সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১১)

ইচ্ছামণি

পর্ব ১১

তার সাথে নিত্যদিন যোগ হয়ে চলেছে একটার পর একটা হাড় হিম করা আর গা পাক দেওয়া খবর, কাগজে, বোকাবাক্সে, লোকমুখে। কথায় আছে ‘যা রটে তা কিছু তো বটে’। কিন্তু বাস্তব হল, যা ঘটে তার কতটুকু গণমাধ্যমের দ্বারা প্রকাশ্যে আসে? তারও অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ রুমা পড়ে। যে কাগজের কথা অতীন বলছে, তাতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আর এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সহাস্য দেখে আর তার প্রতিবেদন পড়ে জেনারেল নলেজ বাড়তে পারে, কিন্তু সে খবরের সাথে দেশের বিশাল জনসাধরণের যোগ কতটুকু? তাদের তো প্রতি নিয়ত, ঐ বীভৎসতাগুলো এড়িয়ে বা সঙ্গে নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়, অথবা হারিয়ে যেতে হয়। রুমাও যে মেয়ের মা। চিন্তিত হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? রুমার তো মনে হয়, এইসব খবরে যারা বিচলিত হয়না, তারাই মানসিকভাবে অসুস্থ এবং প্রচন্ড স্বার্থপর। নিজেদের গায়ে আঁচ না লাগলেই হল।
ওহ্! আর কতরকম ভয়ের সাথে সহবাস করে বাঁচতে হবে? এই কদর্য পৃথিবী থেকে মেয়েটাকে যন্ত্রণাবিহীন পরিত্রাণ দিয়ে নিজেও চলে গেলে পারে তো। কিন্তু মেয়েটা তো তার বাবারও। এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীল বাবার। এমন সিদ্ধান্ত রুমা একা নিতে পারে না। আর রুমার মা-বাবা কম কষ্ট পাবে? অতীন তো বিয়ে করতেই আগ্রহী ছিল না। সে কী অপরাধ করেছে যে এভাবে তাকে আঘাত করে চলে যেতে হবে? কিন্তু যারা হাজারো আপোশ করে হ্যাংলার মতো বাঁচতে চায়, তারা থাক বেঁচে। রুমার যখন রুচি নেই, তখন কেন পালাতে পারবে না?
রুমার কাছে সব চেয়ে কঠিন কাজ হল মেয়েকে পড়ানো। কিন্তু সেটা রান্নার মতোই অপরিহার্য। আর একটা অপছন্দের কাজ ঘর গোছানো তো অপরিহার্যও মনে হয় না। মাসে-দুমাসে বাড়ির এক একটা অংশ ঝাড়-পোঁছ, সাজানো-গোছানোর জন্য ধরে। তারপর ধূলো লেগে হেঁচে হেঁচে ওষুধ খেয়ে অমৃতাঞ্জনের বোতল খুলে শুঁকতে শুঁকতে শুয়ে পড়ে নিজের কুঁড়েমির যথার্থতা প্রমাণ করে। ভাড়া বাড়িতে রোজ রোজ ধূলো ঝাড়া, গোছগাছের মতো একঘেয়ে কাজ করে ঘুমোনোর সময় বরবাদ করাটা তার মোটেও পছন্দ নয়। অথচ অগোছালো সংসারে অর্ধেক জিনিস সময়মতো না খুঁজে না পেয়ে নিজেরই বিরক্তি লাগে। ঠিকের ঝিকে বাড়তি টাকার টোপ দিয়েও ওসব করানো যায় না। মাঝেমধ্যে রান্নার মহিলা জোটে। তাদের ওপর সব্জি ধোওয়া ও পরিচ্ছন্নতার তদারকি করতে গেলেই দেখেছে বিপদ। রান্নার কাজ না থাকলে ঘর গোছানোয় হাত লাগাতে বললেও বিরক্তি। এগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে যদিও বা কিছুদিন চলে, ঠিকের মহিলাটি বাসন মাজা রান্নাঘর পরিষ্কার এসব নিয়ে এমন রেশারেশি শুরু করে, যে কেউ বেশিদিন টেঁকে না।
কাউকে কোনো কাজ বিশেষ করে গোছগাছের কাজ করতে দেখলে রুমার ঢুলুনি চলে আসে। চোখে মদির আলস্য নিয়ে অন্যের কর্মব্যস্ততা দেখায় যেন একটা নেশা আছে। তবে ধোঁয়া ঝাঁজ গরমে রান্নার কাজ দেখায় সুখ নেই। বরং ধোয়াধুয়ি, ছোঁয়ানাড়া নিজের মনঃপূত হয় না বলে রান্নার মানুষকে নির্দেশ দিয়ে বা যোগাড় দিয়ে সরে আসাই আরামের। তার পেছনে টিকির-টিকির করা যেমন বিপজ্জনক, নিজের পরিচ্ছন্নতাবিধি ঠিকমতো পালিত না হতে দেখাটাও ততোধিক অস্বস্তিকর। কিন্তু সেই মেয়ে কালেভদ্রে যখন ঝাড়ন ঘষে ঘষে রান্নাঘরের তাক, ফ্রীজের মাথা বা মিটসেফ পরিস্কার করে গোছায়, তখন আবেশে ঝিমুনি চলে আসত।
