• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধ – অমিতাভ দাস

বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা

আমার বিদ্যাসাগর 
আমার জন্মের প্রায় ১৬০ বছর আগে আপনি এসেছিলেন । অন্ধকারে সুপ্তিমগ্ন গভীর এক ধূলিপথ ধরে । আপনার আগে বুদ্ধ , আচার্য শঙ্কর , চৈতন্যদেব…আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি অথবা , হয়েছিল একদিন পূর্বজন্মকালে , অথবা… অথবা বলা ভালো কল্পস্বপ্নালোকে অস্ফুট আলোর ভিতর । বস্তুত , আপনি মিথ এখন । আপনার বিদ্যা , আপনার উপাধি , আপনার সমাজ ভাবনা ও সংস্কার সব-ই আলোচনার বিষয় ।
আমার ঘরে আপনার কোনো ছবি নেই । তবে আপনার লেখা বইগুলি আছে । সেই কোন ছোট্ট বেলায় কাকার জন্মদিনে উপহার পাওয়া” বিদ্যাসাগর রচনা সমগ্র ” থেকে পড়ে ফেলেছিলাম ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-এর গল্প । আপনার জন্য ক্লাস এইটের রেজাল্ট জানতে পারিনি– মার্কশীট দেননি ক্লাস টিচার । কারণ , স্কুল লাইব্রেরি থেকে একটা বই তুলেছিলাম ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিত’ । বইটি জমা দেব বলে এনেছিলাম । কে যেন চুরি করে নিয়েছিল ব্যাগ থেকে । অর্থাৎ বইটি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম । সে কারণে ক্লাস টিচার রেজাল্ট দেননি শত অনুরোধেও । খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম । অনেক পরে, লাইব্রেরিতে দাম মিটিয়ে রেজাল্ট এসেছিল হাতে । আপনার সঙ্গে এই রকম একটা সম্পর্ক আমার শুরু থেকেই ।
আপনি মায়ের ডাকে  দামোদর নদী পেরিয়েছেন । মেয়েদের স্কুল গড়ে দিয়েছেন । নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বিধবা-রমণীর সঙ্গে । সে জন্য কত আক্রমন হয়েছে । নিন্দা-বদনাম-কুৎসা সহ্য করতে হয়ে । তবু আপনি ছিলেন দৃঢ় , অনমনীয় । প্রমান করে দিয়েছিলেন বই-পত্তর ঘেঁটে যে বিধবা বিবাহের বিধান শাস্ত্রে আছে । বাংলার প্রামান্য ইতিহাস লিখেছেন । সীতার বনবাসে আপনার আর্দ্র হৃদয়টিকে ছুঁতে পারি আমি । সীতার দুঃখে কেঁদে ওঠে পাঠকের মন । আপনি ছদ্মনাম কত যে নিবন্ধ বা সন্দর্ভ রচনা করেছেন । কখনো ” কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য ” আবার কখনো ” কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য ” নামে পন্ডিতদের মতকে খন্ডন করেছেন । মনে আছে ” প্রভাবতী সম্ভাষণ ” । বাঙালিকে ইংরেজ সাহেব অপমান করলে যোগ্য জবাব দিয়েছেন আপনি । কত কত মানুষ যে আপনার দয়া ও করুণায় , আপনার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হয়েছিল । মধুকবির সঙ্গে সখ্য… তাঁকে টাকা পাঠানো…কত গল্প , কত ভালোবাসা… আপনাকে পড়লে বুঝি মানুষকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় । জীবন কেবল নিজের সুখের জন্য নয় , পর হিতের জন্যেও ।
আপনার কথা আরো জানলাম ” শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত”  থেকে । মুখোমুখি দুই যুগপুরুষ– রামকৃষ্ণ আর বিদ্যাসাগর । ঠাকুর বললেন , সাগরে এসেছি গো…আপনি বললেন , সাগর নয় , ডোবা… সেইসন্ধ্যাটি বড় ভালো লাগে । দুই যুগপুরুষ মুখোমুখি । যেন একটা সময় দাঁড়িয়ে থাকল ।মহাকাল সব দেখে নিল– আস্তিক আর নাস্তিকের মহা মিলন তখন । এসব আমি চোখ বুজলেই ছবির মতো দেখতে পাই ।
সেদিন পড়ছিলাম পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজোর কথা । আপনি এসব পছন্দ করতেন না । চলে যেতেন গ্রামে । গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাটিয়ে দিতেন পুজোর কটা দিন । আপনি তার্কিক , ঘোর যুক্তিবাদী । বলতেন , কে কতদিন বাঁচল সেইটে বড় কথা নয় — কে অল্পদিনে কী কাজ করল এইটে বড় কথা । কাজটাই থাকে । আর কিছু নয় । আপনি যুগপুরুষ । আপনি আজো আমাদের শিখিয়ে চলেছেন ।
সেইদিন কারা যেন আপনার মূর্তি ভেঙেছিল । তা নিয়ে কত চিৎকার , আলোচনা , পাল্টা আলোচনা । আপনি হয়ত সেদিন অলক্ষ্যে হেসেছিলেন । আসলে আপনার আদর্শ কেউ ভাঙতে পারবে না । আপনার আদর্শকে ভাঙা যায় না । আপনি সেই সিংহ -পুরুষ যিনি আপনার মেরুদন্ডটা আজো হয়ত কোনো কোনো বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছেন ।অথবা করুণাসাগর আপনি ক্ষমা করে দিয়েছেন অবোধ , দীন সন্তানদের ।
আপনাকে প্রতিনিয়ত চেনা হয় ছাত্র পড়াতে বসে— বাংলা গদ্যের কায়া গঠন । ছেদ ও যতি চিহ্নের প্রয়োগ । অনুবাদ । ব্যাকরণ ।  যখন বলা হয় ,   বাংলা গদ্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের  অবদান লেখো অথবা বিদ্যাসাগরকে কী বাংলা গদ্যের জনক বলা যায় ? বিশ্বাস করুন , এর সঠিক উত্তর আমি আজো খুঁজে পাইনি । আপনি, রামমোহন এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার মহাশয়কে নিয়ে তুল্য-মূল্য আলোচনা করতে ভালো লাগে না । তবে দুঃখ এইটেই , যাঁদের জন্য আপনি এত কিছু করলেন তাঁরা মনে রেখেছে তো আপনাকে ? তাঁরা পড়ে তো ভালোবেসে আপনার লেখা ! তাঁদের বুকের ভেতরে কোথাও লালিত হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র নামের কোনো ঈশ্বরের ছবি । আপনি কোনো ইট-কাঠ-পাথরের ঈশ্বর নন যে বেদীতে বসে থাকবেন ; আপনি যে মানবেতিহাসের এক অনন্য ঈশ্বর ।
বর্ণ পরিচয়ের ভেতর থেকে কখনো কখনো বেরিয়ে আসে ভোর– কুসুম কুসুম আলো…একটি বালক ‘ কথামালা ‘খুঁজে পায় । বালিকার ‘ বোধোদয় ‘ হলে পর ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে ভালোবাসার মতো পরিচ্ছন্ন আলো । গোপাল আর রাখালের গল্প বলে পূর্বপুরুষের দল….একটি উনিশ শতক হাঁটতে হাঁটতে বীরসিংহ গ্রামের দিকে চলে যায় । আর আমি আপনাকে এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে খুঁজতে থাকি কলকাতার বাতিস্তম্ভের কাছে , যদি একদিন খুঁজে পাই , দেখা হয়ে যায়…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।