• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধ – উপানন্দ ধবল

বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা

একক বিদ্যাসাগর

“বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন”– রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত বাক্যটির প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনে– বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। কী সমাজ সংস্কার, কী ভাষা-সংস্কার, কী ব্যক্তিত্বের সুমহান প্রতিভা বিকাশে, সর্বোপরি মানব কল্যাণে আত্মোৎসর্গে– সব বিষয়েই একটা হিমালয়স্পর্শী উচ্চতায় তিনি আসীন।

বিদ্যাসাগার চরিত্রের অন্তরবিশ্লেষণ করলে দেখব সেখানে তিন পাশ্চাত্যের মনীষীর প্রচ্ছায়া স্পষ্ট। অগাষ্ট কোঁতের পজিটিভিজম, বেন্থামের হিতবাদী ভাবনা এবং স্টুয়ার্ট মিলের উদারনীতিবাদ বিদ্যাসাগরচরিত্রে সম্যক প্রকাশিত। স্ট্রাকচারালিজম ভাবনার সুত্রানুসারে এইসব মানুষরা যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক না হয়ে যান না। অতএব জনহিতায় জীবন উৎসর্গ করলেও জীবনের বলয় ঘিরে একটা সার্বিক প্রশান্তির অভাব ও তজ্জনিত  বেদনা এইসব মানুষকে আজীবন কুরে কুরে নিঃশেষ করে। লোকালয় ছেড়ে পরবর্তীকালে কর্মাটাঁড়ে সাঁওতালদের মধ্যে সঙ্গোপন নিরালা খোঁজার সহজ-তৃপ্তি-মানস বিদ্যাসাগরের জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।

বিদ্যাসাগর নাস্তিক বা আস্তিক সেটা বড় কথা নয়; মানুষের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ বিদ্যাসাগর যে জীবদ্দশাতেই প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন সেটাই আমাদের বিচার্য। যারা প্রচলিত সংস্কার বা সামাজিক প্রথার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজকে নবীন প্রাণবন্ত করে তুলতে নববিধান আয়োজন করেন, আপাতদৃষ্টিতে আমরা তাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে থাকি। তিনি সৃষ্টিছাড়া, তাই বিধবাদের দুঃখে কাতর হয়ে তাদের বিবাহের আয়োজন করেন। সামাজিকতার নামে স্বেচ্ছাচার প্রতিহত করতে এবং পতিব্রতা নারীদের দুঃখ দূর করতে তিনি বহুবিবাহ প্রথা রদ করার ব্যবস্থা করেন। নারী শিক্ষা ছাড়া নবজাগরণ তথা ধর্ম-সংস্কার সম্ভব নয়, তাই বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তারের অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেন। দীন, দুঃখী, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মুমুর্ষু রোগী সবার প্রতি তাঁর অন্তরে অপার দয়া। তিনি তো শুধু বিদ্যাসাগর নন তিনি দয়ারও সাগর।

বিদ্যাসাগরের সুমহান চরিত্রের একটি দিক হল এই সৃষ্টিছাড়া নাস্তিকতা। এই গুনেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। যুক্তির যতি-চিহ্ন-স্বরূপ কমা- সেমিকোলন- হাইফেন- ড্যাশ– ইত্যাদির প্রয়োগের দ্বারা তিনি গদ্যের বিশৃঙ্খল  জনতাকে সুশৃঙ্খল করতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মনের ঘরে জন্মেও উপনয়নের পরও তিনি গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করেননি, কেননা গায়ত্রীর যৌক্তিকতা দিয়ে জনকল্যাণ হয় না; এই ছিল বিদ্যাসাগরের বিশ্বাস। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় ও প্রচলিত কুসংস্কার থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে গিয়ে সংস্কারবাদী হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন –”শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তাঁরা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রের-ই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয়নি।” এজন্যই ধর্ম সম্পর্কে সাধারণের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য ছিল– ”ধর্ম যে কি তাহা মানুষের জ্ঞানের অতীত এবং বর্তমান অবস্থায়  ইহা জানিবার কোন প্রয়োজন নাই।”

ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কারের শূন্যগর্ভতাকে বিদ্যাসাগর আঘাত করেছেন সবচেয়ে বেশি। মধুসূদনের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাতে শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স্য নারায়ন শাস্ত্রী বলেছিলেন — “যে পেটের জন্য ধর্ম ছাড়ে তার সঙ্গে কী কথা কইব?” রামকৃষ্ণের মুখ দিয়ে সেদিন মধুসূদন কিছু শুনতে চাইলে পরমহংস বলেছিলেন তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। কে যেন আটকে দিয়েছে জোর করে। মাইকেল মধুসূদনের মন শান্ত করতে সেদিন রামকৃষ্ণ শুনিয়েছিলেন রামপ্রসাদী ভক্তিগীতি। চোখ বুজে শান্ত হয়ে শুনেছিলেন মধুসূদন। এহেন ধর্মান্তরিত মধুসূদনকে বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র তার বাংলা সাহিত্যের অবদান-এর জন্যই হোক অথবা মানবতার খাতিরে– বিরাট অংকের সাহায্য করে বাঁচিয়েছিলেন ঋণের দায় থেকে। বোহেমিয়ান মধুসূদন বিদ্যাসাগরের পার্থিব ঋণ শোধ করেননি, উপরন্ত বাকি সম্পত্তিও উড়িয়েছিলেন মদের ফোয়ারায়, ঋণের জালে। পার্থিব ঋণ শোধ না করলেও কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করেছিলেন মধুসূদন। চিঠিতে, কবিতায় আমরা তার স্বাক্ষর পাই। স্বরচিত ‘বিদ্যাসাগর’ নামক সনেটে লিখেছিলেন —
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে
দীন যে দীনের বন্ধু।”
শুধু কবিতায় নয়; ব্যক্তিগত পত্রেও বিদ্যাসাগরের প্রতি অকুন্ঠ প্রশংসা বর্ষিত হয়েছে।1864 খ্রিস্টাব্দের 2nd September  যোগীন্দ্রনাথ বসুকে লেখা একটি পত্রে মধুসূদন বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখেছেন– “The man to whom I have appealed has the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an englishman and the heart of a bengali mother।”

সত্যিই তো প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজ সাহেবের মত পুরুষকার এবং বাঙালি মায়ের মত হৃদয়ের অপূর্ব সংমিশ্রণ নিয়ে এই দুই শত বছরে কয়টি বাঙালির জন্ম হয়েছে এই বাংলায়? সত্য ও ন্যায়ের পূজারী বিদ্যাসাগর আপন সত্যধর্ম বজায় রাখার জন্যই আপোষহীন লড়াই চালিয়েছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কার ভাবনার সঙ্গে। তাই দেখি 1851 খ্রিস্টাব্দের 22 জানুয়ারি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হওয়ার কয়েক মাস পরই এতদিনকার অবরুদ্ধ দরজা কায়স্থ ও শূদ্রদের  জন্য খুলে দিয়েছিলেন। এতদিন কলেজে হিন্দু ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া প্রবেশাধিকার ছিল, বিদ্যাসাগর অন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্যও কলেজের দরজা খুলে দিলেন। সাধ করেই কি স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছিলেন ; রামকৃষ্ণের পরই বিদ্যাসাগর তাঁর দ্বিতীয় গুরু।

ভাবলে অবাক হতে হয়, আজ থেকে প্রায় ১৬৫ বছর আগে প্রবল গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী তর্কবাগীশ বিদ্যারত্নদের বিরুদ্ধে কী অসম বিদ্রোহ করে বিদ্যাসাগর বাংলায় নবজাগরণের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন! আমরা ভাবলে অবাক হই, সেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন শিক্ষাদীক্ষার প্রসারহীন বাংলায় বিধবাবিবাহ চালু করার জন্য ১০০০ জনের স্বাক্ষর গ্রহণ করার মতো প্রায় দুঃসাধ্য সাধন করে বড়লাট লর্ড ডালহৌসির সমক্ষে পেশ করার মতো কাজের কথা স্মরণ করে। বিদ্যাসাগরের সেই মহৎ কর্ম বিফলে যায়নি, বরং রাজা রাধাকান্ত দেব এই বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে ৩৬০০০ স্বাক্ষর সম্বলিত পত্র বড়লাটের সমক্ষে পেশ করলেও ন্যায় ও যুক্তির উপাসক বিদ্যাসাগরেরই জয় হয়েছিল — সে তো ইতিহাস। একইভাবে কুলীন সম্প্রদায় এবং ক্ষমতাবান হিন্দুদের দ্বারা সংগঠিত বহুবিবাহ প্রথাকেও তিনি চিরতরে বন্ধ করার আন্দোলনে কৃতকার্য হন।

