• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ৮ ।। প্রথম ভাগ) 

নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা


পর্ব ৮: যন্ত্র না         

মুখ্য চরিত্র: পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু)
পরিমলঃ এই দ্যাখো, কী কাণ্ড!
পরমা- কী হল আবার!
পরিমল- আজ নাকি সারাদিন এই অঞ্চলে কারেন্ট থাকবে না! কী নাকি মেইন্টেনান্স।
পরমা- কোত্থেকে খবর পেলে?
পরিমল- এই তো, পেপারে দিয়েছে! সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি। এখন ক’টা বাজে দেখি… আরেঃ, ন’টা বাজতে দুই মিনিট যে!
পরমা- ব্যস, বলতে বলতে চলে গেল। পাখা বন্ধ।
পরিমল- মন্দের ভাল, গরমটা পড়েনি এখনো। নাহলে পাখা ছাড়া সারাদিন থাকা যায় নাকি!
(দরজায় ঠকঠক)
পরমা- কিসের যেন একটা আওয়াজ হচ্ছে?
পরিমল- আরে, দরজায় নক করছে কেউ! গিয়ে দ্যাখো!
পরমা- কেন, বেল বাজালেই তো পারে!
পরিমল- কী মুস্কিল, কারেন্ট না থাকলে বেলটা বাজবে কী করে!
পরমা- ওহো, তাও তো বটে!
(আবার ঠকঠক, আর প্রমীলার স্বর- মাসী, দরজাটা খোলেন!)
পরিমল- ওরে বাবা, প্রমীলাদেবী এসেছেন! যাও যাও গিয়ে খুলে দাও দরজাটা!
পরমা- হ্যাঁ, আসছি আসছি! (দরজা খোলেন)
প্রমীলা- মাসী, কতক্ষণ থেকে বেল বাজাচ্ছি, খুলছিলেন না কেন?
পরমা- কারেন্ট নেই তো, বেল বাজবে কী করে!
প্রমীলা- হায় হায়! কারেন্ট নেই! তাহলে আজ আমার সিরিয়ালটা দেখব কী করে!
পরমা- শোনো কথা! তোমার সিরিয়ালের চিন্তা হলো আগে!
প্রমীলা- না মাসী, আসলে মিক্সি না চললেও বাটনা বাটা যায়, ওয়াশিং মেশিন না চললেও হাতে জামাকাপড় কাচা যায়, মাইক্রোওয়েভ না থাকলেও গ্যাসে রান্না করা যায়, কিন্তু টিভি না চললে…
পরমা- বেশ তো, তাহলে বালতিতে জামাকাপড় ভেজানো আছে কাচতে শুরু করে দাও, হয়ে গেলে ঘর ঝাঁট দিয়ে মুছে, গ্যাসে রান্না চাপিয়ে দাও! আমি হাতের কাজটা শেষ করি গিয়ে ততক্ষণ!
(পরিমলের ঘরে গিয়ে)
পরমা- বাব্বা! একেবারে ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে এসেছে! কেন বেল বাজেনি, কেন দরজা খুলতে দেরী…
পরিমল- জানো, ভাবছিলাম, ছোটবেলায় এই কড়ানাড়ার শব্দের জন্য মুখিয়ে থাকতাম… কতো স্মৃতি… পোস্টম্যান এলো হয়তো কারো চিঠি নিয়ে, অথবা হঠাৎ বড়মামা এসে হাজির হলো হৈ-হৈ করতে করতে… আজকাল এই কলিং বেল হয়েই আমাদের এই চেনা ঠকঠক আওয়াজ আর শোনাই যায় না! মানুষের হাতের তবু যেটুকু ছোঁয়া আমাদের জীবনে ছিল, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সেটাও নিয়েছে কেড়ে!
পরমা- তুমি ওই ছোটবেলায় পড়ে থাকো। আর এদিকে প্রমীলা বলছে, কারেন্ট না থাকলে টিভি দেখবে কেমন করে! সেটাই ওর আগে মাথায় এলো!
