• Uncategorized
  • 0

পুরনো কোলকাতার দুর্গাপুজোর গল্পে অমিতাভ দাস 

পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজোর গল্প

পুরনো কলকাতার গল্প বলতে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার দুর্গাপুজোর কথা এসেই যায় । আজ পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু গল্প  করা যাক ।
বিপ্রদাস পিপলাইয়ের লেখা” মনসা মঙ্গল” কাব্যটি পঞ্চদশ শতকের লেখা । সেখানে আমরা দুগাপুজোর উল্লেখ পাই । ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে খেতাব লাভ করে হালিশহর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন । এবং শুরু করেন প্রথম সপরিবার দুর্গার পুজো ।পুজো হয়েছিল বড়িষা গ্রামে । পরে তাঁরা ১৬৯৯ সালে রায় চৌধুরী খেতাব পান ।
কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম পূজা কুমারটুলির গোবিন্দরাম মিত্রের বাড়ির পুজো ।তবে সে পুজোর সঠিক সন-তারিখ জানা যায় না । তবে প্রবাদ আছে ‘গোবিন্দরামের ছড়ি বনমালি সরকারের বাড়ি ,আর উমিচাঁদের দাড়ি ।’ গোবিন্দরাম ১৭২০ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত জমিদার ছিলেন ।গোবিন্দরাম ছিলেন তৎকালে ইংরেজের ডেপুটি কালেক্টর । থাকতেন গোবিন্দপুর গ্রামে । ব্লাকহোক নামক পুস্তকে তাঁকে কালা ডেপুটি বলা হয়েছে ।এই পরিবার বাবুয়ানির জন্য বিখ্যাত এবং পরে নিঃস্ব হয়ে যান ।এর পরের পুজোর যে তথ্য পাই তা হল রাজা নবকৃষ্ণদেব এর বাড়ির পুজো । নবকৃষ্ণের পুজোই কলকাতার প্রথম জাঁকালো পুজো । এ পুজোতে লর্ড ক্লাইভএসেছিলেন । বিখ্যাত সব নর্তকীরা আসতেন এই পুজোতে । এদেশীয় ভদ্রলোকেরা তখন সুরাপান সহযোগে বাইজীদের নাচ দেখতেন ।
কলকাতায় দুর্গা পুজো শুরু হয়েছিল মূলত পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উত্সব রূপে ।যা আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে ।
পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভে নবকৃষ্ণ দেবের কপাল খুলে যায় ।প্রচুর টাকার সাথে ‘মহারাজা বাহাদুর’ খেতাব পেলেন ।পুজো করলেন ১৭৫৭ সালে  নিজ ভবনে । লর্ড ক্লাইভ সে পুজোয় উপস্থিত থেকে একশো এক টাকা দক্ষিণা আর প্রচুর ফলমূল পাঠিয়ে ছিলেন ।
কলকাতার দুর্গা পুজোতে প্রথম বাঈ নাচিয়েছিলেন মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব ।তত্কালের সেরা বাঈজী নিকী পুজোতে নাচ করে গেছেন ।
পুরনো কলকাতায় যে সব জমিদার বাড়িতে দুর্গোৎসব হত ,সবেতেই বাঈজি নাচ থাকত ।
প্রথমে বাড়ি ,তারপর বারোয়ারি এবং তারপর এসেছে সর্বজনীন পুজো ।
কলকাতায় সর্বজনীন দুর্গা পুজোর পত্তন ১৯২৬ সালে । সিমলা আর বাগ বাজারে ঐ বছর সর্বজনীন দুর্গা পুজো হয় ।
প্রথম দিকে দুর্গা প্রতিমা ছিল একাচালার ।
পরে ১৯৩৯ সাল থেকে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ প্রত্যেকের জন্য আলাদা চালের ব্যবস্থা হয় ।
আশ্চর্য এই , সর্বজনীন পুজোর বাধা দিয়েছিলেন সেকালের অনেক পন্ডিত ।পরে পন্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটে যায় ।
