সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১৯)

ইচ্ছামণি

পর্ব ১৯

পথে দাঁড়ানোর কী আছে? এখনও তো অতীনের চাকরি আছে না কী? কিছু একটা হয়ে যাবে নিশ্চই। অত ভাবতে অতীনের ভালো লাগে না। একে তো বদলিকে যেখানে সরকারি পয়সায় বেড়াতে যাওয়া মনে হোত, সেটা এখনকার বৌ-বাচ্চা লটর-পটর সংসারী গতানুগতিকতায় ফাঁড়া মনে হচ্ছে, যা এসপার-ওসপারও হচ্ছে না কাটছেও না। ভালো হয়েছে রুমার শেয়ারে টাকা ফেঁসে বসে আছে। অতীনের তাই বলার একটা জায়গা থাকছে। সেই টাকার জোর থাকলে রুমা নির্ঘাৎ ফ্ল্যাটের পেছনে দৌড়াতে আরো তাড়া দিত। বদলি হয়ে গেলে ফ্ল্যাট না কেনার একটা জবরদস্ত অজুহাত পাবে, খরচের বোঝা সামলাবে কী করে? রুমার অবশ্য কলকাতা ছেড়ে নড়ার ইচ্ছা নেই। চাকরি-চাকরি করে তো মাথা খারাপ করে ফেলল, পেল কোথায় পছন্দ্সই? দু-দুবার সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েও কিছু হল না। অতীনের কম পয়সা নষ্ট হয়েছে তাতে? রুমাই টাকা টাকা করে, আফসোস করে, অতীন কোনোদিন কিছু বলেছে সেজন্য? পাগলি নিজেই হাহুতাশ করে সকলকে বিরক্ত করে। এখন তো কাজ পেলেও মেয়েকে কার ভরসায় রেখে যাবে স্থির না করতে পেরে যা পাচ্ছে ছেড়েই দিতে হচ্ছে। তবু ওর ভেতরের অকারণ দৌড়টা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বাচ্চা হওয়ার সময় মা আর দিদির পরামর্শে যে মেয়েটিকে রেখেছিল অতীন, সে তো রইল না। সে যেমন কামাই করত, তেমনি দেরি। কিন্তু মায়ের খুব বাধ্য ছিল। মা যে কমাস অতীনের কাছে ছিল, সেই কমাস বাড়িতে রোজ চোদ্দ পদের ভুরিভোজ হোত। অতীনের তখন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তুলে চলছে। তবু মায়ের কোনও অযত্ন হতে দেয়নি। যদিও সবটাই হোত সদ্য প্রসবিনী পুত্রবধূকে যত্ন করার নাম করে।
তাছাড়া গুরুজন অভিভাবিকা ও সবচেয়ে সম্মানীয় হিসাবে মা নিজের মর্জি অনতুর সংসারটা চালাতে চাইত। রুমার এটাও সহ্য হোত না। তার বক্তব্য সংসারটা নাকি তার। তার সামর্থ ও রুচি মাথায় রাখতে হবে। এই নিয়েও কম অশান্তি হয়নি। রুমা সিজারিয়ান অপারেশনের পরও কেতরিয়ে পড়ে না থেকে যে শক্তসমর্থ থেকে কাজকর্ম সামলাতে পারত বলে মার ভালো লাগত না। স্বাভাবিক। মা চাইত তার ওপর নির্ভরতা। বাচ্চাটা তার মায়ের বুকের দুধ কখন কতটা খাবে সেটাও তার ঠাকুমা ঠিক করে দেবে। না হয় বুড়ো বয়সে এটুকু শখ হয়েইছিল। টাকা পয়সা সব অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে ফুরিয়ে ফেলে বেচারা নিজের নাতনির জন্য কিছুই করতে পারছিল না, ওটুকু খবরদারিই যা সম্বল ছিল। রুমা সেটাও চাইত না।
