ভ্রমণ কাহিনীতে জবা চৌধুরী

খুশির ঠিকানা

বছর দু’এক আগে পর্যন্ত ভারতের উত্তরের রাজ্য ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এর শুধু কাশ্মীর নিয়েই ভেবেছি। আর কাশ্মীর সম্পর্কে অনেকটাই জেনেছি বিভিন্ন লেখকের ভ্রমণ কাহিনী থেকে। তারপর ২০০৯ সালে প্রথমবার সেই ভূ-স্বর্গকে নিজের চোখে দেখার সুযোগ যেদিন এলো, তার মাটিতে পা রেখে ধন্য হয়েছি নিজে। এ তৃপ্তির কোনো তুলনা হয় না।

২০১৭ সালের গরমের ছুটি তখন। আমার বর স্বপন আর ছেলে তুতাই দু’সপ্তাহের জন্য সুদূর আমেরিকা থেকে প্রথমবারের মতো গেলো লাদাখ ভ্রমণে। আর সেই থেকে ভারতের উত্তরের রাজ্য ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এর ‘জম্মু’, জায়গা করে নিলো আমাদের মনে — নানা কথায়, নানান সৌন্দর্যের তুলনায়। প্রাথমিক ভাবে সে সব শুনলাম স্বপনের কাছ থেকে। তারপর ২০১৮ এর গরমের ছুটিতে সুযোগ এলো সেই গল্পের লাদাখকে নিজের চোখে দেখার। এবার সপরিবারে হলো আমাদের যাত্রা। দেশের পরিবারও আমাদের সাথে যোগ দিলো দিল্লীতে। তারপর বারো জনের দল পা বাড়ালাম লাদাখের দিকে।

নতুন কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলেই আমার ভীষণ ক্ষিধে পায় সময়ে অসময়ে। সেদিনও শ্রীনগর এয়ারপোর্টে পৌঁছেই মনে হলো না খেয়ে আমি আর এক পা-ও চলতে পারবো না। ওই এয়ারপোর্টের নিয়ম-কানুন অনেক। অগত্যা পোর্টাররা ভরসা l ওরাই আমাদের জন্য কিছু খাবার এনে দিলো।

শ্রীনগর থেকে আমাদের লাদাখ যাত্রার আসল অধ্যায় শুরু। সামনে শুধুই পাহাড়ি বিপদ-সংকুল পথ। একটা মিনি বাস আর সাথে একটা গাড়ি রিসার্ভ করে রাখা ছিল। । সবাই যে যার মতো উঠে বসলাম। দিল্লীর কুয়াশা-ধুয়াশা মেশা ভারী হাওয়ার পর আমাদের শ্বাসনালীতে কাশ্মীরের ওই নির্মল হাওয়ার মুক্ত বিচরণ সত্যিই ছিলো অনুভব করার মতো !

এশিয়ার দীর্ঘতম নদী সিন্ধু, কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে এই সোনামার্গ অঞ্চল হয়ে হিন্দুকুশ সীমান্তের দিকে। ওই নদীর গা ঘেঁষে এক মনোরম পরিবেশে একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট — সেখানে আমরা থামলাম লাঞ্চের জন্য। ঠিক তার পাশের দোকানটিই ছিল কাশ্মীরি জামা-কাপড়ের। আমাদের দলের নারীবাহিনী খাবারের বদলে হানা দিলো ওই দোকানে ! বাকিরা চলে গেলো বাইরে নদীর ধারে সাজানো বসার জায়গায় রিলাক্স করতে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খবর এলো ওই রেস্টুরেন্টে শুধুই নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। জানতাম আগে চলতে চলতে আগামী দশ দিন নিরামিষ-ই খেতে হবে। তবুও প্রথম ধাক্কা। দাঁড়িপাল্লার একদিকে আমার ক্ষিধে আর অন্যদিকে ডাল-সবজি ফেলে ওজন নিলাম বেশ করে। জানি, এই খাবার নিয়ে আমি অমত করলে ছোটদেরকে সামলানো কঠিন হবে। তাই জোর করে পাঁচ -সাতটা দাঁত বাইরে এনে খুশি খুশি মুখ করে বললাম, “দারুণ !” যাইহোক, সেই খাবার কিন্তু বেশ ভালোই ছিল। আর চলতে চলতে দশ দিনের খাবারের অভিজ্ঞতার গ্রেডিং করলে এখন অবশ্যই বলবো, সেই খাবার উঁচু গ্রেড পাবার যোগ্য ছিল।

লাঞ্চ শেষ হতেই বেরিয়ে পড়তে হলো আমাদেরকে। কারণ সামনের রাস্তা ছিল দুর্গম। ড্রাইভাররা বারবার তাড়া দিচ্ছিলো।সন্ধ্যা হবার আগে কার্গিল পৌঁছাতে হবে। রাস্তা খুব খারাপ। এতো বড় দলকে সময়ের সাথে চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। ড্রাইভারদের তাড়া শুনে ‘ভীরু’ রা চটপট গাড়িতে উঠে বসে গেলো। কার্গিল পৌঁছনো অব্দি ওরা আর নামবে না ঠিকও করে ফেললো। আর ততক্ষণে ‘সাহসী’রা সুন্দর দৃশ্য দেখলেই গাড়ি থামিয়ে নামবে, এই প্ল্যান করে ফেলেছে। আমার পা দু- নৌকোয়। ভয়টা কীসের সেটা পরিষ্কার নয়। তাই ভয়। কিন্তু এতো দূরে এসে সব না দেখে চলে যেতেও আমি চাই না। যাইহোক, ফাইন্যালি সব জায়গায় সবাই নামলো। প্রকৃতির ওই সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া যায় না। যদিও মুখের ওপর “মাগো, কী হবে” — এই প্রশ্নবোধক চিহ্ন আমাদের অনেকেরই ছিল।

