• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় ঋভু চট্টোপাধ্যায়

কোশ বিভাজন 

বাসে ওঠার আগে শর্মিলা হঠাৎ তন্বীকে বলে ওঠে,‘তোকে একটা কথা বলব কিছু মনে করবি না তো?’
–মনে করব ?এই রকম কথা।
-না মানে কাকুর ব্যাপারে। আমার বাবা নিজের চোখে দেখে কিনা, জাস্ট একটা জেনারেল কোয়েরি বলতে পারিস। তারপরেই বলে।
ভাগ্য ভালো সবার সামনে কিছু বলে নি।তাও একা থাকলেই কথাগুলো ভাসতে ভাসতে পাকাপোক্ত ভাবে তন্বীর মনের ভিতরে বাসা বাঁধতে আরম্ভ করে দেয়।সত্যিই কি বাবার আবার নতুন কোনো…
তারপর একমনে কথাগুলো শুনে গেলেও সেরকম ভাবে নি।আসলে বাবাকে নিয়ে এই ভাবনাগুলো কোনদিন তন্বীর মনে জায়গা পায় নি।জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছে মা বিছানায় শুয়ে আছে।তন্বীর সেভাবে মায়ের কোলে চেপে ঘোরবার মত ঘটনাও মনে পড়ে না।তবে শুনেছে,‘তিন বছর বয়স পর্যন্ত নাকি যথাক্রমে মায়ের কোলে ও সঙ্গে ঘুরেছে।তারপর একতলার ছাদের উপর থেকে ফুল পারবার সময় মা পড়ে গিয়ে সেই যে কোমরে আঘাত পেল, তারপর থেকে আর দাঁড়াতে পারে নি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই আরম্ভ হল আরেকটা জীবন।তন্বীর তখন তিন সাড়ে তিন বছর বয়স হবে।তখন থেকেই বাবা…।
শর্মিলার মুখে সেদিন কথাগুলো শুনে ঘরে ফিরে দেখে বাবা অফিস থেকে এসে টিফিন তৈরী করে অপেক্ষা করছে।তন্বী কাছে আসতেই এক গাল হেসে বলে ওঠে,‘তুই এসে গেছিস, আমি এই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।এই দ্যাখ ডিম পাউরুটি বানালাম, গরম গরম খেয়ে নিবি।’
এর পর আর মানুষটাকে জিজ্ঞেস করা যায়,‘বাবা তোমার জীবনে কি….’
‘এটাই তো স্বাভাবিক, এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।’
কথাগুলো শুনে আবীর খুব সহজেই উত্তর দেয়।যেন মেঘ করেছে বৃষ্টি হবে, অথবা শীতকালে খুব শীত, অথবা সরকারের দেওয়া কোন মৃত্যুর হিসাব।অবশ্য কথাগুলো শুনে তন্বীর খুব রাগ হল।বলে উঠল,‘তার মানে তোমারও এরকম আরো সম্পর্ক আছে, আমি জাস্ট একটা ফাউ, অথবা টাইম পাশ।’
– কাকুর বয়স কত ?
-আটচল্লিশ রানিং।
-সিয়োর!
-এই তো দুমাস আগে একটা শার্ট কিনে দিলাম।
-কাকু কিন্তু যথেষ্ট হ্যাণ্ডসাম।এই রকম একটা লোক এত দিন ধরে একা।
-একা কেন হবে? আমি তো আছি।
-তুমি মেয়ে, বউ নও।
তন্বী সেদিন আর কথা বাড়ায় নি।আবীর অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখেই আবীরকে না জানিয়েই ফোনটা রেখে দেয়।মাথাটা কেমন যেন ধরে ধরে আসছে।বাবা কি সত্যি কোন…।
তা হলে তো অফিস থেকে কোন ফোন আসত, বাবা লুকিয়ে ফোন করত। রাতে করে?করলেও তো তন্বী বুঝতে পারত।রাত করে শোওয়া তার অভ্যাস।আগে বাবার সাথে শুত, ক্লাস এইট থেকে আলাদা ঘরে ব্যবস্থা করে বলেছে,‘তুই এবার থেকে আলাদা এই ঘরে শুবি। রাত জেগে পড়তে হবে তো।তবে তোর ভয় নেই আমি পাশের ঘরে জেগে থাকবো।’
তন্বী রাতে মাঝে মাঝে উঠে দেখত বাবা ঠিক জেগে আছে, হয় বই পড়ছে, না হয় এমনিই শুয়ে আছে।বারান্দাতে আলো জ্বালালেই বলত,‘কি রে হয়ে গেল, এবার শুয়ে পড়।’ কোন কোন দিন অবশ্য বাবা ঘুমিয়েও পড়ত।
মা যখন মারা যায়….. !
