• Uncategorized
  • 0

ভ্রমণকথায় সন্দীপা বসু

পাহাড়, জঙ্গল, পলাশ আর দীঘা

বন্ধুরা বলে আমার নাকি জঙ্গলে থেকে যাওয়াই ভালো। শহরে বেমানান আমি। মুখে তাদের গাল দিলেও মনে মনে মেনে নিতে বাধ্য হই। দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ সব। শহুরে মুখোসের আড়ালে আমার আসল মুখটা দেখে নিয়েছে ঠিক।
আমার মাথার ভেতর জঙ্গল তার শিকড়বাকড় ছড়িয়েরাজপাট নিয়ে জাঁকিয়ে বসে আছে। এমন রাজপাটের নিজস্ব এক দাপট আছে। তেমন তেমন জমি, সুবিধে বুঝে ঠিক আবিস্কার করে ফেলে আর নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটায় অনায়াসে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে দখল নেয় নিজের জমির। সেখানে নিশি ডেকে যায় প্রহরে প্রহরে – অগ্রাহ্য করি, এমন সাধ্য নেই আমার।
মার্চের শুরুর দিকে সে ডাক প্রবল হয়ে উঠল। শহরটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললাম “রইল ঝোলা, চলল ভোলা” আর ন্যাশনাল হাইওয়ে ৬ ধরে লম্বা ছুট। মাঝে বার দুই এর ছোট্ট বিরতি। ঘাটশিলা পৌঁছতে দুটো বেজে গেলো। চার ঘণ্টার পথ ছয় ঘণ্টা লাগলো। খড়গপুরের পর থেকে রাস্তার কাজ চলছে। সরু টুলেন থেকে প্রসারিত ফোরলেন। ঘাটশিলা পর্যন্ত দেখলাম কোথাও কাজ থেমে নেই। শুনলাম ওপাশেও একই ব্যাপার। তবে যেরকম দ্রুতগতিতে কাজ চলছেতাতে পরের বার বেশ আরাম করে ঘণ্টা তিনেকেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।
ঘাটশিলা থেকে হাইওয়ের উল্টো দিকেতেরো কিলোমিটার দূরে ছোট ছোট পাহাড় ঘেরাসবুজ এক গ্রাম – দীঘা। আদিবাসী গ্রাম আর প্রকৃতি ছাড়া এই তেরো কিলোমিটারের মধ্যে আর কিছু নেই। কোনও চায়ের দোকানও না। এপাশটায় শহর তার থাবা বসায়নি এখনও। জানিনা আর কতদিন এমন থাকবে।
বাগানঘেরা রিসোর্টটি ছোট্ট, সুন্দর। যত্নে সাজানো বাগানে নানা রঙের ফুলের মেলা। মখমলি নরম সবুজ ঘাসের গালিচাতে পা ডুবে যায়। বাগান থেকে পাহাড়, আকাশ একটু দূরে জঙ্গল – দৃষ্টি বাধা পায়না কোথাও। আমার মাথায় কয়েক শতকের মহীরুহের রাজপাট। মনে হলবাগানটা প্রকৃতির হাতে তৈরি হলেযথেচ্ছ জঙ্গুলে হলেই বেশী ভালো হত। 
একটু দূরে ধারাগিরি ফলস। শুনলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি এখানেই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেরাতেন, বসে থাকতেন ঝরনার পাশটিতে। জঙ্গল-পাহাড়ের সাথে আমার ভালোলাগালাগি এঁর ঘটকালিতেই শুরু। সে ভালোলাগা আজীবনের প্রেম হয়ে ওঠে বুদ্ধদেব গুহর সাহসী প্রশ্রয়ে। কিন্তু সে গল্প পরে, অন্য কোনও সময়। আপাতত আদিমশহুরে ছোঁয়া বর্জিতকুমারি জঙ্গলের গাঁয়ের গন্ধ নিতে নিতে হাঁটতে থাকি পায়ে চলা শুঁড়ি পথ ধরে, শুকনো পাতাডালউই ধরে ভেঙে পরা শালের গুঁড়ি পেরিয়েশুকনো নদীখাতের পাথরে পা রেখে। মাথায় কাঠ নিয়ে পাশ দিয়ে চলে যায় আদিবাসী মেয়ে। কাঁখের শিশুটির হাতে নাম না জানা ফল। পাশ দিয়ে যাবার সময় আনমনে বড় বড় চোখে তুলে তাকায়। তারপর হঠাৎই ফিক করে হেসে মায়ের আঁচলে মুখ লুকোয়। সব ভুলে তাকিয়ে থাকি সেই অপার্থিব সারল্যের দিকে।
বাঁক ঘুরতেই জলের শব্দ। সামনেই ধারাগিরি। কোন পাথরটায় বসতেন তিনি? কোনটায়? আমিও বসি খানিক… সময়ের হিসেব ভুলে যাই। ফিরতে হবে মনে হতেই মাথার ভেতর পাগলা হাতির দাপাদাপি। শিকল ভাঙতে অক্ষম, তবু মরিয়া এক প্রচেষ্টা
ফেরার দিন সকালে মনে হল এই তো চৈত্র মাস। পাহাড়জঙ্গলে আগুন লাগার সময়। না দেখেই ফিরে যাবোঅতএব রাস্তা বদল। ন্যাশনাল হাইওয়ে তে উঠে কলকাতার উল্টোদিকে মুখ ঘোরালাম। ঢুকে গেলাম পুরুলিয়া জেলায়। মাখনমসৃণ পথ ধরে দুয়ারসিনি হয়ে বান্দোয়ান পেরিয়ে বাঁকুড়া – চোখ ঝলসে দিল পলাশ আর শিমুল। লাল হয়ে আছে দিগ্বিদিক। পাগল করা লাল। নেশা ধরানো লাল। ঘুণপোকার মতো মাথার ভেতর কুড়ে কুড়ে বাসা করে নেওয়া লাল। বার বার গাড়ি থামিয়ে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছি – শুধু দুচোখ মেলে দেখব বলে। তবু যেন আশ মেটেনা।
বাঁকুড়া শহর আসতেই সব কেমন ঝিমিয়ে গেল। দুর্গাপুর ব্যারেজে উঠে মনে হল … নাঃ আর কিছু মনে হলনা। মনে হবার মতো মনটাকেই ফেলে এসেছি জঙ্গল পাহাড়ে, শুকনো নদীখাতে, তিরতিরে ঝরনায়, নেশা ধরানো লাল পলাশে আর অনাবিল সরল হাসিটুকুর কাছে।
শহর আমার নয়…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।