“প্র্যাকটিস” গল্পে সায়নী বসু

সদ্য ফিজিওলজি তে মাস্টার্স করে উঠেছে সায়নী বসু। ছোটবেলা থেকে নাচ গান আর সব রকম গল্প উপন্যাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসে। তবে ভৌতিক সাহিত্যের ওপর ঝোঁক চিরকালই বেশি। কয়েক বছর নিজেও লেখালিখি শুরু করেছে। পাঠক পাঠিকাদের ভালোলাগাই তার প্রেরণার উৎস।

প্র্যাকটিস

খট.. খট… খট.. খট… খট.. খট
– নাহ্ না এ অসহ্য, এ আওয়াজ অসহনীয়। থাম থাম এবার তুই, আর না, কি চাস আর তুই? কি চাস?
পেশেন্ট নং ৫২ এর তুমুল চিৎকার গোটা ওয়ার্ড ভরিয়ে তুলছে। দৃশ্যটি একটি মানসিক হাসপাতালের সেকিওর্ড ওয়ার্ড এর যেখানে মানসিক ভারসাম্যহীন বিচারাধীন ব্যক্তিদের রাখা হয়।
– স্যার পেশেন্ট আবার চিৎকার শুরু করেছে, থেকে থেকেই থাম আর মারিস না আর খেলিস না এসব বলে চলেছে!
– ওনাকে আরেকটা ডোজ ইনজেক্ট করে দিন।
– ওকে স্যার।
******
২ বছর আগে…
– আরে তরুণ দা যে জন্য ফোনটা করেছিলাম, আপনার ঐ ছাত্র কি বেশ নাম, কি বেশ, ও হ্যাঁ রুবেল, ও তো জিনিয়াস। ওর নামটাই টুর্নামেন্টে দিচ্ছি। হেরে যাওয়ার ভয় থাকবেনা তাহলে।
একরকম জোর জবরদস্তি রুবেলের নামটা এন্ট্রি করিয়ে নিলেন মিঃ রায়। প্রীতমের নামটা মুখেও আনলেন না। আর আনবেন ই বা কেনো! যতই ভালো খেলুক না কেন রুবেলের ধারে কাছে তো যায়না। স্যার হিসেবে ছাত্রের জন্য গর্ব বোধ হয় ঠিকই তবে ছেলেটার জন্য তো ভীষণ খারাপ লাগে। ওই ছেলেটা থাকতে যে আমার ছেলেটা কোনোদিনই নাম করতে পারবেনা। অথচ কী আছে রুবেলের! বাপ নেই, মা অসুস্থ , টুকটাক কাজ করে পেট চালায়, দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় কিনা সন্দেহ তার আবার বড় টেনিস প্লেয়ার হওয়ার সখ! ধুর ধুর, প্রীতম টাকে বলি আরো ভালো করে খেল তা না, অবশ্য প্র্যাকটিস তো ভালই করে, দোষ ও দেওয়া যায়না কিন্তু রুবেলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনা। ওর চোখে এক অন্যরকম উদ্যম দেখা যায় যেটা আর কারুর নেই।
“প্রীতম… প্রীতম”, ছেলের নাম ধরে তারস্বরে চেঁচাতে থাকেন তরুনবাবু। ধড়ফর করে প্রীতম এসে ঢোকে ঘরে। তরুনবাবুর এইরকম রূপ সে খুব কমই দেখেছে, প্রায় দেখেনি বললেই চলে।
– সারাদিন কি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারলেই চলবে? প্র্যাকটিস কে করবে? সবাই তোমার থেকে ভালো খেলে। খেলবে বলে তোমায় পড়াশোনা নিয়ে বেশি জোর দিইনা, তা সেটাও যদি না পারো তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও এমন ছেলে থেকে কোনো লাভ নেই।
হতভম্ব হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো প্রীতম। সকাল থেকে প্র্যাকটিস ই করছিল। তার বাবা তার উপর এমন চটলো কেন এটা সে বুঝেই উঠতে পারলো না। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললো,
– কোথায় আড্ডা মারলাম বাবা? এইমাত্র তো প্র্যাকটিস সেরেই ফিরলাম। সার্ভ করতে গিয়ে অয়নের রিস্টে টান লাগায় ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম একটু।
– ওই করো। আমি মরছি ওর কথা ভেবে আর উনি দেশ উদ্ধার করে বেড়াচ্ছেন। যত্তসব! যাও স্নান খাওয়া সেরে প্র্যাকটিসে মন দাও।
প্রীতম ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর তরুণ বাবুর এক্সপ্রেশন এ বদল দেখা যায়, কিছু একটা ভেবে তিনি যেন পরম স্বস্তি পেয়েছেন। ফোনের রিসিভার টা কানে ঠেকিয়ে আবার রিং করলেন,