হঠাৎ তন্বীর মনে সেসব কথা ভিড় করে আসতে আরম্ভ করে।ক্লাস সিক্সে পড়ত তো পরিষ্কার মনে পড়ে দিন কয়েক আগেই মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।মায়ের সারা গায়ে নাকি ঘা হয়ে গেছিল।রোগটার নাম তখন মনে ছিল না।পরে বাবার মুখে তন্বী শুনেছিল,‘বেডশোর।’ তাও রাতেও বাবা ঘুম থেকে উঠে মাকে পাশ ফিরিয়ে দিত। মা চিৎকার করত,‘ঘুরিয়ে দাও, আমায় ঘুরিয়ে দাও।’
মাঝে মাঝে তন্বীরও ঘুম ভেঙে যেত, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত,‘বাবা, মায়ের পিঠে পাউডার লাগিয়ে দিচ্ছে, আর কি সব মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।’ তন্বীকে দেখলে বাবা বলে উঠত,‘তুই কেন উঠলি, যা, শুয়ে পড়, কাল সকালে স্কুল আছে না?’
তন্বী তখন একবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করেনি,‘বাবা তোমারও তো অফিস আছে।’ অথচ ঘুম থেকে উঠেই দেখত বাবার ভাত, টিফিন সব তৈরী করা হয়ে গেছে।মায়েরও শাড়ি ছাড়িয়ে দিয়েছে।পরে বুঝতে শিখেছে, তার আগে বেড প্যান পরিষ্কার, করা ছাড়াও মাকে স্নানও করাতো।এর মাঝে তন্বীকে স্কুলের বাসে তুলে দিয়ে এসে আয়া মাসি এলে তারপর অফিস বেরোত।বাবা তো কখনও রাগে নি।আর কার উপরই বা রাগবে? তন্বীর চোখের সামনে মায়ের মারা যাবার দিনটার সব ঘটনা এখনো পরিষ্কার মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে।সকাল থেকেই শুনছিল মায়ের শরীরটা ভালো নেই।তাও একটা ক্লাস টেস্ট থাকবার জন্য তাকে স্কুলে যেতে হয়।টেস্টের মাঝেই অফিস থেকে মালতি মাসি তন্বীকে ডেকে নিয়ে যায়।মালতি মাসি খুব ভালোবাসত, স্কুলে পিওনের চাকরি করত।তাও ঐ অল্প পেমেন্টের মধ্যেই মাঝে মাঝেই তন্বীর জন্যে চকলেট, বিস্কুট কিনে দিত।মামা সেদিন স্কুলে আনতে গেছিল। মালতি মাসির চোখের কোণে জল দেখে তন্বী কিছুটা বুঝতেও পেরেছিল।তারপর বাড়ি ফিরে মাকে দেখতে পায়। ফ্ল্যাটের উপরে আর ওঠায় নি।মাসিরা এসেছিল, দুই মামি, এমনকি কাকিও।সবাই কাঁদছিল খুব, তন্বীর কিন্তু একটুও কান্না পাচ্ছিল না।বাবা খুব ব্যস্ত ছিল, তাও বাবার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল।বাবা কোলে তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,‘কাঁদিস না, আমি তো আছি।’
তন্বীর কাছে মা মানেই ছিল একজন শুয়ে থাকা মানুষ, কাছে গেলেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলত,‘ঐ ওষুধটা দে তো, অথবা ঐ বোতল থেকে একগ্লাস জল গড়িয়ে দে তো।’ ফ্ল্যাটে ঢুকেই সেই বিছানাটা ফাঁকা দেখে ছিল এই যা। আস্তে আস্তে ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেলেও সেই শূন্যতা কোন দিন তন্বীর মনটা গ্রাস করতে পারে নি। আসলে মা তো কোন দিন কোন ব্যাপারেই থাকত না, তন্বীর কাছে মা মানেই ছিল একটা বিছানা, একটা মানুষের শুধু শুয়ে থাকা।
মা মারা যাবার এক বছর পর তন্বী ও বাবা প্রথম বাইরে ঘুরতে যায়। সেই সময়েই অন্য সবার মায়েদের দেখে তন্বীর প্রথম কান্না আসে। রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদার সময় বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,‘বোকা মেয়ে, কেউ কাঁদে? সবার কি সব কিছু থাকে? আমার তো তুই ছাড়া কেউ নেই, আমি কি কাঁদছি?’
