে / সারিবদ্ধ স্বপ্নের দিকে… হাহাকার।’ মানুষ তবু স্বপ্ন দেখে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ভালবাসার স্বপ্ন। ‘ফাগুন ঋতু শুয়ে আছে শরীরে তোমার।’ এই স্বপ্নও মানুষ দেখে। অথচ তুমি রাগ করে চলে গেলে। জানি ফিরবে আর। তবু প্রতি রোববার তোমার কাছে যাওয়া। আমু আর আমার ঈশ্বর সন্তানের কপালে রাখছি চুমু। তুমি বলছ, ফিরবে না- ফিরবে না আর! মনখারাপ নিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছি। মনখারাপ নিয়ে জেগে উঠে দেখছি–‘ক্ষতগুলো লেগে আছে শরীরে ও মনে / যোগ বিয়োগের তলে তলে নটে গাছটি মুড়িয়ে গেছে কবে / গল্প ফুরোয়নি এখনও।’
‘হায় হাসি হায় দেবদারু / মানুষ নিক্টে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’ ওরা মার খাচ্ছে। পিন ফুটিয়ে চুপসে দিচ্ছে বেলুন। কেউ কাউকে রেয়াত করছি না। কেউ কাউকে বলছি না, ‘আয় ভালবাসি।’ হেঁসেলে ঢুকে রান্না লিখছে অসহিষ্ণু হাত। গভীর খননে নেমে যাচ্ছে গোটা একটা দেশ। আমরা চুপচাপ বসে আছি। হাততালি দিচ্ছি। ডুগডুগি বাজিয়ে খেলা দেখাচ্ছে যারা, তারা যুদ্ধ শেষে যে যার নিজের মতো শুয়ে আছে সোহাগে আর সুরায়। তাদের বল ক্ষুৎকাতর এই দেশে ঈশ্বর নয়, অন্নের উপাসক হও। হাত বাড়াও, হাতে হাতে আঁকো পলাশ-কুসুম। তাদের দুঃখের কাছে, যন্ত্রণার কাছে, অসুখের কাছে বসে গল্প বল। জীবনের গল্প, আলোর গল্প, ভবিষ্যতের গল্প। চক, খড়ি শ্লেট নিয়ে ওদের শিশুরা আবার পাঠাশালায় যাক। দেখুক এই জগৎ আনন্দময়। ‘ভয় নেই, এই তো এগিয়ে দিয়েছি হাত / ভয় নেই, এই তো,  এই তো আরও উঁচু করেছি / মাথা / এবার এসো, দ্যাখো আমাদের আর কোনও রাগ নেই / সাতে পাঁচে মিলে যাচ্ছে পুরনো সম্পর্ক / এই তো এগিয়ে দিয়েছি হাত / উঠে এসো / তোমাকে আগের মতো স্বপ্নে ফিরিয়ে নেবো…’
আমার দু’বছরের সন্তান অপ্রতিম। কলা খেতে খেতে শিখিয়ে দেয়, ‘এই হনুমান কলা খাবি / আমার সঙ্গে বাড়ি যাবি।’ আমি কাঁদতে থাকি। আমার নোনা জল চেটে নেন স্বয়ং ঈশ্বর। আর যে অতি বৃদ্ধ,  হাঁটতে পারেন না, চোখে দেখতে পায় না। না খেতে মরে যাওয়া সেই বৃদ্ধের চোখের জল এসে ছিটকে পড়ে আমার সদ্য লেখা কবিতায়। নিমেষে সব ঝাপসা হয়ে যায়। পৃথিবী অন্ধকার মনে হয়। পতনশীল বস্তুর মতো অবাধে নেমে যেতে ইচ্ছে করে…। কোথায়! তা তো জানি না!
-‘বাবা, তুমি কোথায় যাবে? আমাকে নিয়ে যাবে না?’
এই প্রশ্নের ঘাত এসে আমার বুকের মাঝখানে এসে লাগে। পিতার হৃদয় দুমড়ে, মুচড়ে চৌচির হয়ে আকাশে ভাসতে থাকে। আকাশ জুড়ে নির্মম হাহাকার! পৃথিবীকে নিষ্ঠুর মনে হয়। স্বার্থপর মনে হয়। চোখ বাঁধো গান্ধারি আমিও অন্ধ হতে চাই। শৈশবের সারল্য আর অসহায় পিতার যন্ত্রণা বোধ থেকেই কবিতার কালো অক্ষর নেমে আসে সাদা পৃষ্ঠায়। আমি রাত জেগে লিখতে থাকি–‘ঈশ্বর নেই / তাই আমার কান্নার নোনাজল চেটে নিচ্ছি / স্বয়ং আমি।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।