পরিমল- হাঃ হাঃ হাঃ, যার যেটা শখ! সেদিন একটা জোক শুনলাম, বুঝলে!
পরমা- রাখো তো তোমার ওই বস্তাপচা জোক্স! নির্ঘাত ওই শ্যামলবাবু শুনিয়েছেন!
পরিমল- আহা, শোনোই না! এক ভদ্রলোক শহরে নতুন এসেছেন, আদব কায়দা জানেন না। শপিং মল-এর চলমান সিঁড়িতে উঠেছেন, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেছে! বেচারা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না কারেন্ট আসে! হাঃ-হাঃ-হাঃ!
পরমা- বাঃ! নিজে জোক্স বলে নিজেই হাসো! তা ভালো। (প্রমীলার ডাক শোনা যায়, ‘মাসী!’)
পরমা- উফ, সারাক্ষণ মাসী আর মাসী!! আসছি বাবা আসছি!
পরিমল- আহা, ওভাবে বলছ কেন, মাসীর দরদ তো মায়ের থেকে বেশী হতেই পারে!
পরমা- তুমি কথাটা একটু কম বলো তো! কোথাও বেরোবার নেই তোমার আজ?
পরিমল- হ্যাঁ এই বেরোবো, পোস্ট অফিসে মাসিক টাকাটা জমা দিয়ে আসি!
পরমা- কোথাও তো কারেন্ট নেই বললে, তো পোস্ট অফিসে কাজ হবে?
পরিমল- ওহো, তাইতো! এটা একদম খেয়াল ছিল না! আচ্ছা একটা ফোন করে জেনে নিই আগে।
পরমা- তুমি কথা বলো, আমি দেখি ওদিকে ডাক পড়লো কেন। (প্রস্থান)
পরিমল- নম্বরটা কী যেন… হ্যাঁ, এই যে, পেয়েছি। হ্যালো, হ্যাঁ, আচ্ছা, আজ পোস্ট অফিসে কাজকর্ম… না, কারেন্ট নেই তো, সেইজন্যই… ওহো, কিন্তু… না না, আমি টাকা জমা দেব শুধু… জমাও নেবেন না? কিন্তু আজই তো লাস্ট ডে, কাল তো পেনাল্টি কাটবেন!… কী মুস্কিল, আমি কী করে জানবো যে আজ সারাদিন কারেন্ট থাকবেনা… আচ্ছা। আচ্ছা বুঝেছি। রাখছি।
(পরমার প্রবেশ)- কী হল? কী বললেন?
পরিমল- কী আবার বলবেন! আজ ছুটি। কারেন্ট নেই তাই সব কাজ বন্ধ।
পরমা- টাকা জমা নিতেও কি কারেন্ট চাই নাকি!
পরিমল- বলল তো তাই! সার্ভার ডাউন থাকবে, তাই লেনদেন করা যাবে না কিছুই। আগেকার ওই খাতায় লেখাই ভালো ছিল জানো তো!
পরমা- তোমার তো সব আগেকার জিনিসই ভালো লাগে! দরজায় ঠকঠক, খাতায় লিখে টাকা জমা নেওয়া…
পরিমল- আচ্ছা, তোমার মনে হয়না, এই যে আমরা আজকাল এত বেশী যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছি, এটা একটা ভয়ঙ্কর বদভ্যাস!
পরমা- তা তো বটেই! এই তো, প্রমীলাকে বললাম মশলাগুলো বেটে নাও, তো বলে কিনা শিলে নাকি বাটতে পারে না, মিক্সি ছাড়া চলে না নাকি বিবির! আবার আমাকে বেটে দিতে হলো।
পরিমল- প্রসূন ঠিকই বলে। কাজ সব তুমিই করবে, অথচ কাজের অন্য লোক না হলেও চলবে না তোমার! কিন্তু ভেবে দেখো, এই যন্ত্রনির্ভর হওয়ার জন্যই প্রমীলা, পোস্ট অফিসার এদের মজা, কারণ আজ ছুটি!
