• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। দ্বিতীয় ভাগ)

নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা

পর্ব – ১: ক্রেডিট কার্ড

(আগে যা ঘটেছেঃ রিটায়ার করা পরিমলবাবু একটু প্রাচীনপন্থী। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। তবু, নানারকম সুবিধা হচ্ছে দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের ক্রেডিট কার্ড নিতে রাজী হয়েছেন। তারপর-)
আনন্দঃ হ্যাঁ, ব্যাস। আর দুটো সই করতে হবে আপনাকে।
পরিমলবাবুঃ একটা এইটুকু কার্ডের জন্য এত্তগুলো কাগজে সই করতে হয় নাকি!
আনন্দঃ কাকাবাবু, কার্ডটা ছোট, কিন্তু তার কাজটা দেখুন!
পরিমলবাবুঃ আহা, কী এমন ভারি কাজ! আদৌ আমি ব্যাবহার করব কি না তাই জানিনা…
প্রীতিঃ উফফ, বাবা, এইভাবে দেখ, এই কার্ডের লিমিট হবে চল্লিশ হাজার টাকা। তার মানে, হঠাৎ যে কোনো প্রয়োজনে তুমি চল্লিশ হাজার টাকা ধার পেতে পারবে এখন!
পরমাঃ তোর বাবার কথা আর বলিসনা। সেদিন সাউথ সিটি মল-এ আমার একটা শাড়ি পছন্দ হলো, তো বলল কিনা অত টাকা এখন নেই, পরে আসব। বাড়ি ফিরে বলল, পাড়ার নিতাইয়ের দোকানে নাকি ঐ শাড়িটাই অনেক কম দামে পাওয়া যাবে, সেখান থেকে কিনে দেবে!
প্রীতিঃ সেকি! বাবা, তুমি সাউথ সিটি মল-এ গেছিলে মা-কে নিয়ে!
পরমাঃ হ্যাঁ, আমায় নিয়ে গেছিলই বটে! আমিই কতো বলেকয়ে, প্রায় জবরদস্তি করে…
প্রীতিঃ হি-হি-হি! আই স্টিল কান্ট বিলিভ! বাবা বলোনা গো তুমি ওখানে গিয়ে কী দেখলে?
পরিমলবাবুঃ দেখলাম, কতো রকমের জিনিসের আমাদের প্রয়োজন নেই! কতোকিছু না কিনেই আমরা সুখে থাকতে পারি!
পরমাঃ হ্যাঁ, আমারই কপালে জুটেছে একটা কিপ্টে! অত সুন্দর শাড়িটা…
পরিমলবাবুঃ আচ্ছা, ঠিক আছে, এই কার্ডটা দিয়ে ঐ শাড়িটাই কিনে দেব তোমায়। বাবা আনন্দ, তোমার হলো?
প্রীতিঃ ইয়েয়েয়ে!! বাবা, ইয়ু আর গ্রেট! মা, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে শাড়ি কেনা দেখতে! আনন্দ, তুমিও এসো সেদিন! উই মাস্ট সেলিব্রেট!
পরমাঃ ধ্যাত! তোদের না, যতো…
আনন্দঃ হ্যাঁ, এই তো হয়ে গেছে সব। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কার্ড আক্টিভ হয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে একটা পিন আসবে, সেটা সাবধানে রাখবেন কেমন?
পরিমলবাবুঃ পিন মানে? পিন দিয়ে কী হবে?
আনন্দঃ পি আই এন, পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার। কার্ড সোয়াইপ করে ঐ চার অঙ্কের পিনটা টাইপ করলে তবেই ট্রাঞ্জ্যাকশন হবে।
পরিমলবাবুঃ ওরে বাবা, একা কার্ডে রক্ষা নেই, আবার পিন দোসর! অত আমি মনে রাখতে পারব না!
প্রীতিঃ এক কাজ কোরো বাবা, তুমি মা-কে পিনটা বলে রেখো। মা মনে রাখবে।
পরিমলবাবুঃ এটা ঠিক বলেছিস। তোর মা কিচ্ছু ভোলে না। সেই ত্রিশ বছর আগে কবে মুখ ফসকে আমি কী বলে ফেলেছিলাম, সেই সব কথা আজও শোনায়!
পরমাঃ অ্যাই, শুরু হয়ে গেল বৌকে খোঁটা দেওয়া! একবার সুযোগ পেলে হয়…!
প্রীতিঃ আহা, মা, কেন বাবাকে এমন বলছ! নেক্সট উইকেই বাবা তোমায় সেই পছন্দের শাড়িটা কিনে দেবে প্রমিস করেছে তো!
আনন্দঃ কাকাবাবু, একটা কথা জানিয়ে দিই… আজকাল এই ক্রেডিট কার্ডে কিন্তু প্রচুর দু’নম্বরী হচ্ছে! তাই কেউ আপনাকে ফোন করে যদি বলে ব্যাঙ্ক থেকে বলছি, আপনার পিন নাম্বারটা দিন, খবর্দার দেবেন না! কোনো অবস্থাতেই না! ওঁরা ফ্রড, আপনার পিন জেনে নিয়ে আপনার টাকা তুলে নেবে!
পরিমলবাবুঃ ওরেবাবা, কী সাংঘাতিক! তাহলে!!
আনন্দঃ ভয়ের কিচ্ছু নেই। কোনো ব্যাঙ্ক কখনোই কাস্টমারদের পিন জানতে চাইবে না। আর যদি এমন কোনও ফোন আসে, আপনি সোজা আমাকে, অথবা ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে জানিয়ে দেবেন। পিনটা কখনো জানাবেন না, কেমন? আচ্ছা, আমি তাহলে আসি?
পরিমলবাবুঃ আচ্ছা, এসো… উফ, যা বললে, বুকটা ধড়ফড় করছে!