গৃহে কলেজে সমাজে– সর্বত্রই বিদ্যাসাগর একজন নৈয়ায়িক শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সত্য ধর্মের জয় দেখতে চেয়েছিলেন। সেই সত্যধর্ম ; যা ‘জগদ্ধিতায়’, যা সুখবাদ ও হিতবাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ১২৫৩ বঙ্গাব্দে ( 1847-এর 16 july) কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসাবে তাঁর এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল সেক্রেটারি রসময় দত্তের সঙ্গে। কলেজের উন্নতি ও শিক্ষার্থীর স্বার্থে রসময়ের সাথে তাঁর বিরোধ বাঁধলে তিনি তখনকার ৬০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেন। পটলডাঙ্গার বাসায় তখন তিনি জনা কুড়ি ছাত্রের থাকা-খাওয়া-পরা-পড়ার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। এমতাবস্থায় আলু পটল বিক্রি করে নিজের এবং তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন মহামহিম বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথের “বিদ্যাসাগর চরিত” থেকে এ বিষয়ে জানতে পারি–“তখন বাসায় প্রায় কুড়িটি বালককে তিনি অন্নবস্ত্র দিয়া অধ্যয়ন করাইতেছিলেন–তাহাদের কাহাকেও বিদায় করিলেন না। তাঁহার পিতা পূর্বে চাকরি করিতেন–বিদ্যাসাগরের সবিশেষ অনুরোধে কার্যত্যাগ করিয়া বাড়ি বসিয়া সংসার খরচের টাকা পাইতেছিলেন। বিদ্যাসাগর কাজ ছাড়িয়া দিয়া প্রতি মাসে ধার করিয়া পঞ্চাশ টাকা বাড়ি পাঠাইতে লাগিলেন। এই সময় ময়েট সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর কাপ্তেন ব্যাঙ্ক-নামক একজন ইংরাজকে কয়েক মাস বাংলা ও হিন্দি শিখাইতেন। সাহেব যখন মাসিক পঞ্চাশ টাকা হিসাবে বেতন দিতে গেলেন তিনি বলিলেন, ‘আপনি ময়েট সাহেবের বন্ধু এবং ময়েট সাহেব আমার বন্ধু– আপনার কাছে আমি বেতন লইতে পারি না।”
যাইহোক, আলু পটল বিক্রি করতে হয়নি, এই সময়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ এবং বিদ্যাসাগর গুণগ্রাহী মার্শাল সাহেব মাসিক ৮০ টাকা বেতনে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করলে, তাঁর আর্থিক সমস্যা দূর হয়।

দুর্জয় প্রতিজ্ঞা, যুক্তিবাদ, সর্বোপরি পরাক্রমী অহং নিয়ে বিদ্যাসাগর বঙ্গদেশে একক হয়ে পড়েছিলেন। কলেজে, সমাজে স্বগ্রাম বীরসিংহে তিনি আপন স্বভাবগুণে তিষ্ঠাতে পারেননি। ভাবনায়, কর্মে, প্রতিজ্ঞা পালনে তিনি যথার্থই একক এবং নিঃসঙ্গ ছিলেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর (১২৫৩ — ১২৮৯ ; 1847 থেকে 1894) কর্মকালের প্রায় অর্ধেক (১২৭৬ থেকে ১২৯৮) বিদ্যাসাগরকে পারিবারিক নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হয়েছিল। এই নিঃসঙ্গতার বেদনা বহিরসমাজে কোথাও প্রকাশ না পেলেও, প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখায়– ব্যক্তিগত পারিবারিক চিঠিতে এবং “প্রভাবতী সম্ভাষণ” নামক গদ্য ভাষায় লিখিত ওড জাতীয় গ্রন্থে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর ১২৯৯ বঙ্গাব্দে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি “সাহিত্য” পত্রিকায় প্রথম বিদ্যাসাগরের সযত্নে রক্ষিত এবং তদ্বারা বারংবার পাঠ-উপভোগ্য গ্রন্থটি  ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন– ” মাতামহদেব প্রভাবতীকে অপত্য নির্বিশেষে ভালবাসিতেন। এই সময়ে, নানাবিধ কারণে তিনি সংসারে সম্পূর্ণ বীতরাগ ও বিরক্ত হইয়া ছিলেন, এই ক্ষুদ্র রচনায় তাহার আভাস পাওয়া যায়। মনের এই অবস্থায় স্নেহভাজনের বিয়োগে… প্রভাবতীর স্মৃতি চিরজাগরুক রাখিবার জন্য তিনি এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন । মৃত্যুর তিন চারি মাস পূর্বেও আমি তাঁহাকে একান্তে “প্রভাবতী সম্ভাষণ” পড়িতে দেখিয়াছি।” বস্তুত তাঁর লেখায়, “সংসার নিতান্ত বিরস ও বিষময়”– এই ভাবনাটি বারংবার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। প্রভাবতীর উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “তুমি স্বল্পকালে নরক হইতে অপসৃত হইয়া আমার বোধে অতি সুবোধের কর্ম করিয়াছ।… সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে সংসার যাত্রা সমাধান করিতে পারিতে না।”

