প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী: একটি পুনঃপাঠ

রবীন্দ্রনাথের “রক্তকরবী” নাটকে ‘যক্ষপুরী’ নামে একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের ভিতর একটা গণ অভ্যুত্থানের কথা এসেছে। সে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় একটি মেয়ে। সে নন্দিনী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর কলমে সমাজ বদলের লড়াইতে একটি মেয়েকে নেতৃত্ব দেবার কথা মাথায় আনলেন কি করে?
যক্ষপুরীর রাজা সাংঘাতিক ক্ষমতাশালী। তিনি ভাঙন বিশারদ। বস্তুকে ভেঙে তার থেকে শক্তি বের করেন তিনি। যক্ষপুরীর রাষ্ট্রব্যবস্থার মালিকদের সোনা জমানোর নেশা। গোটা দেশের মানুষকে মাটি খুঁড়ে তাল তাল সোনা তুলে আনার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রাম থেকে কৃষিজমি থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করে নিয়ে আসা হয়েছে পাথর ভেঙে সোনা বের করার কাজে। হাড় ভাঙা খাটুনি। অন্য দিকে তাকানোর অনুমতি নেই। কেন শুধু সোনা তুলে যেতে হবে, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলা রাষ্ট্র বিরোধিতা। তার জন্য কঠিন শাস্তি। শ্রমিক নাগরিকের মধ্যে যাতে কোনো ভাবনা চিন্তা মতবিনিময় এর অস্তিত্ব না থাকে সে ব্যাপারে যক্ষপুরীর প্রশাসন সজাগ। মদ, ধর্ম জিগির ও অস্ত্রাগারের চাপে নাগরিক সমাজের প্রশ্ন তোলার মনকে অসাড় পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।
যক্ষপুরীর রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসনের নাম সর্দারতন্ত্র। বড় সর্দারের পরিচালনায় মেজ সেজ ছোট নানা সর্দারের দ্বারা যক্ষপুরীর পীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত। অমিতপরাক্রমশালী রাজার ভাঙন ক্ষমতাকে পুঁজি করে যক্ষপুরী চলছে। কিন্তু তাঁকে রাখা হয়েছে একটা জালের ভিতর। জালের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে আর্ত প্রাণের কান্না শোনা যায়।
অথচ এই রাজারই ভিতরে একটা স্ববিরোধ গড়ে উঠছিল।
একটি মেয়ে, নাম তার নন্দিনী, সে সেটাকে লক্ষ্য করেছিল।
সর্দারতন্ত্র সিস্টেমটাই মনুষ্যত্ব বিরোধী। অথচ মানুষ না হলে কাজ চলে না। মানুষ থাকলে মানুষী অভিজ্ঞান থাকে। সর্দারতন্ত্র সেই মানুষী বিবেককে মারতে চায়। তারই প্রতিক্রিয়ায় মানুষ লড়াইয়ে নামে যক্ষপুরীর সিস্টেমের বিরুদ্ধে। নন্দিনীকে এই শোষণমুক্তির লড়াইতে পথিকৃৎ-এর ভূমিকায় এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ।
কবির নন্দিনী শুধু প্রেমময়ী নয়। রীতিমতো বুদ্ধিমতী। আবার দূরদর্শীও। নন্দিনী আপসহীন সংগ্রামী, কিন্তু হিংস্রতা তার রুচি চিন্তার বাইরে। কোনো খুনিয়া মারকুটে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তার নেই। সামগ্রিক মনুষ্যত্বের উন্মুখর উন্মোচনে তার আত্ম নিবেদন।
কিন্তু মেধায় মনুষ্যত্বে সমাজচর্চায় নন্দিনীর মাপের একটা মেয়েকে তিনি কি করে কলমবন্দী করলেন? তাকে তো তিনি পেলেন, এনে দেখালেন আমাদের,
কিন্তু পেলেন কোন রাস্তায়, কোন সড়কের মোড়ে?
“আফ্রিকা” কবিতাটা যখন পড়ি, খেয়াল করি, কবি বলেন, “দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে।”
শোষণ বঞ্চনার ইতিহাসে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশিমাত্রায় শোষিত নিপীড়িত। তাই সেই মানবীর কাছে ক্ষমা চাইবার পরামর্শ দেন কবি।
মেয়েদের নিয়ে একটা গভীরতর ভাবনা ছিল। ‘নন্দিনী’ কথাটার আভিধানিক অর্থও যে স্রেফ “মেয়ে”!
