সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৬)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৬

আরও অদ্ভূদ অদ্ভূদ বায়না এবং বারণ ছিল বৃদ্ধার। জামশেদপুরে থাকা কালে রাতে বাচ্চার দায়িত্ব কাউকে দেওয়া যেত না বলে, প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটার আগে নিজের প্রাতকৃত্য সেরে আসত রুমা। সেটাও না মঞ্জুর। অত ভোরে মা জগদম্বা ছাড়া আর কারও উঠতে পারা চলবে না। বাচ্চাকে একা রেখে যাওয়াও নিরাপদ নয়, রাতে কাউকে ডাকলেও সাড়া পাওয়া যেত না। উল্টোদিকে বড় জার ঘর। কিন্তু রাতদুপুরে ভাসুরের ঘুম ভাঙিয়ে দরজায় টোকা দিতে অস্বস্তি লাগত, দিলেও সাড়া মিলত না। যাঁর মিলবে তিনি একরাত বাচ্চা নিয়েই সকালে সরবে ও সরোষে বিশ্রামভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলেন। কচি মেয়েটাকে বাধ্য হয়ে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে ঐ মাসখানেক পার করেছিল রুমা। ভয় হোত, মুখে কাঁথা কম্বল চাপা দিয়ে ফেলে না অঘটন ঘটে যায় আড়াই মাসের শিশুটির। কেউই রাতে জেগে পাহারা দিতে ইচ্ছুক ছিল না। আর মহামান্যা তো শোলের ঠাকুরসাবের মতো কাঁটাদার জুতো উদ্যতই রাখতেন। অথচ সকলেই রুমাকেই শাসন করত, ওভাবে বাচ্চাকে একা রেখে যাওয়া কতটা বিপজ্জনক। বিপজ্জনক তো বটেই। যা বড়ো বড়ো ইঁদুর ঘোরাফেরা করত ঘরটায়, তাতে মা পাশে ঘুমিয়ে থাকলেও বাচ্চাকে খুবলে যাওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব ছিল না।
অতীন অফিসে, গুবলু স্কুলে। স্কুল থেকে ফেরার সময় থাকা যাবে না বলে রুমা একটা অডিশনে যেতে পারল না। অস্থির লাগছে যদিও এরকম প্রায়ই হয়। ইদানিং মনের জ্বালা শুধু ব্যক্তিগত ডায়রির পাতায় জুড়োয় না, অন্যান্য লেখালিখিও শুরু করেছে। সচরাচর রাত জেগেই লেখে। সকালের দিকটা লেখার সময় পায় না, আর পেলেও অশান্ত লাগলে সাধারণত ঘুমিয়েই নেয় একটু, লেখা নিয়ে বসে না। আজ গুবুলর ছোটো আলমারিটা গোছাতে বসল।
ছোট্ট লাল চেলি, লাল ওড়না হাতে এল। পোষাকগুলো ঠিকমতো পরিয়ে সাজানোও যায়নি অন্নপাশনের দিন। আলমারিটা করিয়ে দিয়েছিলেন রুমার মা সেই উপলক্ষেই। এই অন্নপ্রাশন নিয়েও কি কম অশান্তি হয়েছে? জামশেদপুরেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটা তিন মাসের শিশুকে যারা আর এক মাসও টিঁকতে দেয়নি, তাদের সুবিধার জন্য বা খবরদারির সুযোগ করে দিতে ছ মাসের কচি বাচ্চা নিয়ে ফের পাণিহাটি থেকে জামশেদপুর ছোটা কিছুতেই মানতে পারেনি রুমা। ননদ-ননদাই যেহেতু আগরপাড়ার বাসীন্দা, তাই পাণিহাটিতে অনুষ্ঠান হলেই তাদের সুবিধা। তাই অতীনকে এখানেই অনুষ্ঠান করার পরামর্শও দিয়েছিল ওর জামাইবাবু। অথচ রুমার জেদে মা-দাদা-বৌদিদের মনে দুঃখ দিয়ে ‘বাড়ির কাজ’ বাইরে হচ্ছে বলে রুমাকে গঞ্জনা দিতেও কসুর করেনি। ভাগ্নীর আসতে দেরি হচ্ছিল বলে বাচ্চাটাকে স্নানও সময়মতো করাতে দিচ্ছিল না ওর দিদি। শেষে কোনও মতে স্নান হতেই অতীনের কী তাড়া, “ঝট্‌পট্ তৈরি করো, এত দেরি কেন? লোকজন আসতে শুরু করেছে –”। যেন রুমা জন্যই দেরি।
