বই নিয়ে আলোচনা -তে ফাহিদা ফারজানা

‘তবুও বসন্ত দিন’ গল্প যখন কথা বলে

গল্প যখন কথা বলে, জীবন তখন জীবন্ত।
জীবন যখন জীবন্ত, গল্প তখন সত্য। কিছু বই থাকে যা বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে,বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। আকাশকুসুম কল্পনা কিংবা যোগসাজশ বিহীন যে গল্প তাই সত্য। জীবনেরই অংশ।
‘তবুও বসন্ত দিন’ এমনই এক সত্যের গল্প। গল্পের সত্যতা আর জীবন যেখানে গতিশীল। চরিত্র যেখানে স্ব-স্ব স্থানে নিখুঁত ও যথাযথ পরিস্ফুটিত।

গল্পে মূল চরিত্র সাইফ। যাকে ঘিরে আবর্তিত বাকি প্রতিটা চরিত্র কিংবা বলা যায়, একে অপরের পরিপূরক হিসেবে অবস্থিত প্রত্যেক চরিত্র।
সাইফকে আমার মনে হয়েছে নব্বই দশকের কিংবা তারও আগের নিখাঁদ অনুভূতি নিয়ে জন্মানো এক যুগ বিভ্রান্ত  যুবক। যুগ বিভ্রান্ত এ কারণে যে, তার  ভাবনার সরলতা, সম্পর্ককে দেখার দৃষ্টি, মমতা ও মায়ার উৎপত্তি ও ধরন,সবটাই যেন ঠিক এ যুগের নয় যে যুগটা তার বর্তমান; যে যুগটা যান্ত্রিক। সাইফ এমন এক চরিত্র যার মাঝে মানবীয় গুণের প্রকাশ ঘটেছে,নিত্য নৈমিত্তিক ধারাবাহিকতায়, স্বাভাবিকত্বে। চরিত্রকে মহৎ করার জন্য কোনো ভাবনা কিংবা আচরণ চাপিয়ে দেয়া হয়নি এই চরিত্রে। যা সাইফ চরিত্রকে করেছে খুব বেশি জীবন্ত সত্য ও ভানবিহীন।
প্রকৃত প্রেম জীবনে নিয়ে আসে শান্তির বার্তা,মায়া ও শীতল ছায়া । যেখানে ক্লান্তি ও ঘটনা-দুর্ঘটনা শেষে মানুষ পায় একান্ত ভানবিহীন আশ্রয়। আর নির্মল আনন্দে পায়  আনন্দিত হওয়ার  অকৃত্তিম মানুষটাকেও।
কিন্তু প্রেম যদি হয় আবেগহীন,যদি হয় সরলতার আড়ালে ঢেকে রাখা কুটিলতা ও অভ্যাসবশত দেয়া মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, তবে সেই প্রেম হয় জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। যে অভিশাপ  কারো জন্য হয় শাপ,কারো জন্য বর। সাইফের জীবনে এমনই এক শাপ  কিংবা বর,  যার নাম  দীপা।দীপা এমন এক চরিত্র যা প্রকৃত নারীর চরিত্রকে করে কলঙ্কিত। দীপারা সমাজে আজ অহরহ। এরা না বোঝে আবেগ,না অনুভূতি। যা বোঝে তার নাম কেবলই নিজ স্বার্থের অন্ধত্ব। আর সেই স্বার্থের অন্ধত্ব যদি তাদের ব্যক্তিত্বহীন নারীতেও পরিণত করে তাতেও তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। বরং ওই ব্যক্তিত্বহীনতাই তাদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক কুৎসিত ব্যক্তিত্ব। আর প্রকৃতির দেয়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সুখ খুঁজে বেড়ানো এই সমস্ত দীপাদের ভাগ্যে কখনো সুখ নামক শব্দটা প্রকৃতার্থে ধরাই দেয় না।কেননা সুখ আপেক্ষিক, যেখানে চাওয়ার প্রাপ্তি ও প্রাপ্তিতে তৃপ্তি; সুখ তো সেখানেই। দীপাদের চরিত্রে তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি বলে কিছু নেই। পূর্ণতা বলে কোনো শব্দ নেই। আর এই শব্দহীনতাই তাদেরকে নৌকাভ্রমণের ন্যায় এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে,আরেক থেকে অন্যতে ভ্রমণ করায় ক্রমাগত এবং দিনশেষে এদের পরিণতি এরা নিজেই নির্ধারঙ করে। কিন্তু  হাস্যকরভাবে এতেও দোষারোপ করে তাদের হতভাগ্য ভাগ্যকে!
