সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১৭)

ইচ্ছামণি

পর্ব ১৭

“অফিসে আমাকে ঘাড় গুঁজে সারাক্ষণ কাজ করতে হয়। তোমার মতো দুপুরে দিবানিদ্রা দিতে পারি না।”
অতীনের মাথার ওপর প্রমোশনের পাওনা আর বদলির খাঁড়া দুটোই একসাথে ঝুলছে। মেয়ের স্কুল, নাচের ক্লাস ইত্যাদির কথা ভেবে, রুমার কেরিয়ার তৈরির অলীক স্বপ্নকে এখনও প্রশ্রয় দিয়ে, আর বছর দশেক সোদপুরে থেকে এখানকার বাজার-দোকান ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় কলকাতার বাইরে কোথাও বদলি হোক চায় না ঠিকই, তবে মনে হয় অনেকদিন এক জায়গায় বসে থেকে আর পাঁচটা ভেতো বাঙালির মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই বাঁধনছাড়া বোহেমিয়ান ব্যাপারটা তো কবেই হারিয়েছে। তখন অতীন সবার জন্য। অতীনের জন্য কে ভাবার দরকার ছিল না। মা তো বটেই, দাদা-বৌদি, দিদি-জামাইবাবু, ভাইপো-ভাইজি-ভাগ্নী-ভাগ্নে সকলের জন্য অন্তু অর্থাৎ অতীন। যেখানে কেউ রাজি নয়, অন্তু হাজির। কারো কাছে কোনও প্রত্যাশা নেই, পাওনা-গণ্ডার হিসাব বোঝা নেই, শুধু নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নেশা, অন্যের উপকার করে তৃপ্তি, সকলের কাছে ভালো হয়ে থাকার অভিলাশ। বিয়ের পর বুঝল দাদাদের মতো তারও আলাদা পরিবৃত্ত তৈরি করতে হবে। তার স্বার্থ আর তার বৌয়ের স্বার্থ এক, সে ও মা এক নয়। মায়ের দায়িত্ব তার একার নেওয়া চলবে না। আর-আর সন্তানদের সঙ্গে তার কর্তব্য ও অধিকারের সমান ভাগ-বাঁটোয়ারা হওয়া উচিৎ। এমনটা সে মনে না করলেও রুমা মনে করিয়ে দেয়। তার ওপর যখন তখন শুরু হয়ে যায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য বায়না। কলকাতায় অনেকদিন হয়ে গেছে। যেকোনও দিন বদলির শমন আসতে পারে। তখন ফ্ল্যাটের ঋণ শোধ করবে কী ভাবে, সেটা ভাবার প্রয়োজন কি রুমা বোধ করে? শুধু শ্বশুরবাড়ি থেকে পাকাপাকি আলাদা আস্তানার তাগিদে ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট!
“একটা দুরন্ত বাচ্চার পেছনে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি রান্নাবান্না সব তো পাড়ার লোকেরা করে, আর আমি শুধু ঘুমোই, তাই না?”
“আমি কলকাতায় আর কদিন আছি সেটাই ঠিক নেই। যে কোনও দিন ট্রান্সফার অর্ডার আসবে। অন্য বি গ্রেড সিটি হলে হাউস রেন্ট থার্টি পার্সেন্টের জায়গায় টেন পার্সেন্ট হয়ে যাবে। ফ্ল্যাটের লোন শুধব কী করে? আমার কি শ্বশুরের জমিদারি আছে?”
“তোমার শ্বশুরের জমিদারি যেমন নেই, অন্যায় বৈষম্যও নেই। কিন্তু আমার শ্বশুরের যা আছে তাতে আমার শ্বাশুড়ির অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে তোমার আমার কোনও রাইট থাকছে না।”
“মুখ সামলে কথা বল। কাদের সম্পর্কে বলছ ভুলে যেও না।”
