ভ্রমণকথায় অরণ্য দেব

ম্যাকলয়েডগঞ্জ

চলমান সময় আর ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ভালো লাগে আপাদমস্তক চরৈবেতি, কোঁচড়ে জলের বোতল আর বগলে শুকনো চিঁড়ে-কম্বল বাগিয়ে পুজোর ছুটিতে সদলবলে ৪ দিনের পুরী কিম্বা ৬ রাতের মানালি ভ্রমণ সেরে ফিরতি ট্রেনের বাঙ্কারে বসে ‘আমি কত ভারতবর্ষ জানি’-র আম বাঙালি সমীকরণ অবশ্য এই বান্দার কম্ম নয়। বেরিয়ে পড়াটাকে অবশ্য কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কিছুদিন পর পর না বেরলে আমারও আমবাত হয়, তাই আপাতত বেশ কিছুদিন ঘুরে ফিরে এসে এই উপনিষদ লেখায় মন দিয়েছি, পাঠককুল কতটুকু রস বা দৃষ্টিসুখ পাবেন, সেটা অবশ্য নিজ নিজ কর্মফল।
অশান্ত অশান্ত লাগে আজকাল মাঝে মাঝে। কী করি কোথায় যাই কাকে শুধোই… ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো ম্যাকলয়েডগঞ্জ। বহুদিন আগে শোনা বন্ধুবরের মুখে সেই অলৌকিক নগাধিরাজের কোলে শান্ত জনপদের আদিম ডাক যেন নিঃসঙ্গ সম্রাটের উদাত্ত আহ্বান।
আদিম নিঝুম জঙ্গল । নিশুতি রাতের আঁধারে থমকে থাকা সময়। রাত খান খান করে ভেসে আসা নিশাচর পাখির তীক্ষ্ণ ডাক শিহরণ জাগায়। সেখানে কোনও লাল চোখ নেই, কোনও কড়ি বরগা নেই, নেই কোন আইনি কাগজ-দস্তাবেজ। আছে শুধু জংলি উদারতা, মাটির দেওয়াল দেওয়া ঘরের লোকগুলোর মিষ্টি আতিথেয়তা, কিছু দলছুট ধুসর বাদামি খরগোস, ইন্ডিয়ান লেপার্ড আর কিছু চ্যাপ্টা চোখের শান্ত হাসির অনুমোদন।

ধরমশালা হয়ে সোজা ম্যাকলয়েডগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় চোখে পড়ে কিছু প্রাচীন গথিক ব্রিটিশ স্থাপত্য। ঝুলে পড়া পুরাতন গথিক ভাস্কর্যের আশ্চর্য রাজপ্রাসাদ। যেন নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বলছে— এসো দেখো আমার সৌন্দর্য্য, আমার কৌমার্য। হাত-নাগালের দূরত্বে গিরিরাজের শান্ত-সমাহিত রূপ যেন মনুষ্যজাতির অহংকার চূর্ণ করার মূর্ত প্রতীক। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না সেই নগ্ন সৌন্দর্যের দিকে। ধূমায়িত পর্বতশ্রেণি শুধুই রক্তে ঠান্ডা আগুন ঢেলে দেয়।
সকালের সূর্যে আগমনি গান। হাজার জংলি পাখির সরগম চরম বেরসিককেও নিয়ে যাবে অসীমের কোলে, অনন্তের কিনারে। নাম না জানা নীলচে রঙের টুনটুনির স্বামীসোহাগী হওয়ার কাতর প্রচেষ্টা আর পাহাড়ি বাচ্চার কোলে পোষা মুরগীর খুনসুটি মনে পড়াবেই শৈশব। বেলা বাড়লেই উড়ো মন ছোটে বিলিঙ্গের দিকে (ছোট জনপদ, উদ্দেশ্য উড়ে বেড়ানো )। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে স্বর্গীয় জীবন দর্শন, অনেক উঁচুতে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। সামনে হিমালয়ের উত্তুঙ্গ হাতছানি যেন নেশা, নীচে, অনেক নীচে খেলনাবাটির সংসার।