মেয়ে চেহারাটাকেই অপমান করে একটা গাজোয়ারি মজা পায় অনেকে। মেয়ে বলেই অপমান করে। দুর্বল ভাবে। অযোগ্য ভাবে। নিকৃষ্ট ভাবে। অথচ সেই মেয়েকেই দিলেন সমাজ বদলের লড়াই সূচিমুখ করে তোলার ভার। কেননা, মেয়েদের অসামান্য শক্তি আর সক্ষমতাকে তিনি বুঝতে শিখছিলেন। নন্দিনী তাঁর সেই মানবীবিদ্যাচর্চার অভিজ্ঞান।
নিজের লেখা ব্যাখ্যায় দুর্দান্ত বলিষ্ঠ রাবণের পতনের মূলে এক নারীকে অপমানের অনুষঙ্গ এনেছিলেন কবি। সে কথা ভুলব না।
সেই যে মেয়েদের ব্যাপারে চূড়ান্ত অসাড় ছিল সমাজ। শুধুমাত্র এদেশে তো নয়, সমগ্র সভ্য জগতেই মেয়েদের উপর নানাবিধ বাধা নিষেধ ছিল। এদেশে সেটা ছিল মাত্রা ছাড়া। ওই জন্যে দুঃশাসনের দল কুরুসভায় সর্ব সমক্ষে চূড়ান্ত নীচতার পরিচয় দিতে অন্তরে বাধা পেত না।
মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বিবাহের পর নানা ভাবে পদানত ও জর্জরিত করে রাখার ব্যবস্থা ছিল।
অথচ সত্যি সত্যি তো কি শারীরিক প্রশ্নে, কি মেধাগত প্রশ্নে, কি ব্যবস্থাপনা নৈপুণ্যে, মেয়েরা কোনোভাবেই নিকৃষ্ট, এটা বিজ্ঞানের জগতে গৃহীত নয়। বরং বিপরীত।
সর্দারতন্ত্র নন্দিনীকে প্রথমে হিসেবেই আনে নি। নন্দিনীর হাত দিয়ে যক্ষপুরীতে গোটা সর্দারি সিস্টেমটা বেচাল হয়ে যেতে পারে এই আন্দাজটাই ছিল না। সর্দারের দল ভেবেছিল বিপদ যা কিছু পুরুষের হাত দিয়ে। তাই রঞ্জনকে বজ্রগড়ের খনি গহ্বরে হাতে পায়ে শিকল বেঁধে আটকে রাখা। আর মতলব ছিল নন্দিনীকে শারীরিক ভাবে অসম্মান করার। আজকের যুগ হলে ধর্ষণ করানোর।
কিন্তু নন্দিনী, পরনে যার ধানি রঙের শাড়ি, যাকে দেখলে সকল পুরুষের ভেতর কোথাও একটা কিছু বেজে ওঠে, তার চরিত্রে একটা অসামান্য দৃঢ়তা ছিল। পরিকল্পনা ছিল। চিন্তাকে সংহত করে কর্মে পরিণত করার প্রজ্ঞাবান হৃদয় ও মস্তিষ্ক ছিল।
নন্দিনী যে বড় স্বাভাবিক। সহজ কথার গূঢ়তত্ত্বটা তার চেতনায় সজীব।
তাই তার ব্যক্তিত্ব এত প্রসন্নতায় ভরা। তার কাছে একটু দাঁড়াতে পেলে, কথা বলতে পেলে মেজো সেজো পর্যায়ের সর্দারদের পর্যন্ত হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পুরাণ বিশারদ তাকে কোনো একটু কিছু বুঝিয়ে বলার সুযোগ পেলে মোটেই ছাড়তে চান না। রাজা পর্যন্ত নন্দিনীর কালো চুলে হাত ডুবিয়ে এক রকম তৃপ্তি পেতে চান। আর কী অসামান্য সাহসে নন্দিনী অমন করার সুযোগ পর্যন্ত দেয়। কেননা, নন্দিনী জানে, তার মহত্ত্ব, তার শুদ্ধতার বোধ, তার মনুষ্যত্বের বিস্তার রক্ত মাংসের শরীরে ও যৌনতায় সীমায়িত নয়।
নন্দিনী নিজেকে মানুষ বলে চেনে। তাই মানুষের জীবনকে অমানুষের কোঠায় যারা ঠেলে দিতে চায় তাদের সাথে নন্দিনীর বিরোধ মৌলিক চরিত্রের।
অথচ কী অসামান্য হৃদয় সম্পদে ভরপুর। কত ভালোবাসাতেই না সে স্নিগ্ধ করে ৬৯ঙ বিশুকে, ৪৭ফ ফাগুলাল কে, আর কিশোর কে। গজ্জু পালোয়ানের প্রতিও তার সীমাহীন সমবেদনা।
আবার দেখুন চন্দ্রা, ফাগুলালের বউ, যে নিজের স্বামীর চাইতে বেশি আস্থা রাখে সর্দারদের ব্যবস্থাপনার উপর, সে কিন্তু নিজে একটা মেয়ে হয়েও নন্দিনীকে যার পর নাই অপছন্দ করে।