তখন কলকাতা গড়ে উঠছিল মিশ্র সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে । বাবুদের হিঁদুয়ানির পাশাপাশি ইংরেজভক্তি , অন্যদিকে রামমোহনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আধিপত্য আবার শাক্ত- বৈষ্ণবের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব— পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার জোয়ার– সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার । তো দুর্গাপুজো কেবল ভক্তি- ভালোবাসার জন্য ছিল না , নিজের অর্থ ও কৌলিন্য প্রকাশের একটা মাধ্যম ছিল । বলা ভালো প্রতিযোগিতা বাবুদের , কে কত খরচ করল !
সেকালে বাবুদের বাড়িতে দুর্গাঠাকুর দেখার অধিকার সবার ছিল না । কেবল অতিথিদের প্রবেশাধিকার ছিল ।দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত চাবুক হাতে । গরিব- দুঃখি ঢুকতে গেলেইচাবুক চালাত । দুর্গাপুজো জাতীয় উৎসব হয়েছে , যখন এই পুজো সর্বজনীন হয়েছে , তার পর থেকেই ।
পাঁঠার মাংস ছিল পুজোর প্রধান আকর্ষণ । সাহেবদের জন্য প্রচুর গোমাংস আর বিলিতি মদের আয়োজন থাকত । ১৮৩১ সালের ‘ সমাচার দর্পন’ এ আছে ঢাকিদের মোষের মাংস দেওয়ার কথা ।
সেকালের দুর্গাপুজোতে কিছু কিছু পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল । যা আজো গল্পের ছলে মানুষের মুখে মুখে ফেরে । যেমন , কয়েকটি ধনী পরিবারে কলা বৌ স্নানের জন্য বিদেশ থেকে ছাতা আনা হত । ইংল্যান্ড বা তাইওয়ান থেকে ছাতা এনে সে ছাতায় সোনা- রুপোর তারের কাজের জন্য বেনারস থেকে কারিগর আনা হত । রানী রাসমণির বাড়ির পুজোতে ২ মন চালের নৈবেদ্য এবং ব্রাহ্মণ বিদায়ে একটি করে গিনি দেওয়ার প্রথা ছিল । গিরিশ ঘোষের বাড়িতে ৮ মন চালের নৈবেদ্য , একমন সের খাজা , এক মন গজা , এক মন বোঁদে , এক মন দরবেশ দেওয়া হত  । দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো জাঁকজমক পূর্ণ হয়ে ওঠে । ওই পুজোতে প্রতিমার অঙ্গে যত অলংকার দেওয়া হত সোনার , তা আর খোলা হত না । শোনা যায় , স্বর্ণালঙ্কার পরিহিতা দেবীপ্রতিমাকে কোনো অলংকার না খুলেই বিসর্জন দেওয়া হত । এমন আরো কত গল্প বাতাসে কান পাতলে আজো শোনা যায় ।
শোভাবাজার রাজবাড়ি আর চোরাবাগানের মল্লিক বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথা আজো প্রচলিত আছে । তৎকালে হাওড়ার ডাঁসাই গ্রামের শিকারী কাঙালীচরণ ওই দুই বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি যোগান দিত বলে জানা যায় । কলকাতার বাবুদের বিশ্বাস ছিল নীলকণ্ঠ পাখি শুভ বার্তা দেয় । তারা কৈলাসে গিয়ে খবর দেবে আগেভাগেই যে মা আসছেন ।
দুর্গাপুজোর সময় বিদ্যাসাগর মশাই কলকাতায় থাকতেন না এবং এ নিয়ে তেমন কৌতূহল বা আগ্রহ দেখাননি । তিনি নিজের গ্রামে দরিদ্র মানুষদের কাছে চলে যেতেন সে সময় । তাঁদের সঙ্গেই সময় কাটাতেন ।আর ব্রাহ্ম রামমোহন মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন বলে কখনো কোনো প্রতিমা দর্শন করেননি । এমন কী বন্ধু দ্বারকানাথ একবার নেমন্তন্ন করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন বলে শোনা যায় ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।