(রাতে ডাইনিং টেবলে)

প্রসুনঃ যাক, তাহলে বাবা তোমারও ক্রেডিট কার্ড এসে যাচ্ছে! এবার তুমিও অনলাইনে যেমন খুশি কেনাকাটা করতে পারবে!
জুঁইঃ বাবা, জানেন কি, আজকাল সব্জীর বাজারও অনলাইনে করা যায়! আপনাকে তাহলে আর প্রতিদিন কষ্ট করে…
পরিমলবাবুঃ না না! ঐ নিজের হাতে রোজ বাজারটা না করলে আমার চলবে না মা! ওইটি বন্ধ করতে বোলো না।
পরমাঃ তা চলবে কেন! আড্ডাটা তো ওখানেই হয়! এ পাড়ার রমেশবাবু, ও পাড়ার সুধীরবাবু সকলে মিলে গুজগুজ ফুসফুস বউদের সমালোচনা না করলে কী আর ভাত হজম হয়!
জুঁই- আহা, মা, অমন বলছেন কেন, একটু আড্ডা না হলে কি মানুষ বাঁচে?
পরিমলবাবুঃ বৌমা তুমিই বলো, তোমাদের যেমন ঐ কী সব ফেসবুক-টুক আছে, আমার তো সেসব নেই! ঐ দিনে আধঘন্টা লোকজন দেখি, কথাবার্তা বলি, এটুকুই…
প্রীতিঃ আচ্ছা, আচ্ছা, শান্তি। বাবা, তোমার বাজারে যাওয়া বন্ধ করতে হবে না। কিন্তু সাউথ সিটি গিয়ে মায়ের শাড়িটা তোমায় কিনে দিতেই হবে!
প্রসুনঃ ওয়াও! বাবা মা-কে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে শাড়ি কিনে দেবে!!
প্রিয়মঃ দাদু, আমিও একটা ভিডিও গেম পছন্দ করে রেখেছি। আমাকেও কিনে দেবে তো?
জুঁইঃ একি অসভ্যতা প্রিয়ম! ওইভাবে কেউ চায় নাকি! আর তোমার তো কত ভিডিও গেম আছে!
প্রিয়মঃ কিন্তু মা, ওগুলো সব ওল্ড ভার্সন, লেটেস্ট বেরিয়েছে তো! সুনীল কিনেছে!
জুঁইঃ বাঃ! সুনীল কিনলেই তোমায় কিনতে হবে! না বাবা, আপনি একদম কিনে দেবেন না!
পরিমলবাবুঃ আহা, ওকে বকছ কেন বোউমা! ছোট ছেলে ইচ্ছে হতেই পারে! আচ্ছা দাদা, আমি তোমায় নেক্সট মান্থে কিনে দেব। তোমার হ্যাপি বার্থডে আসছে, ওটাই হবে আমার গিফট, কেমন?
প্রিয়মঃ ইয়েয়েয়েয়ে! থ্যাঙ্কু দাদু!!
প্রসুনঃ ব্যাস, মায়ের শাড়ি, প্রিয়মের ভিডিও গেম, কার্ড হাতে আসবার আগেই কেনার লিস্ট তৈরি! একেই বলে, গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!

