ভ্রমণ কথায় শীতল বিশ্বাস

 মুক্তো-দানা

আরে,কাঠের নড়বড়ে পুলটা কই!এটা তো কংক্রিটের ।একটু যেন সরে গেছে পুরনো জায়গা থেকে ।অ্যাতো হোটেল, লজ্
,চায়ের দোকান,সুন্দর সুন্দর বাড়ি ।পাহাড়ি পথটা কিছুটা মসৃণ-চওড়া ।বাসস্ট্যান্ডটি বেশ ভালো ।খরস্রোতা-পাথর কেটে নিজের পথ তৈরি করা শিশু নদীটির ওপাশে নিগমের বাংলোতেও কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া ।রাস্তার ওপাশে মৌন হিমালয় ।
এপাশের নগাধিপতিও গাছপালা বুকে নিয়ে পাহাড়ি পথ এঁকে নিশ্চুপ ।নীচে মায়ের মন্দির টি নতুন রংয়ে রাঙানো, ঝকঝকে-তকতকে ।নিগমের বাংলোর সামনে ত্রিপল টাঙানো পুরনো হোটেলটিও নেই ।কিন্তু বছর দশেক আগে আমরা পাঁচ বঙ্গ পুঙ্গব প্রথমে এসে ওখানেই ডাল-রোটি-আচার খেয়েছিলাম ।তৃপ্তিটা মনের মণিকোঠা থেকে মুখ বাড়ালো।একটু নীচে সূর্য-কুন্ড।রামধনু ওঠে সকালে ।রোজ।এতো জোরে জলের রেণু রেণু হয়ে যাওয়াটা সূর্যের আলোয় বেণীআসহকলায় পরিণত হয় ।
“ম্যাডাম, সামাল কে–” শ্যামলী হড়কে গিয়েছিল।রাম সিং কিছুটা বুড়ো হলেও ভোলেননি আমাদের ।এরপর নানা কথামালায় ভরে উঠলেন রাম সিং।ওঁর গাইড জীবনের রামধনু ভেসে উঠলো আকাশে।
“তখন এই বাবুরা ইয়াং থা।কিতনা জোশ,কিতনা ফুরতি।পাঁচ বাবু আর আমি ছয়জন ভোরবেলা রওয়ানা দিলাম ।রাম তেরি গঙ্গা ময়লির শ্যুটিং  হুয়া থা এক ঝরণে কে পাশ।বাবুরা নতুন নতুন গাছে হাত দিতে দিতে যাচ্ছে, মানা করলাম ও গুলো বিষ,ওগুলো খেলে মরতে হবে ।ভূজবাসা-চীরবাসা পার হয়ে চড়াই ভেঙে হাঁফাতে হাঁফাতে  লালবাবার আশ্রম–ঐ দূরে গোমুখ–বরফের হাঁ মুখ থেকে খরস্রোতা শিশুগঙ্গা দামাল পায়ে দৌড়ে আসছে যেন ।সামনের পাথরের চাতালে এক সিদ্ধ পুরুষ, ঋজু, স্থির ।নিমীলিত নয়নে।
পরের দিন গোমুখ পেরিয়ে সিমলিবাবার আশ্রম ।তপোবন।ওখানে গরমাগরম খিচুড়ি, ঘি।একটু দূরেই চতুরঙ্গ হিমবাহ ।
বিকেলে ফের
ফেরার পথে বরফের চাঁই খসে পড়া-আমাদের একজনের মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া এসব গল্প

গড়গড় করে বলতে লাগল
শ্যামলীকে।
আমি তখন বললাম -তোমার মনে পড়ে সেই ঘটনার কথা?আমরা তখন ফিরেছি গোমুখ থেকে ।তুমিও সঙ্গী-পথপ্রদর্শক ছিলে।তুমি বখশিস চাইলে দু’টাকা ।আমি ছিলাম ক্যাশিয়ার ।তখন তো আমরা বেকার ।আমি দিলাম কুড়ি টাকা ।তুমি টাকা নিয়ে দে দৌড়। ভাবলাম, কি লোভী তুমি ।বিদায় ও জানালে না।এই দুদিনের তোমার প্রতি সুন্দর ভালোবাসা-শ্রদ্ধা মিইয়ে গেল ।বিষন্ন মনে সূর্যাস্ত হল।বাস তখন হর্ণটা দিচ্ছে ।কন্ডাক্টর শশব্যস্ত ।আমরা বলছি-বিদায় গঙ্গোত্রী ।বাস নড়ে উঠল  ,গড়াতে শুরু করলো ।হঠাৎ একটা দশ টাকার নোট সহ খুচরা আটটি টাকা আমার কোলে এসে পড়লো,আমি জানলার পাশে বসে ছিলাম ।মাথা বার করে দেখি তুমি ।চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যাচ্ছো।চোখে জল এসে গেল ।কে লোভী? তোমার কাছে ক্ষমা চাইলাম মনে মনে ।এতো দিন পর তোমায় দেখে মনে পড়লে সব।তুমি তো এসব জানতে না।আজ তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ।
রাম সিং এর চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না।
“বাবু,সামাল কে।”রাম সিং এর বজ্রমুঠিতে আমার হাত ।পা পিছলে গিয়েছিল আমার ।নীচে অথৈ গহ্বর ।ওর টানে বিপন্মুক্ত হয়ে দেখি আমার মতো রাম সিং এর চোখে ও জল।নাকি মুক্তোর দানা!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।