“আর আমার বাবা তুলে কথা বললে কোনও দোষ হয় না তাই না? তুমি তো তোমার শ্বশুরের জমিদারি নেই বলে খোঁচা দিলে। যার জমিতে তোমার ন্যায়সঙ্গত অধিকার তাঁর কথা তাই ন্যাচরালি এসে পড়ল।”
দায়িত্ব আর ঝামেলা নিতে অতীনের কোনও অসুবিধা নেই। যত মুশকিল ঐ অধিকারের প্রশ্নে। ওর ছোড়দা একসময় সংসারের জন্য সাধ্যমতো করেছে। তখন বড় দাদা হাত গুটিয়ে ছিল। যতদিন সে এলআইসি-র কেরিয়ার এজেন্ট ছিল বাড়িতে হম্বিতম্বি ছাড়া এক পয়সাও দিতে চাইত না। ছোড়দা না থাকলে ওর পড়াশুনোই ঠিকমতো হোত কিনা সন্দেহ। তাই ছোড়দা ব্রতীন বা সন্তুর প্রতি মা, দিদি এবং অন্তু তিনজনেরই আলাদা একটা দুর্বলতা আছে। তার অবস্থা খুব স্থিতিশীল নয়। ছোড়দার কথা তাই ভাবতেই হয়। কিন্তু অতীন জানে মা সব চেয়ে বেশি নির্ভর করে তার ওপর। সে টাকাপয়সার ব্যাপার হোক, কোথাও নিয়ে যাবার বায়না হোক, মায়ের নাম করে কাউকে কিছু দেওয়ার দরকার হোক, কলকাতায় এসে ডাক্তার-রিপোর্ট এসব প্রয়োজনে হোক – অন্তুই মায়ের প্রধান অবলম্বন। দাদা কী পাচ্ছে, ছোড়দাকে কী কী দেওয়া হচ্ছে, দিদি কত পেল – এসব হিসাব নিকাশ অন্তুর পোষায় না। না হয় বাড়ি করতে সে নিজের যথাসর্বস্ব দিয়েইছিল, তাই বলে অশান্তি করে বাড়ির ভাগ নিতে হবে,না হলে নিজের জন্য নিজের স্ত্রী-সন্তানের জন্য আলাদা করে ভাবতে হবে, এমন নীচতা সে মনে প্রশ্রয় দিতে পারে না।
“তোমার বাজে কথা থামাবে না আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব?”
“বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সত্যিটাকে মিথ্যে করবে?  তোমার বাবার নাম নিলে তুমি কীভাবে রিআ্যঅ্যাক্ট করতে নিজে ভেবে দেখো। আর তোমার শ্বশুরের জমিদারি না থাকলেও যা ব্যাঙের আধুলি আছে, তাতে আমাদের দুই বোনের সমান অধিকার, তোমার মায়ের মতো কাউকে ফাঁকি দেওয়ার অভিসন্ধিও নেই। তুমি ফ্ল্যাট কিনতে রাজি হলেই বাবা যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার বদলে যদি নিজের মানুষের কাছে বিনা ইন্টারেস্টে খানিকটা ধার পাও, তাতে অসুবিধা কোথায়? বাবার কাছে যা নেবে তা খেপে খেপে শোধ করে দিও। যেখানে শুধু দায়িত্ব, প্রাপ্তি বলতে কিছু নেই, সেখানে তোমার যত আনুগত্য। আর যেখানে যেচে পাশে দাঁড়াতে চাইছে, সেই জায়গাটা বিষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার পৈতৃক সম্পত্তির তোমার ওপর অধিকার না থাকতে পারে, আমাকে আমার বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাইছ কেন? বাবা-মা গত হলে তো তাদের যা কিছু হরির লুট দেব না, দু’ বোনেই ভাগ করে নেব। কিন্তু তাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষার বদলে তারা বেঁচে থাকতে থাকতে আমার একটা আস্তানা হয়েছে দেখে গেলে ভালো হয় না?”

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।