(কিছুদিন পর)

প্রীতিঃ বাবা, তাহলে তোমার সব এসে গেছে তো হাতে? কার্ড, পিন…
পরিমলবাবুঃ হ্যাঁ, এসে গেছে। এবার একদিন যাবো তোর মাকে নিয়ে…
প্রীতিঃ নট ডান বাবা! শুধু মা-কে নিয়ে যাবে নাকি!
পরিমলবাবুঃ আরে না না, তোরাও যাবি নিশ্চয়ই। প্রসুনের কবে ছুটি-টুটি দেখি!
পরমাঃ ব্যাস হয়ে গেল! প্রসুনের আবার ছুটি! দরকার নেই আমার শাড়ি!
পরিমলবাবুঃ আহহা, রাগ করো কেন! দেখছি কী করা যায়।
পরমাঃ কিচ্ছু দেখতে হবে না তোমায়।
(খানিক বাদে)
(টেলিফোন বাজছে।)
পরিমলবাবুঃ হ্যালো!
ম্যানেজারঃ হ্যালো, মিঃ পরিমল বলছেন?
পরিমলবাবুঃ হ্যাঁ, বলছি, আপনি?
ম্যানেজারঃ আমি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছি। আপনার ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে একটা জরুরী কথা ছিল।
পরিমলবাবুঃ ওঃ হো, এর মধ্যেই শুরু করে দিলেন! আনন্দ এই আপনাদের কথাই বলছিল।
ম্যানেজারঃ আপনার কার্ডটা কেউ একজন ভুলভাবে ব্যবহার করছেন। এরপর এরকম হলে আমরা কার্ডটা লক করে দিতে বাধ্য হব।
পরিমলবাবুঃ হ্যাঁ, এইতো এইতো! ঠিক লাইনে এগোচ্ছেন! আমি জানতাম!
ম্যানেজারঃ আপনি জানতেন? তার মানে?
পরিমলবাবুঃ হ্যাঁ জানতাম! এবার আপনি বলবেন, আমি যদি পিন নম্বরটা বলি, একমাত্র তাহলেই কার্ডটা লক হওয়া থেকে আটকানো যাবে, তাই তো?
ম্যানেজারঃ আপনি ভুল বুঝছেন। আমি আপনার পিন নম্বর চাইনি।
পরিমলবাবুঃ চাননি বটে, কিন্তু এবার চাইবেন। আপনাদের তো এটাই স্টাইল, তাই না? আগে কার্ড লক হওয়ার ভয় দেখিয়ে…
ম্যানেজারঃ দেখুন, আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
পরিমলবাবুঃ না, আমার নয়, ভুল আপনার হয়েছে। ভেবেছেন নতুন গ্রাহক, তাই ভয় পেয়ে সব সহজেই বলে দেব, তাই না? কিন্তু আমার নাম পরিমল! মাথার চুলগুলো রোদ্দুরে সাদা হয়নি! পুরনো দিনের লোক হতে পারি, তাই বলে এতটাও বোকা নই যে সহজেই টুপি পরাবেন আমাকে! শুনে রাখুন, আমার কার্ড আমার কাছেই আছে, বাড়িতে। কেউ সেটা এখনো ব্যবহার করেনি। আপনাদের চালে বিরাট ভুল হয়েছে, বুঝলেন? সকলকে অত সহজে বোকা বানানো যায় না। এবার ফোনটা রাখুন।
