ভ্রমণকথায় রুমা পণ্ডিত

অযোধ্যা ভ্রমণ

আমাদের গাড়ি যখন বাঘমুন্ডি পৌঁছলো তখন দুপুর দুটো পেরিয়ে গেছে।মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম হোটেলটা হয়তো পাহাড়ের কোল ঘেষে হবে, কিন্তু না, এক্কেবারেই নয়, একটি ছোট্ট মফস্বলের ছোট্ট বাজারের গা ঘেষা হোটেল।একটু দমে গেলাম।যাইহোক দুপুরের খাওয়া সেরে আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাছের দর্শনীয় জায়গা গুলো ছুঁয়ে নিতে।গাড়ি কয়েক মিনিট ছোটার পরেই চোখে পড়লো পাহাড় আঁকা দিগন্ত,  ছোট ছোট পাথুরে টিলা আর সবুজ পাহাড়ের অপরূপ যুগলবন্দী।গাড়ি এসে থামলো খয়রাবেরা ড্যামে। গাড়ি থেকে নেমেই বাকরুদ্ধ হলাম ড্যামের সৌন্দর্য্য দেখে।যতো দূর চোখ যায় শুধু প্রকৃতির মোহময়ী রূপ।পর্যটক একটিও  নেই, স্থানীয় একটি দুটি রাখাল, আর তাদের সাথে গরু ছগলের পাল।সূর্য তখন পাততাড়ি গুটিয়ে পশ্চিম মুখো।অল্প আলোয় পাহাড়ের ছায়াকে ধরে রেখেছে ড্যামের স্থির জল।কতো রকম পাখির ডাক! চুপ করে শুনলাম প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা।মন গুনগুন করে উঠ, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,ঘর হোতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…”
আলো থাকতে থাকতেই সেই সৌন্দর্য্যকে যতটা সম্ভব তুলে রাখলাম মোবাইল ক্যামেরায়।অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগেই আমাদের দেখে নিতে হবে আরেকটি ড্যাম।আমাদের ড্রাইভার, বিমল ভাইয়ের তাড়ায় পরের গন্তব্যে ছুটলো গাড়ি। থুরগা ড্যাম, অসাধারণ রূপ তারও, সন্ধ্যার পাতলা চাদরের ঢাকা নির্জনতাকে অনুভব করলাম। জলের ওপারে জমাট বাঁধছে অন্ধকার, এপারে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা, মাঝখানে ডানা মেলছে কবিতার অক্ষর।

অযোধ্যা সফরের দ্বিতীয় দিন, হোটেলের ম্যানেজার দশ বারোটি গন্তব্যের লিস্ট ও রাস্তার মোটামুটি একটা ছক বলে দিলেন।তিন মা মেয়ে ও ড্রাইভার বেরিয়ে পড়লাম।দুর্গাপুর থেকে সটান গাড়িতেই গেছি, এবং আমাদের ড্রাইভার_ বিমল কখনো অযোধ্যা যায়নি,তাই রাস্তা যেখানে দুই বা তিন ভাগ হয়ে আমাদের দিকে রসিকতার নজরে তাকাচ্ছিল,আর ফোনের টাওয়ার বিভ্রাটের জন্য গুগল দিদিও হেঁচকি তুলছিলেন তখন চারজনের চোখই কোনো এক স্থানীয় পথচারীর খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল।তাঁদের নির্দেশিকায় প্রথম চারটি স্পট দেখে, পৌঁছে গেলাম আপার ড্যাম।আপার ড্যামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গেলাম,কী মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! কাচের মতো স্বচ্ছ জল আর তাতে সবুজ পাহাড়ে ছায়া ,ব্রিজের এক পাশে লম্বা লম্বা শুকনো হয়ে যাওয়া হলুদ ঘাস,রাস্তার ধারের ধারে সাদা পাথর, যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ল্যান্ডস্কেপ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।! এমন দৃশ্যের অঙ্গ হতে পেরে আমরাও ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।নানান অঙ্গভঙ্গি করে(আর কোনো পর্যটক না থাকার সুযোগে) খান পঞ্চাশ ছবি তুলে, মায়ের তাড়ায় খুব কম ছবি তোলা হলো এই আফসোস করতে করতে পরের গন্তব্য “কাঠের দূর্গা মন্দির” এর দিকে রওনা হলাম।