কী মানসিকতা! দুধেল গোরুর চাট সহ্য করা যায়, অন্যকে দুধ দেবেন আর চাট মারার বেলা ছোটো বৌকে মনে পড়বে এমনটা বরদাস্ত করা যায় না। ছিঃ! রুমাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে মা কয়েকবার নাকি নাত্নির মুখ তার হাগু পরিস্কার করা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিয়েছিল। সেটা শুনে অতীনেরও ভালো লাগেনি। কিন্তু মা যে। বরং রুমার সব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা আর অতীনের কানে ফেলাটাই ওর অসহ্য লাগত। মা তো ভালোবেসে নাতনি আর বৌকে নিয়ে গেল জামশেদপুরে। সেখানে তো অতীন পৌঁছে দেবার পর মায়ের হাতে মাত্র হাজার দুয়েক টাকা গুঁজে দিয়ে চলে এসেছিল। কথা ছিল মুখে ভাতের পর সব ফিরে আসবে। কৈ, তখন তো খরচ বাঁচানোর কথা ভেবেও শাশুড়ির খবরদারি – রুমার ভাষায় অত্যাচার, সহ্য করতে পারল না। পনেরো দিনের মাথায় অতীনকে গিয়ে নিয়ে আসতে হল।
ওখানে অনুষ্ঠান করলে অতীনকে শুধু টাকা ঢালতে হোত, ব্যবস্থাপনা নেমন্তন্ন সব দাদারাই সামলে নিত। কথা দিয়েও অন্নপ্রাশনটা জামশেদপুর থেকে দেওয়া গেল না। সে তো রুমারই জেদে। কী? না, “মা বলেছেন, আর আসতে হবে না”। মায়ের মুখের কথা কেউ ধরে। শেষ বয়সে নাতনির মুখে ভাতে একটু আনন্দ করার জো থাকল না। আসলে রুমার অসুস্থ মা-বাবাকে জামশেদপুর বাড়ির কেউ কুটুম বলে পাত্তা দেয় না বলে তাঁরা সেখানে যেতে ইতস্তত করেন। সেটাও হয়তো রুমার বেঁকে বসার আর একটা কারণ। অবশ্য তাতে দিদির শ্বশুরবাড়ির সবাইকে, তার মেয়ে-জামাইকে দুদিন ধরে ভালো করে খাওয়ানো গেছে। তাছাড়া অফিসের সহকর্মীদের অনুষ্ঠানে কব্জি ডুবিয়ে যদি নিজের প্রথম শুভ কাজটা অন্যত্র করত, মোটেই ভালো দেখাত না। জামশেদপুরে অন্নপ্রাশন করলেও সোদপুরে আবার একটা খাওয়ানো দাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হোত। সমীরদা তখন সোদপুরে অনুষ্ঠান করতে উৎসাহ আর সহযোগিতা দুটোই যুগিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে কাজ না করার জন্য ছোট সম্বন্ধীকে যে এখনও খোঁটা দেয়, সেটা তো এড়ানো যেত। এখানে আবার লোক খাওয়ানো হলে না হয় দিদিদের জ্ঞাতিগুষ্টিকে আবার ডাকা যেত।
আজ ছ বছর ধরে বৌয়ের সঙ্গে বাড়ির ও দিদিদের চাপা বিরোধ, বদলির অনিশ্চয়তা আর রুমার চাকরি-চাকরি করে হাহুতাশ – সব মিলিয়ে অতীনের জীবনটা তেতো হয়ে গেছে। তার সব ছেড়েছুড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিংবা ইচ্ছা করে মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের পাতে মাখা প্রসাদি ভাত হাত পেতে খেতে। ধুর শালা! বৌ না হলে জানতেই হোত না, মায়ের চোখে নান্তু সন্তু অন্তু মানে নিতিন ব্রতীন আর অতীন – কে কতটা আলাদা। রুমার ভাষায় “দাদাকে ভয়ে খাতির করেন, ছোড়দাকে সত্যি ভালোবাসেন তার সুবিধা-স্বার্থ দেখেন, আর অন্তুকে শধু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ব্যবহার করেন। আর এসব দিদি বুঝেও মায়ের সঙ্গে তাল দেয়”। জানতে হোত না, দাদাদের সন্তান দিদির দুই সন্তানের পর আর অন্তুর সন্তান মায়ের কাছে একইরকম স্বাগত ছিল না।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।