শ্রমিকেরাও কেউ কেউ নন্দিনীকে ভারি সন্দেহ করে। আজকের দিন হলে অ্যাসিড আক্রমণের কথা ভেবে ফেলতে পারত।
সর্দারদের পরিকল্পনা ছিল যে ওরা নন্দিনীকে কোনো হীন উপায়ে বশ করে ফেলবে। নন্দিনীকে হেয় করে দেবে। সামাজিক ভাবে অধঃপতিত করে দেবে। নন্দিনীর সেই অবস্থার কথা জানলে রঞ্জন মরণান্তিক দুঃখ পাবে। সে আর বাঁচতে চাইবে না। গ্লানিবোধে, মনঃকষ্ট পেয়ে শেষ হয়ে যাবে। এতে সর্দারদের সুবিধে এই হবে যে রঞ্জনকে হাতে করে খুন করতে হবে না। রঞ্জন নন্দিনীর অধঃপতন জেনে নিজেই শেষ হয়ে যাবে। খনি শ্রমিকদের মধ্যে রঞ্জনের যে ব্যাপক প্রভাব আছে, সেটাকে হিসেবে রেখেছিল সর্দারের দল। রঞ্জনকে খুন করানো হলে যে শ্রমিক বিক্ষোভ ঘনিয়ে উঠতে পারত, সেটাকে ভয় ছিল সর্দারদের। ওই জন্যে নন্দিনীকে বিচ্ছিন্ন করে আনা, একা করে দেওয়া।
শ্রমিকদের সংহতিকে ভয় পায় সর্দারতন্ত্র। যাতে কোনো ভাবেই শ্রমিকেরা নিজেদের মধ্যে সদর্থক ভাব বিনিময় না করতে পারে, সেই ব্যাপারে উদ্যোগী থাকত যক্ষপুরীর প্রশাসন। শ্রমিকদের কিসে ভুলিয়ে রাখা যায়? এক, মদের নেশা; দুই, ধর্ম জিগির, আর তিন, অস্ত্রের চাপ। মদ, ধর্মমদ আর অস্ত্রাগারকে শ্রমিকের সংহতির বিপরীতে খাড়া করে দেয় সর্দারতন্ত্র। যক্ষপুরীতে ধর্মের জপমালা আর পেটানোর চাবুক একই অভিন্ন সুতোয় বানানো।
আর নন্দিনী ভিতরে ভিতরে শ্রমজীবী মানুষের সংহতি সংঘটিত করতে চায়। সে ৬৯ ঙ এর মধ্য থেকে বিশু নামের মানুষটাকে টেনে বের করে। ৪৭ফ কে মনে করিয়ে দেয় সে আদতে ফাগুলাল। ঈশানী পাড়ার নন্দিন বাছাই করে করে এক একটা মানুষের মধ্যে আলো পুরে দেয়। জাগানিয়া আলো।
তাই নন্দিনীর সংস্পর্শে এসে কিশোর ভয় পেতে ভুলে যায়। ও এনে দেয় রক্তকরবী। ওই রক্তকরবীর রাঙা আমেজ যক্ষপুরীর শোষণমূলক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তোলে।
যক্ষপুরীর ভাঙন বিশারদ রাজার কাছে যেত নন্দিনী। রাজার মধ্যে নন্দিনীর নরম অস্তিত্বের প্রতি একটা লালসাকে সে ব্যবহার করতে চাইছিল। নন্দিনী চাইছিল কোনোভাবে রাজার সাংঘাতিক শক্তির অভিমুখ বদলে দিয়ে সমাজ বদলের লড়াইকে ত্বরান্বিত করে দেবে। আর যক্ষপুরীর প্রশাসন চাইছিল নন্দিনী রাজার এঁটো হোক।
ক্রান্তদর্শী নন্দিনী রাজার মধ্যে একটা মানুষকে খুঁজে বের করতে চায়। সে জানে যে কোনো কিছুই এক রকম নয়। অস্তিত্বের বহুমাত্রিক বহুকৌণিক বহুতলীয় ব্যাপারটা সে গণ্য করে। তাই ইচ্ছে করেই নিজের সজীব সতেজ প্রাণস্পন্দে লোহার জালের ভেতরে থাকা মানুষটাকে অজগরের খোলসের ভিতর থেকে বের করে আনার পরিকল্পনা করে।
যক্ষপুরীর আসল অধিপতি কে, রাজা না সর্দারের দল, সে নিয়ে বেশ কঠিন একটা প্রশ্ন উঠে আসে। রাজা সাংঘাতিক বলিষ্ঠ। কিন্তু চাইলেই কি রাজা যক্ষপুরীর সিস্টেম ভাঙতে পারেন? রাষ্ট্রীয় ধ্বজা আর দণ্ডতে তো একটা আধুনিক রাষ্ট্র সংহত থাকতে পারে না। ধ্বজা তো একটা প্রতীকী বিষয়। “রক্তকরবী” নাটকে যক্ষপুরীর ভিতরে একটা আলো পড়ে। আমরা বহু কিছু টের পেতে থাকি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।