• Uncategorized
  • 0

প্রেমের দাবি – মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

রবীন্দ্র ঠাকুরের সাথে সবটা যে ওঁর মতে মিলত তা তো নয়। তেজোদীপ্ত ব‍্যক্তিত্বময়ী কর্তব‍্যপরায়ণ মেয়েটির নিজস্ব বিচার ভাবনার সাথে প্রাজ্ঞ বিচক্ষণ কবির চিন্তার পুরো মেলবন্ধন না হবারই কথা। কিন্তু নিবেদিতার উপস্থিতিতে এমন একটা মাধুর্য থাকত যে মেয়েটির সাথে সব মতপার্থক্য ভুলে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। কবির জন্ম মে, ১৮৬১। নিবেদিতার অক্টোবর, ১৮৬৭। কবির থেকে বছর ছয়েকের ছোট নিবেদিতা। কবির গল্প কাবুলিওয়ালা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন বিদেশিনী, আর জোর খাটিয়ে ঢুকে পড়েছেন বিপত্নীক কবির সাহিত্যের অন্দরমহলে। গোরা উপন্যাস লিখছিলেন বছর পঞ্চাশের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লেখা দেবেন বলে আগাম টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন প্রবাসী সম্পাদকের থেকে। আড়াই বছর ধরে কিস্তি লিখে লিখে শোধ করতেন কবি। মা মরা ছোটছেলে শমীর মৃত্যুতেও গোরা উপন‍্যাসের কিস্তি পাঠানো বন্ধ করেন নি তিনি। সেই গোরার নিয়মিত পাঠিকা ছিলেন আইরিশ মেয়েটি। মাঝে মাঝেই কবির কাছে খোঁজ নিতেন গোরার কিস্তি তৈরির বিষয়ে। একবার গোরা লেখার একেবারেই শেষ পর্যায়ে কবির কাছে এসেছেন নিবেদিতা। আপনজনের মতো দাবি করলেন, গোরা কিভাবে শেষ করছেন, আপনার প্ল‍্যানটা শুনতে চাই।
গোরা যখন জানল তার জন্মের প্রকৃত খবর, তার পরে অনুরাগিণী সুচরিতার সাথে তার দূরত্ব কায়েম হয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পরিকল্পনা শুনে গোলমাল বাধিয়ে দিলেন নিবেদিতা।
না না, কিছুতেই আপনি অমন নিষ্ঠুরের মতো ওদের প্রেমকে শেষ করে দিতে পারেন না। মিলিয়ে দিন বলছি।
দার্শনিক নিস্পৃহতায় কবি বলেন, সমাজবিধিতে যে এ মিল হতেই পারে না।
তা হোক, তুমি কবি, তুমি শিল্পী, দাও ওদের মিলিয়ে। নিবেদিতার চোখে অদ্ভুত আকুতি।
কবি শক্ত হয়ে থাকেন। কিছুতেই মেনে নেবেন না নিবেদিতার অসঙ্গত আবদার। তিল তিল করে আড়াই বছর ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন গোরা। আর আজ একটা মেয়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে এতদিনের সাধনায় জল ঢেলে দিতে পারবেন না তিনি।
নিবেদিতা নাছোড়। দিতেই হবে শেষটা বদলে। গোরা সুচরিতাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া চলবে না।
প্রেমের টানে যে মেয়েটা নিজের দেশ সমাজ পরিবার আর পরিচিত পরিবেশ স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছে, গুরুকে ভালবেসে গুরুর দেশের স্বার্থে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে গুরুর স্বদেশকেই আপন স্বদেশ জেনেছে, এমনকি গুরুকে যথার্থ শ্রদ্ধা করে বলেই গুরুর সংগঠনের অহেতুক নিষেধাজ্ঞাকে হেলায় তুচ্ছ করে সংগঠনের বিরূপতাকে বুক পেতে নিতে ভয় পায় নি যে মেয়ে, তার আকুতি তো সোজা আকুতি নয়। প্রেমের আম্রমুকুলের কাছে হার মানে জ্ঞাননিম্ব ফল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে গোরা সুচরিতার মিল হয়ে যায়।
গোরা ব‌ই হয়ে বেরোলো ১৯১০ এর ফেব্রুয়ারিতে। নিবেদিতা সমস্ত ভাব ভালবাসার পরপারে চলে গেলেন ১৯১১ এর অক্টোবরে। মাত্রই চুয়াল্লিশ বছর বয়সে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।