মানিক পাঁচালী -তে দেবাশীষ সেনশর্মা

হিরে মানিক জ্বলে

বাঙ্গালী হয়ে জন্মানোর দুটো প্রধান বিপত্তি রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ। যে কোনো জাতির ক্ষেত্রেই এই দুই Icon যেমন গর্বের, তেমন মুশকিলেরও। রবীন্দ্রনাথ যাও বা আমাদের জন্মের আগে দেহত্যাগ করে ইতি মধ্যে পাথর প্রতিমা রূপে প্রতিষ্ঠিত, সত্যজিতের ক্ষেত্রে সেই ছাড় নেই। আমাদের শৈশবের যাবতীয় ফ্যান্টাসি ঘিরে থাকত সন্দেশ পত্রিকা আর গুপী বাঘার জগতে। এখনও মনে আছে, ১৯৮৬ সালে আমার প্রথম হলে গিয়ে দেখা ছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। তারপরেই বাড়ি ফিরে এসে উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরে আলাপ গুপী, বাঘা, টুনটুনি এবং সাত ভূতের সংসারের সঙ্গে। আর তারপর একটু বড় হতে না হতেই ওনার অস্কার প্রাপ্তি। ব্যাস বুঝে গেলাম আর কোন উপায় নেই আধুনিক শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙ্গালীর রূপরেখা তৈরি যেখান থেকে কোনো নিস্তার নেই। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক, অন্যধারে সুরকার ও ছবি আঁকিয়ে এবং প্রত্যেকটাতেই আন্তর্জাতিক মানের উপস্থাপনা – একে মাথায় করে রাখবে না তো বাঙ্গালী কি হরিদাস পাল কে নিয়ে নাচবে?
তবে বয়স ও মনন বাড়ার সাথে সাথে বাঙ্গালীর সংস্কৃতিতে সত্যজিতের অবদানটা আস্তে আস্তে বোঝার চেষ্টা করলাম। সত্যজিত রায় কি শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী পরিচালক? প্রশ্ন থাকতেই পারে। শ্রেষ্ঠ লেখক? না, বোধহয়। শ্রেষ্ঠ ছবি আঁকিয়ে? বা সঙ্গীতকার? হয়ত না। তবুও কেন উনি রবীন্দ্রনাথের পর বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ Icon? তার কারন উনি এমন এক আধুনিকতার প্রতীক যে আধুনিকতার ভাষা সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। ‘অপু ট্রিলজি’ শুধুমাত্র তিনটি ছবি নয় – নিশ্চিন্দিপুর থেকে কলকাতা ছুঁয়ে অপুর এক আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠার কথোপকথন। ঠিক যেভাবে আমাদের সামনে আসে ফেলুদা বা সিধুজ্যাঠা যার ভাবনা, প্রজ্ঞা এবং বিচারবুদ্ধি অসম্ভব আধুনিক – যা সময়ের চেয়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকে না বরং সময়কে ছুঁয়ে থাকে সবসময়। সারা পৃথিবীতে যে কোনো সায়েন্স-ফিকশনের সমতূল্য প্রফেসর শঙ্কু, যার কাজের লোকের নাম প্রহ্লাদ হলেও বেড়ালের নাম কিন্তু নিউটন। সত্যজিতের সংগীত প্রয়োগেও আমরা যে পাশ্চাত্যশিক্ষার ছাপ দেখি – বাঙ্গালী সেই ছাপকে আজীবন একধরনের ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রমের চোখেই দেখে এসেছে। এক দূরতর দ্বীপের মতই আমাদের মনে হয় তার চরিত্ররা ফতুয়া না পরে গাউন পরে, বিড়ি না খেয়ে পাইপ খায়, আড়বাশীঁ না বাজিয়ে পিয়ানো বাজায় এবং অবশ্যই বাংলা মদ না খেয়ে সবসময় দামী স্কচ খায়। এক নিপুন পরিপাট্য দেখতে পাই আমরা তার ছবির জগতে, শব্দের জগতে – যে পরিপাট্যের ভাষা আমাদের আন্তর্জাতিক আধুনিকতার ভাষার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু এই পূজো পরিক্রমা করতে গিয়েই আমরা হয়তো ভুলে যাই দূর্গার কথা, গুপী বাঘার সেই চাষীর কথা, পাপাঙ্গুঁলের কথা বা নায়কের সেই বামপন্থী বন্ধুর কথা- ভুলে যাই একের পর এক ছোটগল্পে তৈরি করা অসামান্য সব চরিত্রের কথা। ভুলে যাই ‘টু’ সিনেমায় জানলার বাইরে থাকা বাচ্চাটার কথা। ভুলে গেলে চলবে না এই এই সব কটা চরিত্রও সেই একটা মানুষের তৈরি। তাই, ওনাকে পূজার ছলে যেন ওনার সঠিক মূল্যায়নে আমরা পিছিয়ে না পড়ি। তবেই এরকম একজন মানুষের জন্মদিন পালন সার্থক। আসল কথা হোল দিগপুরুষরা তো আর প্রতি দশকে জন্মান না, তাই তাদের যত্ন নেয়াটাও একটা শিক্ষা – শুভ জন্মদিন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।