– তোকে আজ বিকেলে আসতে হবে না। রাত দশটা নাগাদ পিছনের বাগানে আসিস, একটা স্পেশাল টেকনিক শেখাবো।
এর কয়েক মাস পর ক্যালকাটা টেনিস একাডেমিতে একটি ইন্টার স্টেট টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়। চেঞ্জিং রুমে প্রীতম কে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতে দেখে তরুনবাবু তাকে চিয়ার আপ করতে আসেন
– কি সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকিস বল তো? চিন্তা করিস না, খুব ভালো খেলা হবে। তুই তোর বেস্ট টা দিবি। অনেক কষ্টে সুযোগটা পেয়েছিস হাতছাড়া হলে হবেনা কিন্তু।
– বাবা আমিতো এমন করে সুযোগ টা চাইনি।
ছেলের ঔদাসীন্য দেখে তেলে বেগুনে চটে যান তরুনবাবু।
– তা কেমন করে চেয়েছিলে? নিজের যোগ্যতায় পেতিস সুযোগ? কি বুঝিস ভালোমন্দের হ্যাঁ? বুঝিস টা কি? ভালো করে খেলবি প্রীতম নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।
কথাগুলো বলে গটগটিয়ে গ্যালারির ভিআইপি সিটে গিয়ে বসে পড়লেন তরুনবাবু। মিঃ রায় ও তাঁকে দেখে হাসিমুখে তাঁর পাশে এসে বসলেন।
– কি হল বলুন তো তরুনবাবু, অত ভালো খেলত রুবেলটা হঠাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল, কোনো হদিস নেই তারপর থেকে ছেলেটার। এই শেষ মুহূর্তে কোনরকমে প্রীতমের নাম টা ঢুকিয়ে মান বাঁচালাম।
– হুম্
সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে মিঃ রায় বলে চললেন,
– আমি ওর বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলাম খোঁজ নেওয়ার জন্য কিন্তু ওরা ফিরে এসে বললো ওর মা টা নাকি পাগলী কিছু ঠিক করে জানা গেলনা।
– হ্যাঁ আমিও গেছিলাম তেমন কিছু জানতে পারিনি।
ইতিমধ্যে গ্যালারি তে হইহই রব উঠল। এক এক করে কোর্টে এন্ট্রি নিল দিল্লি থেকে আসা মনজিত যোশী ও কলকাতা থেকে মনোনীত প্রীতম বণিক। একদল দর্শক প্রীতমের সমর্থনে ওর নাম ধরে চেঁচাতে লাগলো। ছেলের গর্বে তরুনবাবুর ছাতি বোধহয় একটু চওড়া হচ্ছিল এমন সময় তাঁর কানে অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। কোথায় যেন মারাত্মক ভাবে টেনিস খেলা চলছে, বলের ধাক্কায় রাকেটের যে খটাখট শব্দ তা যেন তাঁর কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার মত আর উত্তেজিত কাদের গলা চেঁচিয়ে উচ্চারণ করছে ‘ রুবেল রুবেল ‘ …
নাহ্ শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। একটু মুখে চোখে জলের ঝাপটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গ্যালারি থেকে উঠে গেলেন তরুনবাবু। খেলা ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে। গ্যালারি থেকে বেসিনের দিকে যেতেই কানে আসা শব্দ গুলো থেমে যায়। চোখেমুখে জল দিতেই তরুনবাবু আত্মবল ফিরে পেলেন। কিছুদিন ধরে মানসিক চাপ টা বেশি থাকায় এইসব ভুলভাল শুনছেন মনে হল। আবার গ্যালারির দিকে পা বাড়াতেই এক অন্যরকম হইহই শুনতে পেলেন। কারা যেন ” আরে গেল গেল ধর ধর” করে গ্যালারি থেকে কোর্টে ছুটলো। হন্তদন্ত হয়ে তরুনবাবু সেদিকেই পা বাড়ালেন। গিয়ে যা দেখলেন তা ওনার কল্পনার বাইরে। কোর্টের ফ্লোরে পড়ে রয়েছে প্রীতম, কয়েকজন ভলান্টিয়ার ওকে ধরে তোলার চেষ্টা করছে, উল্টোদিকের খেলোয়াড় ও প্রীতমের দিকে এসে দেখছে প্রীতম কে।
– আরে তরুনবাবু আপনার ছেলে এত খারাপ খেলে জানতাম না তো। একদম আনাড়ি দের মত বলটাকে রাকেট দিয়ে হিট না করে হঠাৎ পাশ ফিরতে গেল কেন। কি বিপদ টা বাধালো বল দেখি!
