আর এখন? সমস্ত লড়াইয়ে হেরে ক্লান্ত হয়ে সবই ছেড়ে দিয়েছে। তার কর্ম তৎপরতা, সংসার সচেতনতা শ্বশুরবাড়ির সবার বিষ লাগত। ওর বিনিয়োগ করে উপার্জনের চেষ্টা জলে গেল। নেহাৎ অতীনের মতো সন্ন্যাসী চরিত্রের মানুষ তার জীবনসঙ্গী। না হলে অন্য যে কোনও পুরুষ হলে, কৈফিয়ত তলব আর গঞ্জনায় ক্ষতবিক্ষত করে দিত। চাকরি তো বরাবর ওকে নিয়ে টাল্কিভাল্কি খেলেছে। সাক্ষৎকার বোর্ডে ওর শিক্ষগত যোগ্যতার বাহুল্য নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে, কারণ রোজগারের ভাঁড়ার মা ভবাণীর দখলে। একটা অনন্য সম্ভাবনাময় মানব সম্পদ এই পোড়া দেশে অব্যবহৃত থেকে গেল। ম্যানেজমেন্টে নিজের শাখায় আমেরিকায় গবেষণা করতে যাবে বলে জিম্যাট টয়ফেল দিয়েছিল। ভালোভাবে উতরোলেও পুরো স্কলারশিপ পায়নি। তার ওপর মার্কিন মুলুকে স্পনসর, গ্যারেন্টার ইত্যাদির দায়িত্ব নিতে কোনও আত্মীয় রাজি হয়নি। কারও কাছে উপযুক্ত পরামর্শ বা সহযোগিতা পায়নি। নিজের চাকরি থেকে তখন তেমন কিছু জমেনি, বাবারও অত টাকার জোর নেই। বাড়িতে আর্থিক সহায়তার বদলে আবার টাকা চাইবে অনিশ্চিৎ স্বপ্নের পেছনে দৌড়তে? যোগ্যতা প্রমাণ করেও গবেষণার জন্য ওদেশে যাওয়া হল না।
এই জীবনে বাবা-মার মাথা উঁচু করতে পারেনি। বরের কাছে মুখ রইল না। শাশুড়িকে উচিৎ জবাব দেওয়া হল না। মায়ের পেটের বোনও মামুলি আর্টস্ গ্র্যাজুয়েট হয়ে ভালো চাকরি জুটিয়ে দিদিকে নানা উপদেশ দেয় আর দোষ ধরে। তাকেও জবাব দেওয়ার কিছু রইল না। ভাগ্য শুধু কুটিল হেসে মস্করা করে গেল। যখন যেটা পায়, সেটাকে আঁকড়ে ধরার সাময়িক মরিয়া প্রয়াস, আর শেষমেষ লাঞ্ছনা হতাশা – জীবন বলতে এটাই গত হয়ে গেছে। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর তার একমাত্র দপ্তর হবে, এটা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। সংসার করবে, এটুকুই যা মাথায় ছিল। যথোচিৎ পেশার অভাবে এই মধ্য ত্রিশেও ব্যক্তিত্বে বয়োসোচিত ভার এল না। বয়সে ও সম্মানে ছোটরাও উপদেশ দিতে ছাড়ে না। কিছু করার উদগ্র তাড়নাই তো এর কারণ। তাহলে সব দূর হয়ে যাক।
তাহলে আরামটাই করা যাক। বরের কষ্টার্জিত সীমিত অর্থ সদ্ব্যবহার করার বদলে জলাঞ্জলি দেওয়ার আফশোস থেকেও তো মুক্তি দরকার। মেয়েটাও এখন অত ছোট তো নেই, যে সর্বক্ষণ নজরে রাখতে হবে। ঘুমিয়ে পড়া মানে তো কঠিন বাস্তব থেকে সাময়িক পালাতে পারা।
শুধু রাতের ঘুম রীতিমতো সাধ্য সাধনার বস্তু। অতীনের বিকট নাক ডাকা ভালো ভাবে শুরু হওয়ার আগে যদি ওষুধের প্রভাবে বা অন্য কোনও ভাবে ঘুম এসে যায়, তো ভালো। না হলে সারা রাত জেগে কাটাতে হয়। আর জেগে থাকলে এক কাতে পড়ে থাকতে পারে না রুমা। ছট্ফট্ করে। বার বার বাথরুম যায়। গরম লাগলে গাও ধুয়ে আসে। কখনও লেখা নিয়ে বসে। সব সময় মন বসে না তাতে। তখন শুরু করে খাওয়া। পরীক্ষার আগে নিজেকে কফি খাইয়ে জাগিয়ে রাখা এক ব্যাপার, আর ঘুম আসছে না বলে খাওয়া অন্য রকম। খুব সকালে তখনই উঠতে পারে যদি সারা রাত জেগে থাকে। তারপর সকাল সকাল কাজ সেরে মেয়ে ও মেয়ের বাবা বেরোলেই কাগজ খুলে সুডোকু। তার পর একটু একটু করে অবচেতনা। তারপর ঘুম..। ক্লান্তিটাও তখন কাঙ্খিত মনে হয় –
এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে একশো বছর ধরে
চক্ষে আমার নিদ্রা তন্দ্রা আমার চেতনা জুড়ে
বড় বেশি চেয়েছিলাম জীবনের কাছে
যে আশা পূরণ হওয়ার নয় তাও লালন করি পাছে
বাঁচার অজুহাতটুকুও হারিয়ে ফেলি।
ক্লান্তি, আঃ! বড় সুখের অনুভূতি।
আমি তাই ক্লান্ত থাকতে ভালোবাসি –
অবষন্ন দেহে থাকে বিশ্রামের আকূতি;
দুঃখ গ্লানি যন্ত্রণা,দুর্বার অতৃপ্তির অসহ্য তাড়না
সবই চাপা পড়ে যায়
যখন দুচোখের পাতা এক হতে চায়।
ঝিম ধরা গ্রীষ্মের দুপুরের মতো
একখানা ঘুমের কাছে সবই পরাজিত
পৃথিবী রসাতলে যাক –
আমি ঘুমোই তো…