সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ২)

ইচ্ছামণি

পর্ব ২

বাচ্চার কান্নার শব্দ অনুসরণ করে পৌঁছে গেল এক ছাইগাদায়। দেখে মাস তিনকের একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। চারপাশে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটো বেঁটে পায়ের লম্বাটে দেহের কুকুর তারস্বরে চিৎকার করছে। ছোটবেলায় দেখা বাগানের ছাইগাদা ক্রমশ কলকাতার আস্তাকুঁড়ের মতো আবর্জনা ও দুর্গন্ধে ভরে উঠল। বাচ্চাটা তারই মধ্যে শুয়ে শুয়ে হাত পা ছঁড়ে খেলছে। রুমাকে দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল সে। গুবলু! তাকে কোলে তুলে নেওয়ার আগেই তন্দ্রা ভেঙে হয়ে গেল। বাইরের দরজায় ঘণ্টা বাজছে।
চটকা ভেঙে উঠে দেখে আড়াইটে বেজে গেছে। মানে গুবলুকে স্কুলের গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। সর্বনাশ! কিছু হয়নি তো এর মধ্যে? যা স্বপ্ন দেখল সেটা কোনও বিপদের ইঙ্গিত নয় তো? হে ঈশ্বর! পোশাক বদলানোর সময় নেই। নাইটির ওপর একটা হাউসকোট চড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল। গলির মোড়ে পৌঁছানোর আগেই দেখে গাড়ির হেল্পার তার হাত ধরে নিয়ে আসছে। স্বপ্নের ধাক্কায় বুকের ভেতরটা মেয়েকে নিরাপদ দেখার পরেও ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করছে।
গুবলুকে নাইয়ে খাইয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে নিজে আর ঘুমোতে পারল না। বছর পাঁচেক আগের কথা মনে পড়ল। তখন সদ্য গুবলু জন্মেছে। অসুস্থতার জন্য রুমার মা-বাবা আসতে পারেননি। দেখাশুনোর জন্য শাশুড়ি আর ননদ এসে ছিলেন মাস দুয়েক। নমো নমো করে ষষ্ঠীপুজো হওয়ার পর ননদ নিজের সংসারে ফিরে গেলেও শাশুড়ি ছিলেন আরও কয়েক মাস।
“বাথরুমে যাচ্ছি মা। একটু নজর রাখবেন নাতনির ওপর?”
“যাও না। আমি থাকতে কোনও ভাবনা নেই। পায়খানা গেলে বুক বেঁধে রেখো। বাচ্চা দুধ খায়, গ্যাস লাগিও না।”
“নিশ্চই। ঐ কাপড়টা বারান্দায় শুকোচ্ছে, নিয়ে ঢুকছি।”
স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে খাটে শুয়ে থাকা কন্যার জামা, কোপনি বদল হয়ে গেছে।
“হিসি করেছিল বুঝি?”
“দুধ তুলেছিল। আমি ওর কোপনি দিয়ে মুখ পুঁছে দিয়েছি। তারপর আর কিছু না পেয়ে ঐ ন্যাকড়াটা দিয়ে মুখ পুঁছেছি।” ভদ্রমহিলা বাচ্চার হাগু পরিস্কার করার কাপড়ের টুকরোটা দেখালেন। খুব ভালো করেই জানেন ঐ ন্যাকড়ার ভূমিকা। এমনি ধুয়ে মেলা থাকে বেশিরভাগ, ডেটলে চোবানো বা এমনকি সব সময় সাবানেও কাচা হয় না।
রুমা বাথরুম যাওয়ার আগে শ্বাশুড়ির হাতে মুখ মোছা পরিস্কার রুমালটা দিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু ছোটো বৌ যা ব্যবস্থা করে ভুল করে, যা ভাবে ঠিক নয় – এটা প্রমাণ করার চেয়ে কি শিশুর স্বাস্থ্য বেশি জরুরি হতে পারে? উপরন্তু আজ কাপড় কাচা ও রান্নার মেয়েটা ভুল করে ওদের স্নানের বালতিতে বাচ্চার কাঁথাকানি কেচেছে দেখে ভয়ানক রেগে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছিলেন সরস্বতীদেবী।
রুমা বলেছিল, “ওর বাথটাবে করে যখন ধোয়া যাচ্ছে, তাহলে আমাদের বড়দের বালতি নিয়ে অত না ভাবলেও চলবে।”
শাশুড়ির বক্তব্য, “ওর ময়লা ওর গামলায় কাচা হচ্ছে। ওতে কীসের দোষ?”
“তাহলে বড়দের বালতিতে কাচলেও সেটাই বা অশুদ্ধ হবে কেন? ও বাচ্চা হয়েও যখন ওর বাথটাব এই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন বড়দেরও নিশ্চই অসুখ করবে না। ঠিক আছে, আমি আলাদা গামলায় ওর হিসি হাগুর কাঁথা রাখার ব্যবস্থা করছি। কারও স্নানের বালতি, মগ, গামলা ইউজ় করতে হবে না।”
এই ব্যবস্থাও ঠাকুমার মনঃপূত হল না। উনি যখন আলাদা গামলার কথা বলেননি, সুতরাং আর কারও মাথায় আসা চলবে না, অন্তত সদ্য সন্তান প্রসবিনী ছোটো বৌ রুমার তো কখনই নয়। তাই একটা এক মাসের শিশুর ওপর এই প্রতিশোধ।
বাচ্চাটার পরণে কোপনির বদলে একটা মস্ত ঢোলা সব ‘বেরিয়ে যাচ্ছে’ গোছের জাঙিয়া, আর গায়ে হাকল্‌বেরি ফিন লজ্জা পাবে এমন একখানা জামা। দুটোই রুমার মেজ ভাসুরের মেয়ের ফেলে দেওয়া মাল। ওগুলো তখন মাপেও হতো না, আর অন্যের প্যান্টু পরানোটা রুমার মনোমতোও ছিল না।
সরস্বতীদেবী ‘কেমন জব্দ? আর মাতব্বরি করবে?’ জাতীয় মুখভঙ্গি নিয়ে নাতনির সঙ্গে আদিখ্যেতা করে যাচ্ছেন। ‘ভদ্রলোকের বাড়ি, গায়ে হাত তো তুলে পারি না। কিন্তু তোমার সংসারে তুমি ফালতু আমিই দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী, তুমি আস্তাকুঁড় আমি ঠাকুরঘর, তোমার গর্ভে জন্মেছে বলে একটি অপাপবিদ্ধ শিশুও অপবিত্র – এটুকু জাহির করতে না পরলে সুদূর জামশেদপুর থেকে দৌড়ে এসে তোমার সংসার দেখছি কীসের জন্য?’ মনে মনে বোধহয় হাসলেন সরস্বতীদেবী।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।