ফোনটা বেজে উঠল।এত রাতে কে আবার ফোন করল।
তন্বী ফোনটা তুলতেই দেখল ‘বড়মাসি কলিং।’
বড়মাসি! এই সাড়ে দশটার সময়! মেসোমশাইএর শরীর খারাপ হল নাকি? কিন্তু ফোনটা রিসিভ করবার পর সব ধারণা বদলে গেল। একথা সেকথার মাঝে বড় বাসি জিজ্ঞেস করে বসল,‘তোর বাবার সাথে পরে কথা বলব,এখন বলতো তোর বাবার কি খবর?’
তারপরেই বলতে লাগল মেসোমশাই এর কোন বন্ধু বাবাকে কোন ভদ্রমহিলার সাথে কোথায় কোথায় দেখেছে। কথাগুলো শুনতে শুনতে তন্বীর মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিল।এই বড়মাসিরা মা মারা যাবার ছ’মাস যেতে না যেতেই বার বার করে বলতে আরম্ভ করেছিল,‘এত ছোট মেয়েকে মানুষ করবে কি করে, তার থেকে বিয়ে করে নাও। আমাদের বোন, কিন্তু আমরাই তোমাকে বলছি।’ বাবা কিন্তু কিছুতেই রাজি হয় নি। উত্তরে বারবার বলেছে,‘মেয়ে বড় হয়ে গেছে। এখন বিয়ে করাটা ঠিক নয়, তাছাড়া আমি তো সামলে নিচ্ছি।তন্বীও নিজে নিজে সব কিছু করতে পারে।এই মুহূর্তে আর কোন নিড নেই।দশ পনেরোটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
-কিন্তু জৈবিক প্রয়োজনটা, কাকুর ওটাও তো দরকার। তাছাড়া একটা বিপরীত সেক্সের বন্ধু প্রত্যেক মানুষের খুব প্রয়োজন হয়ে যায়।
কথাগুলো একদিন কোন একটা প্রসঙ্গে আবীর বলে ছিল।
সেবারেও ভালো লাগেনি। আসলে আবীর কেমন যেন, মা বাবা কারোর ব্যাপারেই কোন সম্মান দেয় না। কাঠ কাঠ কথা বলে। ক্লাস সেভেনে যখন সন্তান জন্মাবার রহস্য বন্ধুদের মুখে শোনে তন্বীর ভালো লাগে নি। মা বাবা ….ছিঃ ছিঃ।পরে অবশ্য আবীরের সাথে ঘনিষ্ঠতা হবার পর অনেক বিষয় সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা চলে যায়। অনেক কিছু বুঝতে শেখে ভাবতে শেখে।
-দ্যাখো, মাসি, বাবাটা তো আমার, মানুষটাকে আমি নিয়ে থাকি, কি করতে পারে, কি পারে না, আমিই সব থেকে ভালো জানি। তোমাদের এই বিষয়ে আর ভাবতে হবে না।যে মানুষ জীবনের সব থেকে সুন্দর সময়টা অসুস্থ স্ত্রী আর বাকিটা মেয়েকে বড় করতে কাটিয়ে দেয়, তার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকে না।
ফোনে এতগুলো কথা বললেও ভালো লাগল না। ব্যাপারটা ভীষণ গোলমেলে লাগছে। দুসপ্তাহের মধ্যে এত জন এতবার করে একই কথা বলে যাচ্ছে, তার মানে কি……!