বিলিঙ্গ থেকে সোজা ফুসমন্তর হতে বেশি সময় লাগেনা। ঘন্টা চারেকের চড়াই হাঁটাপথ শেষ হয় ত্রিকুণ্ডে এসে। পথে প্রায় হাফ ডজন অজানা গুহা, গুম্ফা আর পাহাড়ি গ্রাম। অতিথি আপ্যায়নের যে সীমা আমরা শহুরে জীবনে দেখতে অভ্যস্ত, তাকে হেলায় তুড়ি মারতে পারে এখানকার আথিথেয়তা। সেখানে কোনও রকমের ছুঁৎমার্গ নেই। যেন বহু দিনের পরে মা সাজিয়ে রেখেছেন ছেলের প্রিয় রান্না। চোখে জল আসে পাহাড়ি সন্ন্যাসীদের জীবন দর্শন আর জীবনের উৎস সন্ধানের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা দেখে।
শেষ বিকেলের মরা আলোয় হিমালয়ের কোলে শান্ত পাইনের শিনশিনে আওয়াজ আর মোমের আলোয় সমাহিত তথাগতের সামনে নতজানু জীবন জানতে চায় সৃষ্টির আদিম রহস্য। আধুনিক শহর থেকে দূরে পাহাড়ের কোলে সন্ধে নামে ধীরে কিন্তু বড় তীব্রভাবে। খড়ের বিছানায় বসে শ্বশ্রূগুম্ফ-বৃদ্ধ জানায় সেই কোন যৌবনের কাহিনি। ইংরেজরা তখন দেশ ছাড়ছে। সেই সময়ে মনে রঙ ধরিয়েছিল কোনও এক সাহেবে-দুহিতা। কথা হয়েছিল সপ্ত সাগর পেরিয়ে চিঠি আসবে। এতটা পথ পেরিয়ে চিঠি পৌঁছনোর আগেই পাহাড়ে শুরু হয় পর্ণমোচির পরব, হলুদ পাতার সঙ্গে সঙ্গেই সেই চিঠি আজও হয়তো উড়ে বেড়াচ্ছে কোনও পাহাড়ের চুড়োয়। সেদিনের পাহাড়ি জোয়ান আজ ন্যুব্জ। কিন্তু মনের মহলে আজও ঠিকরে বেরয় প্রেম, কখনো মানুষ কখনো বা সেই সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে।

রাত গভীরে হিমালয় উভিন্নযৌবনা। রাশি রাশি থকথকে তুলোর মতো বরফে যেন সদ্য স্নান সেরে আসা ষোড়শী। অপাপবিধ্যা এক ক্লাস নাইন। টঙের মাথায় পত পত করে ওড়া ভগবান বুদ্ধের নামাঙ্কিত লাল নীল খয়েরি পতাকা যেন তার অতন্দ্র প্রহরী। ভোর হতে বেশি সময় লাগে না, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেয় অরুণ আলোর কুণ্ড, রক্তপলাশের সেই অগ্নিকুণ্ডের সামনে যেন সেই রাতের দেখা কিশোরী আত্মসমর্পণ করে সকলের অগোচরে। তাদের মিলনে লেখা হয় আর এক নতুন দিনের ঠিকানা। কলরব করে ওঠে ডানা। পায়ের কাছে ছুটে যায় পাহাড়ি বেজি, তীব্র বেগুনি গন্ধ ভরা অপরাজিতা মাথা দোলায় শিশিরসুখের আনন্দে।
ফিরতি পথে শরীরে লেগে থাকে অজানা এক প্রেমের ছোঁয়া। পাকদণ্ডীর বাঁকে পিছন ফিরে আবার দেখা সেই ফেলে আসা গুম্ফা, যেন বুকে টেনে নেওয়ার জন্য উদাত্ত হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক অপরূপ পুরুষ। উপেক্ষা করা যায় না তাকে। ভোলা যায় না তার জীবনের ইতিকথা। এক রাতের স্নিগ্ধ প্রেমের ছোঁয়ায় কঠোর মনকেও ভার করে দেয়। ভালো লাগার রেনু গুলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে দেয় দিল্লীর দ্বোয়ার্কা সেক্টর দশের এক ফ্লাট বাড়ির খোপে। সে গল্প আর এক দিন। ততদিন সবাই ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন। ভালো থাকার গুরুমন্ত্র হোক চরৈবতী ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।