অন্তুর দাদার বিয়ের আট বছর পর ছেলে হয়। আর সম্ভাবনা নেই ধরে নিয়ে তাঁর পশুর ওপর অপত্যস্নেহ বর্ষণের ইচ্ছা জাগে। প্রথম সারমেয়টির আগমণ তখন থেকেই। এমন স্পর্শকাতর বিষয় যে, বড় বৌদি তো বটেই, বাড়ির সকলেই সেই পোষ্যের ওপর স্নেহ ভালোবাসা উজাড় করে দেয়। তারপর মেজভাইয়ের সন্তান এসেছে, নিজেরও হয়েছে, কিন্তু সারমেয়প্রীতি দূর হয়নি। বরং সদ্যজাত মনুষ্যশিশুজোড়া আর স্পিৎজ্‌স্ ভাইবোনের মতো একসাথে বেড়ে উঠেছে। বাড়ির বড় আদরের সদস্য ছিল সে। অন্তু তার জন্মদিনে গ্রীটিংস্‌ কার্ড পাঠাত – ‘চি চক্রবর্তী কেয়ার অব নীতিন চক্রবর্তী। ‘সি’ অর্থাৎ ছোটকু, সেই স্পিৎজ্‌সটার নাম।
রুমা যখন দেখেছে তখন সেই কুকুরটির শেষ বয়স, অসুস্থ। যেখানে সেখানে বমি করা, লোম ছড়ানো দেখে রুমার কষ্টের সাথে ঘেন্নাবোধই কাজ করত, ভালোবাসতে পারেনি। এমনিতেই কুকুর বেড়াল নিয়ে আদিখ্যাতা তার পোষায় না। ছোটকু মারা যাওয়ায় বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। দাদা-দিদভাইয়ের এখন তো পুত্র আছে, আর পোষ্যের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘর আলো করে আর একজোড়া ড্যাশনের আগমণ। তারা এখনও বয়সে তরুণ। আনন্দ, উত্তেজনা, ভয় সবরকম আবেগেই প্রবল বেগে ল্যাজ নাড়ে ও প্রবল রবে চ্যাঁচায়, নিজেদের মধ্যে হুটোপাটি করে, বাড়ির সদস্যদের সঙ্গেও খেলতে চায়। তাদের হাবভাব রুমার মজাদার লাগত ততদিন, যতদিন না তাদের চেঁচানি বাচ্চার ঘুম ভাঙার কারণ হোত, আর রুমাকে সদ্য বালিশে মাথা রেখেই আবার বাচ্চা কোলে নিয়ে শান্ত করার সব রকম প্রচেষ্টা চালাতে হোত। কোমরে পিঠে যন্ত্রণা নিয়ে ক্লান্ত শরীরে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটা খুব স্বাভাবিক।
 তার ওপর দুটোর গায়েই বিকট দুর্গন্ধ। সরস্বতীদেবী নিজের দুধের নাতনিকে কোলে নিয়ে কেবল, “টক গন্ধ, আঁশটে গন্ধ” পেতেন; কিন্তু বড় ছেলের কুকুরযুগলের গায়ে কোনও বদ-গন্ধ টের পেতেন না। এই অদ্ভূদ গন্ধ বিচারে পোষ্যের মালকিন বড় বৌও হাসত, “মা যে কী বলেন, রুমার বাচ্চাটা ঘরে এলে গোটা ঘরটাই মিষ্টি গন্ধে ভরে যায়। আপনি যে কী করে তার গায়ে আঁশটে গন্ধ পান বুঝি না”। জোজো হোজোর গায়ের গন্ধ, লোম সবই সরস্বতীদেবীর কাছে আদরের, কারণ তারা ‘বাড়ির ছেলে’। কিন্তু রুমার গর্ভজাত অন্তুর বাচ্চাটা বাড়ির মেয়ে নয়। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা রুমাকে পছন্দ করুক বা না করুক, এমন বিচিত্র বিচারকে কেউই সমর্থন জানাত না। সোনাই আর তাতাই তো বোনকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চা বলে দাবি করত। জামশেদপুরে কয়েক মাসের বাচ্চা নিয়ে থাকাকালীন জোজো-হোজোর গতানুগতিক চিৎকার প্রতিযোগিতার ব্যতিক্রমহীন এক রাত্রে রুমার অসহিষ্ণুতা প্রকাশের পরিপ্রক্ষিতে গৃহকর্ত্রী বলে দিলেন, “তাহলে তোমাকে আর থেকে কাজ নেই, অন্তু আসুক, চলে যেও। আর কোনওদিন আসতে হবে না।”

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।