তন্বীর মনে পড়ল, মা বেঁচে থাকাকালীন মুনমুন নামে একজন মাকে দেখাশোনা করত। বাবা কোন দিন আপনি ছাড়া কথা বলে নি।তন্বী ছোট থাকলেও দূরত্বটা চোখে পড়ত। না, খুব কষ্ট করেও বাবার ব্যাপারে খারাপ কিছু ভাবতে পারছে না। মানুষটা কি করে নি।একা হাতে তন্বীকে বড় করল, সব থেকে বড় ব্যাপার একটা বারের জন্যেও বাবার মুখে শোনে নি,‘আমি আর পারছি না।তুই এটা করে নে।’
শুধু একবার স্কুল থেকে ফিরে হঠাৎ করে পেটে ব্যথা করতে আরম্ভ করে। বাবা অফিস থেকে ফিরে সব কিছু শুনে পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমার কাছে গিয়ে বলতে বলে।নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে বাবার সামনে দাঁড়াতেই তন্বীর নিজের খুব লজ্জা লাগে।সেই সময়েও বাবা খুব সু্ন্দর ভাবে সব কিছু বুঝিয়ে বলে।তন্বীর আর কোন সংকোচ হয় না, পরের বার থেকে প্রয়োজন মত বাবাকেই সব কিছু এনে দিতে বলে।এই তো বাবা।
দু’এক বছরের মধ্যেই তার বিয়ে হয়ে গেলে তখন তো বাবাকে একাই থাকতে হবে।আবীর এখন দিল্লীতে, কিন্তু সামনের বছরেই ইতালি চলে যাবে।তখন তো বাবাকে একাই থাকতে হবে।ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে কি বাবাকে জিজ্ঞেস করবে? ঠিক যেমন ভাবে আবীরের কথা বলেছিল।বাবা সেদিনও রাগে নি।শুধু চোখ মুখে একটা অবাক হয়ে যাবার ছাপ ফুটে উঠেছিল।কিছু সময় একভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেছিল,‘আমার ছোট্ট মেয়েটা এবার তাহলে বড় হয়ে গেছে।ভালোই হয়েছে, আমার একটা কাজ কমিয়ে দিয়েছে।কোন দিন স্বপ্নে তোর মা এলে বলতে হবে।’
কয়েকদিন আগে তন্বী কোন একটা পত্রিকায় একটা গল্প পড়েছিল,‘কি যেন একটা নাম গল্পটার।সেখানে একটা ছেলে তার নিজের মায়ের বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে তাও আবার সবাইকে জানিয়ে, নিমন্ত্রণ করে।রবিবারের কাগজেও এরকম অনেক বিজ্ঞাপণ দেখেছে। কিন্তু বাবা কি এত দিন পরে রাজি হবে? ঐ ভদ্রমহিলায় বা কে ঘটনাটাই বা কি?অফিসের কোন আন্টি! কার যেন রিসেন্ট হাসব্যাণ্ড মারা গেলেন, উনি! কিন্তু কোনদিন তো বাবার মুখে সেরকম ভাবে কোন আন্টির নাম শোনে নি।সেরকম কেউ ফোনও করত না। দু’একবার যা ফোন এসেছিল তন্বী শুনেছে বাবা সবার সাথে দূরত্ব বজায় রেখেয় কথা বলে।তাহলে!
তন্বীর ঘুম আসে না।জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে চোখ রাখে।ও’পাশটা কেমন যেন অদ্ভুত রকমের শান্ত।সারাটা ঘর পায়চারি করে, বাবার ঘরের দরজাটা খুলে একবার দেখে।বাবা ঘুমাচ্ছে।
তন্বী বারান্দায় আসে।মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ায়।এখন রাত্রিবেলা, চারদিকে অন্ধকার। কাল ভোরে আলো ফুটলে কিছু উত্তর পেতে পারে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।