এই ঘুমই হল রুমার পরম বন্ধু, চরম শান্তি। কিছুক্ষণের জন্য বাস্তব থেকে পালিয়ে যাবার সহজ রাস্তা। নেশা-টেশা তো করে না। কিন্তু মানুষ কেন নেশার দাস হয় বোঝতে পারে। সফল মনুষের হুল্লোড়ে নেশায় পিত্তি জ্বলে। কিন্তু ব্যর্থ মানুষ কেন নেশায় ঝিম মেরে বাস্তববিমুখ হয়ে পড়ে থাকে, তা সে অন্তরের জ্বালা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে।
পদার্থবিদ্যায় এমেসসি, এমবিএ, ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একবার নেট পাস করে চাকরি বা গবেষণা কোনওটাই না হওয়া, বিয়ের সাত বছর পর আবার কেঁচে গন্ডুষ করে পড়শুনো করে ডব্লিউবিসিএস মূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ও সদ্যজাত কন্যাসহ সাক্ষাতকার দিয়েও শেষরক্ষা না হওয়া, ছোটোখাটো খেলো চাকরিতে মানিয়ে নিতে না পারা, বহু চাকরি পেয়েও হারানো………..পরিণাম ঘুম,ঘুম,ঘুম..! কর্মব্যস্ততা যখন কপালে নেই, তখন বিশ্রামই করা যাক।
রুমার উপার্জন নেই। বরটাও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এবং নিজের স্বার্থ চিন্তায় ভীষণ অরাজি। হয়তো সেই কারণেই লোভও নেই। শ্বশুরবাড়িতে থেকে পাওনা-গণ্ডা আদায় তো ভাবতেই পারে না। কিন্তু ইচ্ছা করলেই ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে একটা মাথা গোঁজার মতো ছোট ফ্ল্যাট কিনতে পারত। কেনেনি। রুমার সহস্রধারা অশ্রু কাজে লাগেনি। বরং গোছা গোছা টাকা নিজের মা দাদাদের সম্পন্ন সংসারের একান্নবর্তিতা ও শান্তিরক্ষায় ব্যয় করেছে এবং এখনও কম করে হলেও করে চলেছে। করছে সেই বাড়ির জন্য, যেখানে তাদের নিজস্ব একটা ঘর পর্যন্ত নেই। মেয়ে হবার পর ভাইপো ভাইঝিদের জন্য সুরক্ষিত বন্দোবস্ত দেখে কি নিজের ভুল বঝতে পারেনি? কিন্তু স্বীকার করবে না, টাকার প্রবাহ বন্ধও করবে না। বরং রুমাকে বলে, “আরও দেখে শুনে বিয়ে করলে পারতে ?”
বর, মেয়ে, সংসার কোনোটাই বদলযোগ্য নয়। বদলে যাচ্ছে রুমার মানসিক স্বাস্থ্য, মেজাজ। কখনও অতি উচ্ছ্বল, কখনও প্রচণ্ড বিমর্ষ, কখনও বাচাল, কখনও থম-মারা—আর অধিকাংশ সময়েই বিরক্ত ভাব। তার সাথে সর্বাঙ্গে ব্যথা। অতীনও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে সঙ্গদোষে। শ্বশুরশ্বাশুড়ির পরামর্শে একবার বৌকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ডাক্তার ওষুধের বদলে যোগ বা যেকোনও শরীরি কসরতের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। অতীনও কতবার বলেছে যোগব্যায়াম করতে। শুনলে তো। সামান্য যোগ, ধ্যান, প্রাণায়াম করলেই যেটা সেরে যায়, তার জন্য বারবার ডাক্তারের কাছে ছোটা, আর কাঁড়িকাঁড়ি ওষুধ খেয়ে রুমার বেআক্কেলের মতো ঘুমনো—এগুলোর কোনও মানে হয়? কার না রাগ হয়? অফিস থেকে ফিরে যদি অগোছালো সংসারের সর্বত্র দায়সারা গৃহিনীপনা দেখে, তাহলে কোন পুরুষমানুষের মেজাজ ঠিক থাকে? খরচ করতে তো অতীন পিছপা নয়। দুটো কাজের লোক রাখতে রাজি স্ত্রীর স্বাছ্যন্দের খাতিরে। তাদেরও যদি ঠিকমতো সামলাতে না পারে।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।