বৈঠক ৩৪ এর গল্পে রামামৃত সিংহ মহাপাত্র

দেবী

ভর করলে তুই মানুষ থাকুস নাই দেবতা হয়ে যাস’ কথাটা বহুজনের কাছে শুনেছে পুতুল।ভর রোজ নামে না,নামে পয়লা মাঘ গেরাম থানে পুজো দেবার দিন।শুকনাখালি গ্রাম থানের লায়া ওর বাবা মার্শাল মাঝি ।পুরষানুক্রমে পুজো করে আসছে ওরা।ওর বাবা পুজারী হলে কি হবে,পুজো দিতে আসে গ্রামের প্রায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষ।ওদের গেরাম দেবতা জাগ্রত।মানত করে কাউকে ফেরত যেতে হয় না।এখন আরও বেশি জাগ্রত হয়েছেন দেবতা,যে বছর থেকে ভর নামতে শুরু করেছে পুতুলের সেই বছর থেকে।ঐ বছর সোয়ামী বাদলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে বাপের বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকতে চলে এসেছিল পুতুল। মা বলেছিল,’অশান্তি কুন সমসারে নাই,তা বইলে সমসার করবি নাই?’
-না করব নাই।ঐ শালা মাতালের সনে ঘর করা যায় নাই।উয়াকে বিয়া করে জীবনটো আমার লরক হয়ে গেছে।
-বিয়া ত কেউ দেয় নাই,যাচে পালাইনছিলি।তখন মানা করেছিলাম। কথা গুলান কানে লিলে আইজ তোর এই দশা হত নাই।ওর বাবার কথায় থমকে যায় পুতুল। কথা বলে না। অনেকক্ষণ পর কাটাকাটা ভাবে জিজ্ঞাসা করে, ‘ই ঘরে থাকতে দিবে ন ,নাই’
-থাক ন।কে মানা করেছে।ইটো ত তুর ঘরও বটে।বিটিকে আর কবে বাপ মা  পর করেছে।
সত্যিই তো ওর বাবা মা পর করে নি ওকে।পর তো ও নিজেই হয়েছে।চন্দ্রকোনা মাসি বাড়ি থেকে কলেজ যাবার সুবিধা হতো ওর।কলেজ যাবার পথেই আলাপ বাপির সঙ্গে। নিজের গাড়ী চালায়।দুহাতে টাকা ওড়াতো পুতুলের পিছনে।কম বয়সের আবেগে মনে হতো বাপিকে ছাড়া বাঁচবে না।ওর আসল রূপ প্রকাশ পেল বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। নেশার চোটে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলো গাড়ীটা।রোজগার বন্ধ হয়ে যাবার পর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো পুতুলের উপর বাপের বাড়ি থেকে টাকা পয়সা আনার জন্য। রাজী হয়নি পুতুল, ‘বাপ মায়ের মানাতেও তুমার সঙ্গে বিয়া করইছি।এখন উয়াদের কাছে হাত পাইতব কেমন করে?’হাত পাততে না পারলেও এসে দাঁড়িয়েছিল বাপ মায়ের কাছেই।
ফিরে আসার বছরই ঘটলো ঘটনাটা।গেরাম থানের পুজো সেদিন।সকাল সকাল বাবা মায়ের সঙ্গে হাজির হয়েছিল পুতুলও।পাঁচমুড়া থেকে হাতি ঘোড়া কিনে এনেছিল পূজার জন্য। কঁচড়া তেলে ঘসে চকচকে করে বেদিতে রাখে হাতি ঘোড়া গুলো।পুজো উপলক্ষে বড় মেলা বসে।মুরগী লড়াইয়ের আখড়া হয়।আখড়ায় যাবার আগে হাউসীরা দেবথানে মানত করে যায়।কাতকার রা দেবথানে কাত ঠেকিয়ে মানত করে, বাজিমাত করতে পারলে,রোজগারের অর্ধের তোমার।ঢান্ডির আসর বসে।ঢান্ডিতে টাকার ঢালার আগে সকলে হাত পেতে প্রার্থনা করে উজাড় করে দিও ঠাকুর ।ঠাকুর  কাউকে বিফল মনোরথে ফেরান না।কিছু না কিছু দেন।এটাই বিশ্বাস আর বিশ্বাসই শুকনাখালির দেবথানে  ভিড় জমে।সেদিনও ভীড় জমতে শুরু করেছে। মানসিকের হাঁস,মুরগী, পায়রা আসতে শুরু করেছে।পুজোতে বসে গেছে পুতুলের বাপ মার্শাল মাঝি।ধুপ ধুনোর গন্ধ,ঢাকের শব্দ, বলির রক্ত কেমন বিবশ করে তোলে পুতুলের শরীর টা।ধরে রাখতে পারে না নিজেকে।মুখে একটা গোঙানি শব্দ তুলে উল্টো পড়ে দেবথানে।ভয় পেয়ে যায় ওর মা।আশ্বস্ত করেন ওর বাবা, বলেন,’জোরে জোরে ঢাক বাজা,দেবতা ভর করেছে।’কিছুক্ষণ পর উঠে বসে পুতুল। আলুথালু পোশাক আর ঢুলুঢুলু চোখে কেমন একটা ঘোর লাগা শব্দে কথা বলে।কথাটা রটে যায় গ্রামে গ্রামে।হাতজোড় করে এসে বসে পুতুলের কাছে,মনে মনে প্রার্থনা জানায়,মানত করে, দক্ষিণা দিয়ে উঠে যায়। রোজগার বাড়ে মার্শাল মাঝির।সারাবছর পুতুল হয়ে থাকলেও ঐ দিন সে দেবী।কানাই মাঝি পাক্কা হাউসী মুরগী লড়াইয়ে নামতে যাবার আগে দেবীর কাছে মানত করে জিততে পারলি পেরাইজের আর্ধেক তুমার। সুদের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে ওঠা নিতাই প্রমাণিকের মনে মনে লোভ ছিল পুতুলের শরীর টার প্রতি।এখন কু দৃষ্টি দিতে ভয় পায়।নত মস্তকে হাতজোড় করে দাঁড়ায় পুতুলের সামনে অনাদায়ী টাকা গুলান আদায় করে দাও মা।ছবছর আগে বিয়ে হওয়া টুসু বাগদী মানত করে, ‘ইবার একটা ছানা-পানা দাও মা,আর যে লারছি।’চাকরীর শেষ বয়সে পৌঁছে যুধিষ্ঠির মাহাত মানত করে চাকরির জন্য। ঘোর লাগা চোখে মুখে সারাদিন ধরে সবার চাহিদা শোনে পুতুল। সন্ধ্যা নেমে এলে ফাঁকা হয়ে যায় দেবথান।হাউসীরা আখড়া ছাড়ে মুরগী লড়াইয়ের।ঢান্ডীর সরঞ্জাম নিয়ে উঠে যায় জুয়াড়ী।ফাঁকা হতে থাকে মেলা প্রাঙ্গণ।সব শেষে গোছগাছ করতে ব্যস্ত পুতুলের বাবা মা। ঢাকের বোল বন্ধ হয়ে গেছে, ফিকে হয়ে এসেছে দুপুর ধুনোর গন্ধ। এবার সচকিত হয়ে বসে পুতুল। এবার কান্না এসে চেপে ধরে। আটকাতে পারে না। প্রথমে ডুকরে ডুকরে এবং পরে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে।দেবথানে বসানো হাতি ঘোড়া গুলো নির্বাক চেয়ে থাকে পুতুলের দিকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।