তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের প্রায় বছর সাতাশ হতে চললো … ছোটবেলার গরমের ছুটি আর আচমকা লোডশেডিং। রোজকার জীবনে এসির অনুপ্রবেশ তখনো হয়নি.. আমরা তখন কালবৈশাখীর আশায় মেঘের গতিবিধি মাপতাম .. খেলাধুলো-বইপত্তর মিশিয়ে দুইবিনুনীর মেয়েবেলা তখন জমজমাট, এরই মধ্যে কোথাকার এক রজনী সেন রোড নিবাসী ছয় ফুটের লোক এসে জীবনটা ভিনি-ভিডি-ভিসি করে ফেললে .. আর কি চাই…এক এক করে সব এডভেঞ্চার পড়েছি, জাঁদরেল জাঁদরেল সব ভিলেন – বনবিহারী বাবু,মগনলাল এদেরকে হেলায় হারিয়ে দিচ্ছে শুদ্ধু মগজাস্ত্র দিয়ে -সাথে ফাউ হিসেবে ঘুরে আসছি লখনৌ,কাশ্মীর, দার্জিলিং এমনকি নেপালও – ফেলুদার নীল খাতার হিজিবিজি উদ্ধার করতে গিয়ে বাবাকে ধরে শিখে নিচ্ছি গ্রীক এলফাবেট,বইয়ের তাকে একে একে বাড়ছে ফেলুদার উপন্যাস – ফ্যান হওয়ার জন্য আর কি চাই।
অতঃপর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু ও তারিণীচরণ বাঁড়ুজ্জের পাল্লায় পড়ে ফেলুদা থেকে সত্যজিতের ফ্যান … তবে বই পড়তে পড়তেই বড় হয়েছিলাম।মাধ্যমিকের আগে গুপীবাঘা আর পথের পাঁচালী ছাড়া আর কোন ছবি দেখি নি আমি। হ্যাঁ- ছবিইই তো-গুপী গায়েন বাঘা বায়েনের শেষ সিনের সেই মস্ত বড় আল্পনাটা সাদা কালো থেকে রঙিন হচ্ছে আর অদ্ভুত মায়াবী সুরে ভরে যাচ্ছে চারিদিক। অনেকদিন অবধি আনন্দের চূড়ান্ত মুহূর্তে এই দৃশ্যটাই মনে পড়ে যেত।ঠিক যেমন ভুলতে পারি না জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ছড়ি দিয়ে মহিম গাঙ্গুলির কবজি চেপে ধরার অনবদ্য দৃশ্য – ক্ষমতার অস্তাচলেও একা দর্পিত এক পুরুষ ,সিঁদুর কৌটোয় ধুলো জমে,অনেকদিন পর খুঁজে পেয়ে ডোবার জলে ফেলে দেয় অপু,ঘূর্ণিও ওঠে না। আর ঐ ছবি থেকেই তো জানা ছ ফুট লম্বা এক সুদর্শন যুবক যদি সানগ্লাস পরে থাকে তাকে আরো বেশী সুদর্শন লাগে।অসীম… শুধু অসীমকেই দেখেছিলাম প্রথমবার।আর শিখেছিলাম মেমরি গেম। আজো সময় কাটানোর জন্য প্রিয়।আসলে আমরাও তো বড় হয়ে উঠি,পুরোনোও।শ্যামলেন্দুর মত বুককেসে অবহেলায় পড়ে থাকে শেক্সপিয়র।ইঁদুর দৌড়ে দৌড়তে গিয়ে জীবন আজ বারো ঘন্টার টার্গেট আর এপ্রাইজাল এস্কেলেশনের জালে বন্দী।ঠিক যেমন টাকার পাহাড়ে চাপা পড়ে গিয়েছিল অরিন্দম।কেউ বাঁচাতে আসে নি আর সেই চোরাবালির অন্তরালেই হারিয়ে গিয়েছিল অসতর্ক মুহূর্তের মনের কথা “বাঃ চশমা খুললে আপনাকে তো বেশ লাগে।”
আসলে ম্যাজিশিয়ন তো একজনই।সাদাকালো জীবনকে এক লহমায় রঙিন করে দেন তিনি,হোক না ছবিতে ক্যামেরা আর ফিল্ম স্ট্রিপে কিংবা হোক না বইয়ের পাতায় কালি কলমে।ইন্দিরা ঠাকুরণরা সবাই ভালো থেকো , ভালো থেকো সুজন হরবোলা।এক জেনারেশন থেকে আর এক জেনারেশনে পাড়ি দিতে দিতে ভালো থাকবেন প্রফেসর।আর মনের দরজা-জানালাগুলো খুলে দিয়ে তাজা বাতাস এনে দিতে আপামর বাঙালীর মনে বেঁচে থাকবেন সত্যজিত।।