পরমা- তাহলেই বোঝো, যন্ত্রনির্ভর হওয়ার সুবিধাও আছে!
(পরিমলের ফোন বাজে) পরিমল- ওই, বোধহয় পোস্টমাস্টার ফোন করেছেন, টাকাটা বোধহয় জমা দেওয়া যাবে আজ। দেখি… না তো, এ তো প্রীতি ফোন করছে !!
পরমা- প্রীতি? এখন? কী হলো দেখো তো!
পরিমল- হ্যাঁ মা, কী হয়েছে? তুই কোথায়? বাড়িতে? তার মানে? এত হাঁফাচ্ছিস কেন, কী হয়েছে?
পরমা- ধুর তোমায় দিয়ে হবে না, আমায় দাও ফোনটা… হ্যালো প্রীতি? তুই কোথায়? ওহো, দরজার বাইরে? তাহলে বেল বাজাচ্ছিস না কেন? ওহো, হ্যাঁ হ্যাঁ, কারেন্ট নেই… দাঁড়া খুলছি!~
(পরমার প্রস্থান পরমা এবং প্রীতির প্রবেশ)
প্রীতি- উফ মা, কতক্ষণ থেকে বেল বাজাচ্ছি…
পরিমল- আরে কারেন্ট নেই যে!
প্রীতি- ভুলে গেছি তো! জানো, কারেন্ট নেই বলে আমাদের কলেজ ছুটি হয়ে গেল।
পরিমল- অ্যাঁ!! কলেজ ছুটি দিয়ে দিল কারেন্ট নেই বলে!!
প্রীতি- কম্প্যুটার ল্যাবে কাজ হবে না, ক্লাসে পাখা চলবে না, কী করে সামলাবে! তাই ছুটি।
পরমা- তোমাদের সময়ে এমন হতো না, বলো?
পরিমল- আরে, আমার সময় আর তোমার সময় কি খুব আলাদা নাকি! হতো নাই তো! আমাদের ক্লাসরুমে পাখাই ছিল না, আর কম্প্যুটারের তো নামই শুনিনি সে যুগে!
পরমা- কিন্তু তুই এত হাঁফাচ্ছিস কেন!
প্রীতি- আর বোলো না। আমাদের লাইব্রেরিটা সেভেন্থ ফ্লোরে। ছুটি অ্যানাউন্স করবার সময় সেখানেই ছিলাম। ব্যাস, লিফট বন্ধ, হেঁটে নামতে হলো…
পরিমল- আধঘণ্টা আগে সাততলা থেকে… না, সেভেন্থ ফ্লোর মানে তো ছ’তলা… ছ’তলা থেকে হেঁটে নেমে এমন হাঁফাচ্ছিস, যেন ম্যারাথন দৌড়ে এলি, অ্যাঁ? ছি ছি! একটুও এনার্জী নেই তোদের!
পরমা- আচ্ছা, কলেজ ছুটি হলে স্কুলও ছুটি হবে তো, তাহলে জুঁই আর প্রিয়মও ফিরে আসবে!
প্রীতি- না মা, স্কুল ছুটি নাও দিতে পারে।
পরিমল- টিভিতে দ্যাখো না, নিউজে কিছু বলছে নাকি!
পরমা- হ্যাঁ সেই দেখি… ওহ, আবার আমার পিছনে লাগা হচ্ছে, তাই না? আমি ভুলে গেছি এখন টিভি চলবে না, তাই…
(পরমা আর প্রীতির হাসি। ভিতর থেকে প্রমীলা আবার ডাকে, “মাসী!”)
পরমা- আসি!
পরিমল- দেখলি প্রীতি! একদিন একটুখানি কারেন্ট গিয়ে তোর মা-কে কেমন কবি বানিয়ে দিল! মিলিয়ে মিলিয়ে উত্তর দিচ্ছে!!
প্রীতি- উফফ, বাবা, তুমি না, সত্যি! হা হা হা!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।