রাস্তার দুপাশে  সাজানো আদিবাসী গ্রাম দেখে মুগ্ধ হতেই হবে।ঘরের দেওয়ালে হরেক রঙের নক্সা, নিকনো উঠোন, কোলে কাঁখে ছেলেপুলে নিয়ে মায়েদের গৃহস্থালি ব্যস্ততা, পালিত পশু পাখিদের যাপনচিত্র মন দিয়ে দেখতে দেখতেই গ্রাম পেরিয়ে জংগলে।এদিক ওদিক ঘুরে বুঝলাম কাঠের দূর্গা মন্দির দেখতে গেলে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে, গাড়ি যাবে না,অগত্যা একটি মাঠে গাড়িটা রেখে স্থানীয় মানুষদের দেখানো পথে পা বাড়ালাম।কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো দুটি ঠাকুমা রাস্তা দুধারে বসে রোদ মাখছে আর গল্পে মেতে আছে, ছ সাত বছরের নাতিটি খেলা করছে নিজের মনে।ছেলেটিকে মন্দিরের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে দু হাতে তার ঢিলা প্যান্টটি ঠিক করে নিয়ে,অবিলম্বে তার ছোট্ট কাঁধে আমাদের চারজন প্রাপ্তবয়স্ক পর্যটকের দায়ীত্ব নিয়ে এগিয়ে চললো, আমরাও হাঁফ ছেড়ে তার পিছু নিলাম।মন্দির দর্শন শেষ করে ওর কাছে সীতা কুণ্ডের রাস্তা জানতে চাইলে সে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললো, “ইদিকেই বঠে, ঠায়, বেশী ধুর লয়, আসো আমার সঙে”।
যাক বাবা! রাস্তা খুঁজতে হবে না, খুদে গাইড আমাদের পথ দেখাবে।
তো সেই গাইডের( নাম সঞ্জীত মুড়া) পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম।দু পাশে ধান জমি, মাঝে আলপথ।অপরূপ দৃশ্য, সোনায় মোড়া ক্ষেত দুপাশে, যতই এগোচ্ছি পথ সরু হয়ে যাচ্ছে, আর তারপরে হঠাৎ  ঢালু! সেই গাইড তো প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাচ্ছে, তার পেছনেই আমার মা আর বিমল এমন ভাবে চলছে যেন কোনো অসুবিধাই নেই, বিপদে পড়ে গেছি আমি আর আমার মেয়ে।তার ওপর মায়ের ডাক,” রুমি তাড়াতাড়ি আয়,পরে ছবি তুলবি।”
কোথায় ছবি! রুমি আর রুমির মেয়ে ডোনা তখন হাত ধরাধরি করে কে, কোন পা, কোথায় আগে রাখবে তার মহড়ায় ব্যস্ত।আমার অল্প হিল আর ডোনার ঝিকিমিকি শু তখন পা থেকে হাতে উঠে এসেছে।অনেক কায়দায়, কিছুটা হড়কে, কিছুটা ছেঁচড়ে যখন ঢালু অতিক্রম করে জয়ের হাসি হেসে সামনে তাকালাম তখন পাঁচ হাতের মধ্যে আগের চেয়েও বড় গর্ত আর প্রজাপতি সহ মা বাইশ হাত এগিয়ে গেছে। এর পরের প্রশ্ন হলো সীতাকুণ্ড দর্শনের পর এই এডভেঞ্চারাস পথেই কি ফিরতে হবে? সর্বনাশ!!
গর্ত, ঢালু, ঝোপ, কাদা সহ দীর্ঘ পথ ( গাইড বলেছিল ঠায়!) পেরিয়ে যখন সীতাকুণ্ডে পৌঁছালাম, তখন আমরা মা মেয়ে যেন সার্কাসের  বিধ্বস্ত  খেলোয়াড়,আমার মা আর বিমল এক স্নান রত গ্রামবাসীর সাথে গল্প জুড়েছে,আর প্রজাপতি অবাক চোখে আমাদের দুই মা মেয়েকে জরিপ করছে,তার চোখের জিজ্ঞাসা হলো,”এই সামান্য পথে এমন গলদঘর্ম  অবস্থা!” যাইহোক, সীতাকুণ্ডের বাহ্যিক রূপ দেখে কিন্তু বেশ হতাশ হলাম।বাইরেটা পাথরে বাঁধানো একটা কুয়োর মতো আর ভেতরের গভীরতায়, একটা চৌবাচ্চা। কিন্তু বিশেষত্ব হলো যে কোনো ঋতুতেই কুণ্ডে একই জল থাকে, একটা পাইপ দিয়ে অনবরত জল বেরিয়ে যাচ্ছে,তাতেই আশেপাশের দু তিনটি গ্রামের প্রয়োজন মেটে।জল নাকি কমে না।