মিঃ রায়ের কথাগুলো তরুনবাবুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিধলো! ঘটনাটা যে স্বাভাবিক হতে পারে না তা তিনি ভালোমত বুঝলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন প্রীতমের কান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, সে জ্ঞান হারিয়েছে। তড়িঘড়ি তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। সেখানে ডাক্তার অনেকক্ষন ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর বললেন প্রীতম কোমায় চলে গেছে কবে জ্ঞান ফিরবে তা বলা যাচ্ছেনা! পর পর ঘটনাগুলো এমন ঘটল যে তার আকস্মিকতায় তরুনবাবু বাক্যহারা হয়ে গেলেন। তখন হঠাৎ শোনা যেতে লাগল এক মহিলার কণ্ঠস্বর।
– হিংসার বদলা হিংসা, অপমানের বদলা অপমান, খুনের বদলা খুন। সবকিছু ক্ষমা করা যায়না ক্ষমা করা যাবেনা।
উপস্থিত সকলে তাকিয়ে দেখলেন ময়লা ছেড়া কাপড় পরা মধ্যবয়স্কা এক মহিলা কোথা থেকে হাজির হয়ে তরুনবাবুর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছে। ওখানে থাকা হাসপাতালের কর্মচারীরা মহিলাটিকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সে বলেই যেতে লাগলো কথাগুলো। মুষড়ে পড়া তরুনবাবু এবার ক্ষিপ্র গতিতে মহিলাটির দিকে এগিয়ে গেলেন
– তোর ছেলেকে তো মেরেছি আমি। আমি রুবেল কে মেরে দিয়েছি, আমার ছেলে কিছু করে নি তো। ওর সাথে কেন এমন হলো? যা হওয়ার আমার সাথে হোক ও কি করেছে?
– ও সব কিছু জেনেও চুপ করে ছিল। নিজের বাবার কুকীর্তির কথা কাউকে জানায়নি। আমার ছেলে আমাকে সব বলেছে, হ্যাঁ সব, সেই দিন অত রাতে আমার ছেলেটাকে পেরাক্টিসের নাম করে ডেকে পাঠিয়ে গুন্ডা দিয়ে মেরে পুঁতে দিলি। তোর ছেলেও সব জানত। কি দোষ ছিল আমার ছেলেটার? ও তো তোকে গুরুর আসনে বসিয়েছিল তোর ছেলেকেও ভাইএর চোখে দেখত…
– দোষ ছিল ওর, হাজারবার দোষ ছিল, কেন ও এত ভালো খেলবে? একটা হাভাতে ঘরের ছেলে, আমার কাছে খেলা শিখে আমার ছেলেকেই টেক্কা দেবে…
– এসব কি শুনছি তরুনবাবু… বলে ওঠেন মিঃ রায়… রুবেল কে আপনি খুন.. তাই যদি হবে তাহলে ওর মা সব জানলো কি করে!
– আমার ছেলেই তো আমায় সব বলেছে… হ্যাঁ হ্যাঁ ও তো আসে আমার কাছে, রোজ আসে, জানেন স্যার ওর ওই মাটির ভেতর থাকতে খুব কষ্ট হয়। রোজ এসে আমার কাছে কাঁদে। ও তো কোনো খেলার সাথী পাচ্ছিলনা, এবার ও খেলবে, রোওওওজ খেলবে!!
অ্যাকাডেমি- র তরফ থেকে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। তরুনবাবুর বাড়ির পিছন থেকে উদ্ধার হয় রুবেলের দেহ যা অবশ্য পচেগলে চেনার অবকাশ ছিলোনা। তরুনবাবুকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তবে জেলে বসেও তাঁর শান্তি থাকেনা! হাজতবাসের প্রথম দিন ই সাক্ষাৎ পান রুবেলের,
– ভালো আছেন তো স্যার? একবার শুধু বলতেন আমায় আপনি কি চান, আমি গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিজের নাম সরিয়ে প্রীতমের নাম দিয়ে দিতাম। তা না করে আপনি যা করলেন তাতে যে আমার মা টাও শেষ হয়ে গেল। আর কি হবে যা হওয়ার হয়েছে , এখন আসুন আমরা প্র্যাকটিসে নামি!
শয়নে স্বপনে জাগ্রত অবস্থায় সারাক্ষণ তরুনবাবুর কানে বাজে…. খট.. খট… খট.. খট..
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।