আবার ঠিক একইভাবে থাকে রাহাত নামক কিছু সুবিধাবাদী ও অপশনবাদী পুরুষ। যারা ফাঁকা ময়দানে গোল দিতে সর্বাত্মক প্রয়াসী। একই সাথে মানুষ ও বন্ধু হিসেবে নিম্ন শ্রেনির।
বন্ধুত্বের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যে সাইফের জীবনে যে দুটি নাম তার একটি মিলন, অপরটি রাহাত।
রাহাত যেখানে বন্ধুর নামে দৈনন্দিন জীবনকে আরো তিক্ত করার সর্বোচ্চ ভূমিকা নির্ধারণে  হিংসাত্মক খালু কিংবা চাচা, মিলন সেখানে সমস্ত তিক্ততাকে বাস্তবতায় রূপান্তর করে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শেখানোর এক অটল ও ঐশ্বরিক অবতার।
রাহাত ও দীপা এমন এক চরিত্র যাদের জানার পরে তাদের নিয়ে কথা বলতেও মন আর সায় দেয় না, সেখানে মিলন চরিত্র মনের অজান্তেই  ভালোলাগা ও মায়ার একটা শক্ত জায়গা তৈরি করে নেয় মন ও মস্তিষ্কে।
সাইফকে ঘিরে মিলনের মমতায় এই গল্পে  এমনকিছু জায়গা রয়েছে যেখানে বুক চেপে কান্না আসে কিন্তু শব্দ হয় না। ভেতরের সমস্তটা নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয়,কিন্তু উপচে পড়ে কেবল চোখের দু’ফোটা আনন্দাশ্রু!
সময়ের সেরা নাট্যকার আরিফ রহমান।  গল্পের স্বল্প অংশ জুড়ে থেকেও কেমন অদ্ভুত এক ভালো লাগা ছড়িয়ে দিয়েছেন মিলন ও সাইফের জীবনকে ঘিরে তার মনন ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে। পাশাপাশি ছুঁয়েছেন পাঠকমনকে।
“মধ্যবিত্ত সংসারের মায়েরা খুব দুঃখী হয়। তাদের চেহারায় কষ্ট-ক্লান্তির সূক্ষ্ম একটা ছাপ লেপ্টে থাকে।এমনকি বারান্দায় শুকাতে দেয়া তাদের শাড়ির দিকে তাকালেও মনে হয় দুঃখ-দুর্দশার গ্লানিতে ভরা কোনো নিশান উড়ছে।” লেখকের এই কয়েকটি বাক্যেই স্পষ্ট;  মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সঠিক চিত্রায়ন  এই গল্প।
রহমান সাহেব,মমতা বেগম মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা ও মায়ের একটি যথাযথ ও নিঁখুত চরিত্র।
কামরুল সাহেব,সাইফের চাচা এবং রহমান সাহেবের ছোট ভাই, শুরুতে কিছুটা ব্যতিক্রম  ও গল্পে অংশগ্রহণ কম থাকলেও তার প্রতিটা উপস্থিতি ছিল দৃঢ় ও মজবুত। তার স্বল্প সময় ধরে প্রকাশ পাওয়া ব্যক্তিত্ব ছিল প্রভাব বিস্তারকারী সুন্দর এক চরিত্র। তাকে ঘিরে শেষের রহস্যটাও আদিখ্যেতাহীন যথাযথ ছিলো।
সুলতানা বেগম।  কখনো মা না হয়েও  এক মমতাময়ী মায়ের মায়া নিয়ে ঘিরে ছিলেন সাইফের জীবনের অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে। সুলতানা চরিত্র কোনোভাবেই গল্পে অপ্রয়োজনীয় নয়,বরং অপরিহার্যও। গল্পের রসবোধের প্রয়োজনে সুলতানার স্বামী সিপলু চরিত্র বেশ সফল মনে হয়েছে। তার উপস্থিতি একটিবার মাত্র হওয়ার পরেও এই চরিত্র মনে রাখার মতো একটি।