ম্যানেজারঃ দেখুন, আবার বলছি, আপনার কার্ড ভুল ব্যবহার হয়েছে, এটা আপনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য, তাই সেটুকু জানাতেই আমি ফোন করেছি।
পরিমলবাবুঃ তাহলে এখনো স্বীকার করবেন না! আচ্ছা, আপনার নামটা কী বলুন তো? কোন ব্রাঞ্চের ম্যানেজার আপনি? আমি আসব আপনার সঙ্গে এখুনি দেখা করতে? সাহস আছে, আমার মুখোমুখি হওয়ার?
(পরমার প্রবেশ) পরমাঃ কী হলো? কার ওপর চোটপাট করছ ফোনে?
পরিমলবাবুঃ আরে, ফ্রড একটা, বলে কিনা আমার কার্ড লক করে দেবে!
পরমাঃ ভালই হবে। তোমার ঐ কার্ড কোনো কম্মের নয়। টাকা তুলতে গেলাম, কী সব বলে দিল!
পরিমলবাবুঃ টাকা তুলতে! মানে!!
পরমাঃ মানে আর কি! একটু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম। টাকা ছিল না, তাই ভাবলাম তোমার ওয়ালেট থেকে নিয়ে যাই। তা তোমার ওয়ালেটের অবস্থাও তো দেখলাম সঙ্গীন, তাই তোমার ঐ কার্ডটা নিয়ে…
পরিমলবাবুঃ অ্যাঁ! তার মানে তুমি সত্যিই আমার কার্ড নিয়ে…
পরমাঃ তো কী হয়েছে, শুনি? তখনো তো আমার রাগ পড়েনি, তাই তোমায় আর জানাইনি। কার্ডটা নিয়ে ভাবলাম এটিএম থেকে একটু টাকা তুলে নিই…
পরিমলবাবুঃ সর্বনাশ!! তারপর?
পরমাঃ তো কোথায় কী! তোমার কার্ড ঢুকিয়ে ঐ পিন না পেরেক নম্বর টাইপ করলাম, কী সব পিঁক পিঁক আওয়াজ হয়ে কার্ডটা বেরিয়ে এলো, টাকা এলো না!
পরিমলবাবুঃ উফফফফ… তুমি এইদিকে… আর আমি ঐ ভদ্রলোককে না যেন কী সব বললাম।। ছি ছি!
পরমাঃ ছি ছি মানে? বেশ করেছ বলেছ। কী ছাতার কার্ড, দরকারে টাকা পাওয়া যায় না! ফেলে দাও।
পরিমলবাবুঃ ফেলে দেব! তাহলে তোমার শাড়ি?
পরমাঃ দরকার নেই আমার শাড়ি। এই বেশ আছি। যখন সত্যিই কিছু কেনার প্রয়োজন হবে, হাতে হাতে টাকা দিয়ে কিনব।
পরিমলবাবুঃ এইতো! এতক্ষণে কাজের কথাটা বলেছ। ঠিক, এইসব নতুন জিনিসের হ্যাপা বড্ড বেশী। ফেলেই দিই কার্ডটা। না না, ফেলব না, বরং আমার বইয়ের পেজমার্ক হিসেবে ব্যবহার করি! বই পড়তে গেলেই মনে পড়বে, কতো নিশ্চিন্তে আমরা জীবন কাটাচ্ছি!

সমাপ্ত  

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।