কার্গিল পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেলো। হোটেলের ঠিকানা জানা সত্বেও ড্রাইভাররা অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় পথ হারালো।তখন বুঝলাম ওদের তাড়া দেবার আসল কারণ। হোটেলে আমাদের ডিনার রেডি ছিল। প্রচন্ড জেট লাগ্, সাথে ক্ষিধে আর দীর্ঘ পথের ক্লান্তি —- গরম জলে শাওয়ার আর গরম গরম খাবারের পর টেবিল ছাড়ার আগে সবাইকে একবার শুধু ‘গুড নাইট’ই বলতে পেরেছিলাম —- যতদূর মনে পড়ে। সে রাতে আর কারো সাথে গল্প-আড্ডা হয়নি।

ভ্যাকেশনে গেলে ভোর হয়েছে কিনা আমাকে ঘড়ি দেখে বলতে হয় না। হোটেল হোক বা, দেশের বাড়ি —- কানের কাছে খুব হালকা স্বরে একটা লাইন ভেসে আসে….”জবা, আমি একটু বেরোচ্ছি।” অর্থাৎ, আমার কর্তা মহাশয় গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। সেদিনও তাই হলো। ভাগ্নে রাজকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো স্বপন L.O.C. সীমান্ত দেখে আসতে।আমরা বাকিরা ঘুমালাম নিজেদের হিসেব মতো।

প্ল্যান মতো সকাল দশটার দিকে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কার্গিল দেখে সেদিনই আমরা যাবো লামায়ুরু। গাড়ি চলতে শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের চোখ বড় বড় হতে লাগলো হিমালয়ের রূপ দেখে। সকালের রোদের সোনারঙে চারদিকে দাঁড়ানো হিমালয়ের পর্বতমালা বর্ণময় হয়ে যেন আমাদেরকে বলছে ‘জুলে’ (Julley)! কাউকে স্বাগত জানাতে, সম্মান জানাতে লাদাখের লোকেরা বলে ‘জুলে’। মন কেড়ে নেয়া সেই ডাককে উপেক্ষা করা গেলো না। গাড়ি থামিয়ে সবাই আমরা নেমে পড়লাম।পাহাড়ের গা বেয়ে যতোটা সম্ভব উপরে চড়লাম আমরা। যাদের হাতে ক্যামেরা ছিল, সবারই চোখ তখন লেন্সে।

কার্গিলের ৮৭৮০ ফুট থেকে যতো ভেতরে যেতে লাগলাম উচ্চতা ততই বাড়তে লাগলো। দুপুর নাগাদ যখন লামায়ুরু পৌঁছোলাম, উচ্চতা তখন ১১,৫২০ ফুট। হোটেলে বুকিং দেয়া ছিলো আগে থেকেই। অত্যন্ত সুন্দরভাবে হোটেলের লোকেরা আমাদেরকে আপ্যায়ন করলো, আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলো।

লাঞ্চ এর পর আমরা দেখতে গেলাম লামায়ুরু মনাস্টেরী (monastery)। হোটেল থেকে দেখে মনে হয়েছিল খুব কাছেই এই মনাস্টেরী। তাই দল বেঁধে হেঁটে রওয়ানা দিয়েছিলাম। পরে মনে হলো পথ যেনো আর শেষ হয়না। চড়াই এর শেষ প্রান্তে পৌঁছে যখন ওপরে তাকালাম — এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় মন ভরে গেলো। নির্জন, শান্ত পরিবেশে পরিশ্রান্ত হৃদযন্ত্রে নিজেরই জোরে জোরে নেওয়া প্রতিটি শ্বাস যেন সদর্পে জানাচ্ছিলো বেঁচে থাকার মূল্য। মনে আসা প্রতিটি ভাবনাকে মনে হচ্ছিলো নিখাদ। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল নিঃস্তব্ধ মনাস্টেরীটিকে মনে হলো যেন সবকিছুর সাক্ষী। মন্দিরের সবচে’ ওপরের দিকে সাজানো ছিলো ছোট-বড় অনেক সাইজের প্রার্থনা-চক্র বা praying wheel. স্থানীয় লোকেদেরকে দেখলাম মন্ত্র পড়ে পড়ে ওই চাকাগুলোকে ঘোরাতে। আমিও নিজের মতো করে প্রার্থনা করলাম ঈশ্বরের।

নেমে আসার পথে ওদের প্রধান সন্ন্যাসীর (monk) সাথে দেখা হলো। অমায়িক পুরুষ। সকলের সাথে কথা বললেন। আমাদের অনুরোধে সকলের সাথে বসে ছবিও তুললেন। উচ্ছ্বাসহীন অতুলনীয় ভালোলাগা ওই সন্ধ্যার কথা মনে করতে গিয়ে, লিখতে বসে, আজ আমি উচ্ছ্বসিত ! ইট, কাঠ, পাথরে বাঁধানো শহুরে জীবনে বসে, ফেলে আসা ওই নির্মল ভালোলাগা সময়ের মূল্য বোঝানো কঠিন। জানি, মনের কোনো এক গভীরে জেগে থাকা এক টুকরো খুশিই শুধু তার শেষ ঠিকানা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।