খলিল সাহেব, জুয়েল,রনি এই চরিত্রগুলো গল্পের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ।
সবশেষে বলবো ছোট্ট করে শোভাকে নিয়ে।
শোভা চরিত্রের ক্ষমতা গল্পে এতটাই যে, যা তার স্ব-শরীরী অনুপস্থিতিতেও বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই চরিত্রই সে, যে নিজের কাছেই ছোট হয়ে থাকা সাইফের জন্য এক সম্মানের নাম। যে সম্মান দীপার দেয়া  অসম্মানিত অপবাদের   অপর পৃষ্ঠে প্রতীক্ষা নামক অবস্থান দিয়ে জানিয়েছিলো- সম্মান কিংবা মমতা!
শোভা চরিত্রের শেষের পরিণতি, সাইফ ও তার জীবনের শেষের শুরুর ধরন, মিলনের ভূমিকা এবং দীপার সম্পর্ক নামক নৌকাভ্রমণ- সবটা মিলিয়ে কেমন করে বা সত্যিই কী এসেছিলো সাইফের জীবনে ‘তবুও বসন্ত দিন’ তা সত্যিই মনে ছাপ ফেলে যাওয়ার  মতো এক সমাপ্তি।
সবশেষে বলার, লেখকের প্রকাশিত বই সমূহের মাঝে গল্প ও চরিত্র বুননে,শুরু থেকে শেষ এবং শেষের শুরু থেকে আবার প্রারম্ভিকা,এরই নাম যে জীবন, তা তবুও বসন্ত দিনে ফুটে উঠেছে  সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে।
লেখক গতানুগতিক কেবল নারীর মমতাময়ী দিকটা তুলে ধরার ধারা থেকে বাইরের। পুরুষের চিরায়ত এঁকে যাওয়া যে কুৎসিত রূপ তারও বাইরের। সরলভাবে বলতে গেলে লেখকের গল্পে নারী পুরুষের কেবল একটা দিকই নয়,তারা মানুষ  হিসেবে যে যেরূপে অবস্থান করছে আশপাশ জুড়ে ঠিক সেভাবেই চিত্রায়িত হয় শব্দচিত্রে।
লেখকের অন্যান্য বই সমূহ পড়ে একথা সহজেই অনুমেয় যে ,লেখক রাশভারী শব্দ ও কথার মাধ্যমে গল্পকে বন্দী না করে সাবলীল কিন্তু অল্পতে অনেকটা বলার মত গভীর  সূক্ষ্মতা ও সরলতায় বলে যান জীবনের গল্প। পড়লেই মনে হয়, এ আকাশ  কিংবা পাতাল থেকে খুঁজে আনা অবাস্তবিক কোনো গল্প নয়, বরং এতো আমাদেরই গল্প। ওই তো ওই পাশের বাড়ির,  ওই ওর নয়ত এর। জীবনের কথা, জীবন জুড়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা,বাঁক,উত্থান-পতন,আনন্দ-বেদনা,আশা-হতাশা এর সবটাই থাকে তার গল্প জুড়ে।এমন জীবনঘেষা গল্পগুলোই মনে জায়গা করে নেয় গভীরভাবে। চুপচাপ নিরবে শিখিয়ে যায় শক্ত কিংবা কোমল হতে। দিয়ে যায় বার্তা,জীবনকে বোঝার,জানার ও সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য প্রস্তুতি নেয়ার।  বইটি পাঠকমনে জায়গা করে নেবে নিজ মহিমায়, এই প্রত্যাশা পূর্ণ বিশ্বাসে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।