“প্রভাবতী সম্ভাষণ” (১২৭১ বঙ্গাব্দ) রচনার পাঁচ বছর পর বিদ্যাসাগর বীরসিংহ ত্যাগ করেন। “প্রভাবতী সম্ভাষণ” ঈশ্বরচন্দ্রের আমৃত্যু পড়ার বই।  ঠিক বই না বলে, একে স্বগত সংলাপ (monologue) বলা-ই শ্রেয়। গ্রন্থটিতে নিজের পারিবারিক জীবনের হতাশা এবং শূন্যতা অপরুপ ভাষা লাভ করেছে। বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন বছরের কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুতে ব্যথিত বিদ্যাসাগরের হৃদয়ের শোকবিহ্বল রূপটি অকৃত্রিম প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের ভাব- ভাবনার সঙ্গে পূর্বে বিদ্যাসাগরের জীবনের সঙ্গে জড়িত বহু ঘটনা এবং পারিবারিক পত্রগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ; একটি বেদনাঘন সাদৃশ্য চোখে পড়ে। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী-সূত্রে জানা যায়– পুরুষের বহুবিবাহ এবং নারীর বাল্যবিবাহ রদ করা যাঁর সামাজিক আন্দোলনের বড় ক্ষেত্র, সেই বিদ্যাসাগর স্বগ্রামস্থ এক বিধবা-বিবাহকে সমর্থন করেননি। কেননা, বিবাহের জন্য নির্বাচিত বর-কনের চরিত্র ছিল খারাপ। আগামী প্রজন্মের জন্য উচুমানের প্রজাতি তৈরি না হলে দেশ ও দশের পক্ষে অমঙ্গল– এই ছিল বিদ্যাসাগরের বিশ্বাস। জীবনিকার চণ্ডীচরণ  বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন —     “বিদ্যাসাগর মহাশয় এই ঘটনায় এরূপ দারুণ মর্মবেদনা পাইয়াছিলেন যে, সে রাত্রিতে অনাহারে থাকিয়া বিবাহের পরদিন প্রাতঃকালে অনাহারে ক্ষুব্ধ  চিত্তে প্রিয় জন্মভূমি, সাধের বাড়ি-ঘর চিরদিনের জন্য ত্যাগ করিয়া কলিকাতা যাত্রা করিলেন। আসিবার সময় সহোদরদিগকে ও সম্ভ্রান্ত গ্রামবাসীদিগকে বলিয়া আসিলেন, “তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করাইলে।”

