প্রবন্ধে যশোবন্ত বসু

চোখের সুবাস

সব চোখ চোখ টানে না।সব চোখ কথাও বলে না।কিছু-কিছু চোখ বলে।কিন্তু চোখ নিয়ে কথার শেষ নেই – কাব্যে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে।কী প্রাচীন, কী আধুনিক, রোম্যান্টিক কবি ও লেখককুল মেয়েদের আঁখিসুধায় মজেছেন, মজিয়েওছেন। তাই বলে কোনও ছেলের চোখও কি সুন্দর হয় না ? বিলক্ষণ হয়, কিন্তু সে-চোখের স্তুতি বা প্রশংসা নারীনয়নের তুলনায় নিতান্তই সংখ্যালঘু।মৃগনয়না, মধুমণি, নিবিড় আঁখিপল্লব, ইশারাময় মদিরতা, শান্ত দিঘল, অতল গভীরের উদ্ভাস ইত্যাদি বিবরণ ও বিশেষণগুলি মেয়েদের সুন্দর চোখ একচেটিয়া ভোগ করে এসেছে চিরকাল।
যে-রবীন্দ্রনাথের অমোঘ লাইন “তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”, সেই রবীন্দ্রনাথ ১৭ মে,১৮৮৯ তারিখে লিখলেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়’—প্রেমপর্যায়ের এই গানটি।কবি তখন মহারাষ্ট্রে, মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের শোলাপুরের বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করছেন। গানটি অবশ্য লেখা হয়েছিল পুণে শহরের খিড়কিতে। কবির বয়স তখন ২৮। তার ঠিক পাঁচ বছর আগে মৃত্যু হয়েছে নতুন বৌঠান কাদম্বরীর।বড় মেয়ে মাধুরীলতা ও বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবি ও কবিপত্নী মৃণালিনীর ছয় বছরের ভরাট দাম্পত্য জীবন।ঠিক তখনই লেখা হল এই গান – “এমন দিনে তারে বলা যায়… এমনদিনে মন খোলা যায়…”
কবি কোন্ মন খুলতে চাইছেন ? কার কাছেই বা খুলবেন গোপন, বন্দি মন ?যখন “নিভৃত নির্জন চারিধার/দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি…”
দুঃখ কীসে হয় ? সেই দুঃখের নিরসন-ই বা কীসে ? উত্তর খুঁজতে গিয়ে গানের এই লাইনগুলিতে এসে থমকে দাঁড়াই—
“সমাজ সংসার মিছে সব/মিছে এ জীবনের কলরব/কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে/হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব…”
আঠাশ বছরের বিবাহিত যুবক কবির মনে হচ্ছে, সমাজ-সংসার সব মিথ্যে। এ বড় কম উপলব্ধি নয় ! কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পান করে এবং মন দিয়ে মনকে বুঝে নিয়েই কেটে যাচ্ছে গভীর দুঃখের ভার ! সত্যিই মন খুব বিচিত্র বিষয়।আর ‘মনের ঘরে বসত করে কয়জনা’, তা-ই বা কে জানে ?
রবীন্দ্রনাথের থেকে তিনশো বছর পিছিয়ে যাই। শেক্সপিয়রের সমসাময়িক আরও একজন বিশিষ্ট ইংরেজ কবি ও নাট্যকার, শেক্সপিয়রের চেয়ে আট বছরের ছোট বেন জনসনের কথা বলি।
জনসনের কমেডিগুলি তো ইংরেজি সাহিত্যে স্বনামখ্যাত হয়েই আছে। বেন জনসন তাঁর ‘Song:to Celia’ কবিতায় লিখছেন—
“Drink to me only with thine eyes
And I will pledge with mine
Or leave a kiss but in the cup
And I’ll not look for wine.”
মোট ষোলো লাইনের এই কবিতাটিতে কবির প্রেমের যে প্রগাঢ় কথন তা এক নিবিড় আন্তরিক উচ্চারণ, শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে দুজনের নিঃশব্দ সংলাপ। সেই আঁখিসুধা। এবং অধরসুধাও। রবীন্দ্রনাথ যা লিখতে পারেননি, তিনশো বছরের অগ্রজ বেন জনসন তা অক্লেশে লিখে গিয়েছিলেন।
চোখের ভাষার প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন আরও একটু বলা যাক।সত্তরের দশকের শেষের দিকে মানিক চ্যাটার্জি পরিচালিত, রেখা-বিনোদ মেহরা অভিনীত ‘ঘর’ ছবিটার কথা মনে আছে ? গুলজারের লেখা গানে সুর বসিয়েছিলেন রাহুল দেববর্মণ, গেয়েছিলেন কিশোর আর লতা। আমার ভীষণ ভালোলাগার গানগুলির মধ্যে এই গানটিও আছে—
“আপকি আঁখো মেঁ কুছ মেহ্কে হুয়ে সে রাজ হ্যায়/আপসে ভি খুবসুরত্ আপকে আন্দাজ হ্যায়…”
আহা ! গুলজারের লেখা এক-একখানা গান তো আদতে বিশুদ্ধ কবিতা-ই !
সদ্যবিবাহিত স্বামী-স্ত্রী বিনোদ ও রেখার মিঠে সোহাগের চিত্রায়ণ এই গানটি, তবে গানের দৃশ্য নয়, আমার মন টেনেছে গানের কথাগুলি।রহস্যের সুবাসমাখা চোখ বা প্রেমিকার চোখে কিঞ্চিৎ রহস্যের সুগন্ধ কোন্ প্রেমিক আর না চায় ! কিন্তু গুলজার সাহেব শুধু এখানেই থামলেন না, পরের যে-লাইনটি লিখলেন, সেটি মোক্ষম ! তোমার থেকেও বেশি সুন্দর তোমাকে নিয়ে কল্পনা করা মন-ছবি। হিন্দি ‘আন্দাজ’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ যা-ই হোক না কেন, এখানে, এই প্রসঙ্গে একটি মাত্র শব্দ দিয়ে তা বোঝানো মুশকিল। বাঙালি ঠাকুমা-দিদিমারা সদ্যবিবাহিত নাতি-নাতবউ বা নাতনি-নাতজামাইদের হাবভাব নিয়ে ঠাট্টা করতে গিয়ে বলতেন না, “একেবারে চোখে হারাচ্ছে” ? এ-ও ঠিক তেমনই ‘চোখে হারানো’ অবস্থা। এই তো প্রেম ! গাঢ় সংরাগ। মধুর বিরহ বা বিরহের মাধুর্য।
“তুমি সামনে থাকলে তোমার সঙ্গে যত কথা বলি,তার চেয়ে অনেক বেশি বলি তুমি কাছে না থাকলে”—সম্ভবত এই রকমের একটা লাইন কোথাও লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রেমের রোম্যান্সের পক্ষে বড় নিখাদ কথা, নিঃসন্দেহে ! প্রেমের তুঙ্গ দশায়, আবেগে ও আমেজে ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের সামনে না-পেলে তার সঙ্গে কথা চলে মনে-মনে, তার চোখ-মুখ, হাসি, বিভঙ্গ, গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব তখন উপচে আসে জমানো স্মৃতি থেকে।সেই মুহূর্তগুলিও বড় মনোরম মাদকতার, মৌতাতের।
এসব কথা যারা মানতে চাইবে না, তারা কখনও প্রেমে থাকেনি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।