এক স্থানীয় গ্রামবাসীর কাছে গল্প শুনলাম, বহু বছর আগে বুদ্ধপূর্ণিমায় শিকার পরবের পর কয়েকজন শিকারী এই কুণ্ডের কাছে বসে শিকারের মাংস আর হাড়িয়া খেয়ে হাত পা ধুতে এসেছিল এই কুণ্ডে, তারপর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, এই কুণ্ডেই নাকি তারা তলিয়ে গেছে।দেখতে যতই সাধারণ হোক, সীতাকুণ্ড রহস্যময়ী, অসামান্য।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফিরে এলাম “অন্য ” পথে, সেই কৃতিত্বও ওই প্রজাপতির।পথে অনেক গল্প হলো তার সাথে।সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে আর মহার্ঘ্য অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাদা হলাম আমরা।ভালো থাকিস প্রজাপতি, এই প্রকৃতির কোলেপিঠে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠ।
পরের গন্তব্য বামনি ঝোরা, চাকা ঘুরলো।

বামনি ঝোরার পথেই পড়লো ময়ুর পাহাড়,এই পাহাড়ে ময়ুর দেখা যায়, তাই এই নাম।তারপর দেখলাম মার্বেল লেক।সাদা ধবধবে অভ্র মেশানো ঝিকমিক পাথর ঘেরা লেক, পূর্ণিমা রাতে নির্ঘাত জলপরীদের ঝাঁক নামে!
বামনি ঝোরা, এইখানেই বেশ কিছু পর্যটকের ভীড় দেখলাম, টুকিটাকি উপহার সামগ্রী আর চা বিস্কুটের   দু চারটি দোকানপাটও। কোন দিকে এগোবো ভাবতে ভাবতেই একজন ষাটোর্ধ্ব  স্থানীয়  ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলেন সাহায্যকারী লাগবে কিনা, সামান্য ঝোরা দেখতে সাহায্যকারী? বিলকুল না করে দিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ফিরতি পথের পর্যটকদের মুখ, অর্থাৎ যারা ঝোরা দর্শন করে ফিরে আসছে।তাদের গোল গোল চোখ ও বুকের অস্বাভাবিক ওঠানামা দেখে এবং নাভিশ্বাস মেশানো দু একটি বাক্য শুনে তড়িঘড়ি সেই ষাটোর্ধ্বকে ডেকে নিলাম।তার পিছু পিছু এক মিনিট চলার পরই বুঝলাম কী ভয়ঙ্কর পথ! মন তখন তারস্বরে চিৎকার করে বলছে গোটা ভারতবর্ষের কতো বড় বড় নামীদামি ঝর্ণা দেখেছি, এটা আর এমন কি, পেছন ঘুরে পালাই! মগজ তখন হিসেব কষছে, টাকাপয়সা খরচ করে এলাম, একবার দেখবো না! সাত পাঁচ   ভাবতে ভাবতেই পা বাড়াচ্ছি।পাথুরে সিঁড়ি,  বেশ ঢালু, এক পা রেখে আরেক পা টেনে আনার সময় আগের পায়ের ওপর ভরসা বিন্দুমাত্র থাকছে না, অগত্যা গাইডের দিকে হাত বাড়াচ্ছি।কিছু দূর গিয়ে মা বসে পড়লো। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা নেই, মায়ের দায়িত্ব নিই কি করে, তাই মায়ের সিদ্ধান্তকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলাম অষ্টাদশী  মেয়েকে নিয়ে। ওই পথেই যারা উঠে আসছিল তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাবধান বাণী, “দুর্বল মানুষদের না ওঠাই ভালো”, শুনে নিজেকে ভয়ংকর দুর্বল মনে হতে লাগলো। যাইহোক এক সময় এসে দাঁড়ালাম ঝোরার সামনে, অপরূপা সে, চঞ্চল অথচ ভীষণ সরলতা নিয়ে  ঝরঝরিয়ে চলেছে।ফেনার মতো জলের কুচি এসে আদর বুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে রইলাম মুগ্ধ হয়ে, তবে মনে সেই আতঙ্ক, এবার ফিরতে হবে ওই পথেই, মাঝরাস্তায় মা বসে আছে। ছবিতেও আমাদের আড়ষ্টতা বন্দী হলো।  সময় নিয়ে ধীরে ধীরে যখন গাড়ি অবধি এলাম তখন হৃৎপিণ্ড পেন্ডুলামের মতো দুলছে যেন। ষাটোর্ধ্ব বলিষ্ঠতার মুখে তখনও হাসি।তার পাওনা মিটিয়ে, অসংখ্য ধন্যবাদ আর স্যালুট জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।