১২৭৬ বঙ্গাব্দে বিদ্যাসাগর জন্মের মত বীরসিংহ ছেড়ে চলে গেলেন। গ্রাম ত্যাগের পূর্বে তিনি পৃথকভাবে মা, বাবা, স্ত্রী এবং তিন ভাই ( দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র এবং ঈশানচন্দ) সহ গ্রামপ্রধানকে একটি করে পত্র দিয়েছিলেন। মা ভগবতীদেবীকে লিখেছিলেন,  “এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে জন্মের মত বিদায় লইতেছি।” আর চিঠির শেষাংশ লিখেছেন, “যদি আমার নিকট ( কলিকাতায়) থাকা অভিমত হয় তাহা হইলে আমি আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিব এবং আপনার শ্রীচরণ সেবা করিয়া চরিতার্থ হইব। ” পিতা ঠাকুরদাস কে লিখেছিলেন, “সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে তাঁহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই।” ব্যক্তিত্বময়ী স্ত্রী দীনময়ীদেবীকে  লিখেছিলেন, “এক্ষণে তোমার নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি।” আর তিন সহোদরকে লেখা চিঠিতে মাসোহারা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি ছাড়া অন্য অন্তরঙ্গ কথা কিছু ছিল না। বলাবাহুল্য, মা ছাড়া আর কেউই বিদ্যাসাগরকে ফিরে আসার জন্য বা কুশল নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় পত্র লেখেননি। বিদ্যাসাগর দেশ ত্যাগের এক বছর পর ভগবতীদেবী মারা যান, বাবা বেঁচে ছিলেন আরও সাত বছর। আর স্ত্রী দীনময়ী স্বামীর মৃত্যুর মাত্র তিন বছর আগে মারা যান। স্ত্রী দীনময়ীর রাগ হবার কারণ ছিল স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগর তাঁর পুত্রকে কোনও সম্পত্তি তো দেননি ; উপরন্তু তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ন বন্দোপাধ্যায় যার-পর-নাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এজন্য ও অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি। সেই হেতু বশতঃ বৃত্তি নির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতু বশতঃ তিনি … আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত… হইতে পারিবেন না।” এভাবে পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের অনধিকার এবং প্রায় ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণার মধ্যে দীনময়ী ক্লেশ অনুভব করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, বিদ্যাসাগর এই দীনময়ীর প্রশ্রয়ের কারণেই ছেলেকে কলকাতা এনে উপযুক্ত পড়াশোনা করাতে পারেননি। পুত্র মাটি হয়ে যাচ্ছিলেন। বিদ্যাসাগর গৃহত্যাগের কিছুদিন পরে একটি পত্রে পিতাকে জানিয়েছিলেন,  “সাংসারিক বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য  আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি।  কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোনও অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই।… এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম।”

সংসার বিরক্ত বিদ্যাসাগর তার সমস্ত চেষ্টা ও জীবন পরোপকারার্থে উৎসর্গ করলেও, প্রশংসা খ্যাতির চেয়ে শতগুন বেশি নিন্দামন্দর কন্টকাবৃত পথ অতিক্রম করেছেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণরা তাঁর নামে রটিয়েছে কুৎসা, বিধবা বিবাহের আয়োজনে 35000 টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে মাসিক পাঁচ হাজার টাকার সুদ দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। চাঁদার রসিদে স্বাক্ষর করেও অনেকে প্রতিশ্রুতিমত টাকা দিয়ে সাহায্য করেননি। এর সঙ্গে ছিল ঘরে-বাইরে মানুষের লাগাতার বিরোধ। এমনকি একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র যিনি স্বেচ্ছায় বিধবা বিবাহ করে পিতার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, সেই পুত্রই নাকি বিদ্যাসাগরের সাহায্যপ্রাপ্ত বিন্দুবাসিনী নাম্নী এক বিধবাকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। স্ত্রী জাতির প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিদ্যাসাগর আপন পুত্রের সম্বন্ধে একথা জেনে তাঁকে যার-পর-নাই ‘পিতৃবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। বিদ্যাসাগর জীবনের শেষ কুড়ি বছর প্রায় নিঃসঙ্গ থাকতেন। অনাহার এবং নানা কারণে তাঁর পেটের অসুখ, জ্বর প্রভৃতি লেগেই থাকত। নির্বান্ধব জীবন থেকে মুক্তি পেতে তিনি আবার ফিরে গেলেন কর্মাটাঁড়ে। যেখানে কয়েক বছর পূর্বে দুর্ভিক্ষের দিনে হাজার হাজার মানুষকে দিবারাত্র খিচুড়ি রেঁধে খাইয়েছিলেন। সেই নিরক্ষর সাঁওতাল কুলীদের মধ্যেই তিনি শেষ জীবনে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন হয়তো; হয়তো বা।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ :

১) যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন- চরিত
২) শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর জীবন চরিত ও ভ্রমনিরাশ
৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর চরিত
৪) অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
৫)  চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর
৬)  অমিয়কুমার হাটি, বিজ্ঞান মনস্কতা ও জনস্বাস্থ্য চেতনা
৭)   অনুময় চট্টোপাধ্যায়, অনন্য বিদ্যাসাগর
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।