প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

জেনেটিক্স ও মহা প্রাচীন ভারত

( যে লোক জেনেটিক্স আর ইতিহাস কিছুই জানে না, এটা তেমন লোকের কল্পনা বিলাস। রামগরুড়ের ছানাদের অপাঠ্য )

প্রাচীন ভারত যে বিজ্ঞানের বহু শাখায় আধুনিক ভারতকে টেক্কা দিত তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। কুন্তী ছিলেন অসামান্য সেক্সি মহিলা। অবিবাহিতা অবস্থাতেই তিনি সূর্যের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সেই সুযোগে গর্ভবতী হন। কুন্তীর আর একটি নাম পৃথা। তিনি পৃথু রাজার কন্যা ছিলেন। পৃথার ছেলে বলেই অর্জুনের আর একটি নাম পার্থ। পৃথিবী থেকে সূর্যের বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করার কায়দা পৃথা কুন্তীর জানা ছিল। দেড়শ কোটি কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে আলোর লাগে সাড়ে আট মিনিট। পৃথা কুন্তীর তাও লাগত না। হুট বলতেই সূর্যের কোলে পৃথা। যাই হোক কুন্তীর বিয়ে হল পাণ্ডুর সাথে। সাথে সতীন কাঁটা মাদ্রী। পাণ্ডুর আবার সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাই নেই। তো শুধু পাণ্ডু কেন, ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই ধৃতরাষ্ট্রের ও ওই ক্ষমতাটি ছিল না। এদিকে টুকটুকে বৌ আনা চাই। বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর। কুন্তীর উপর বর ছিল যে যে কোনো পুরুষ কুন্তী ডাকলেই সঙ্গমের জন্য হাজির হবেন। তো কুন্তী তাঁর বৈধ স্বামীর পুত্রোৎপাদন ক্ষমতাহীনতার সুযোগে খুশিমতো দেবতাদের সাথে যৌন সঙ্গমের ব্যবস্থা করে নিলেন। তিন তিন খানা অভিজাত দেবতা ধর্ম, বায়ু আর ইন্দ্র, পৃথা কুন্তীর ডাকে হাজির। তিন তিনটা পুত্র সন্তান হল পৃথা কুন্তীর। সতীন মাদ্রী পৃথার সৌভাগ্য দেখে বায়না করে, ও দিদি আমাকেও একটা সুপুরুষ দেবতা ম্যানেজ করে দাও। কুন্তী তো মাদ্রী কে অতো সুযোগ দেবেন না। শেষ কালে সব দিক ভেবে বললেন … আচ্ছা, নে, একটি মাত্র চান্স পাবি। আমার মতো যত খুশি সুযোগ তোর হবে না।… মাদ্রী ওপরে ওপরে কুন্তীকে চটালো না। বলল হ্যাঁ দিদি, তোমার মতো তিন চারটে মদ্দা দরকার নেই, আমার একটা হলেই হল। কুন্তী তখন সেই দেবতা পটানো পাশ ওয়ার্ড মাদ্রী কে দিলেন। মাদ্রী জানে পাশ ওয়ার্ড সে একবারই পেয়েছে। আর পাবে না। সে মাথা খাটিয়ে দেখল এমন একটা কায়দায় পাশ ওয়ার্ড কাজে লাগাতে হবে যাতে দুইবার সেক্স করা যায়। মাথা খাটিয়ে মাদ্রী ডাকলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয় কে। ওঁরা একটা, আবার দুটো। দুটো মিলে একটা। মাদ্রী এক পাসওয়ার্ড এ দুই দেবতা ম্যানেজ করলেন। জন্মাল দু দুটো ছেলে। দুই সতীনেরই সব ছেলে কিন্তু। নো মেয়ে। দশরথের চরু পায়েসেরও ওই গুণ। অনলি ছেলে। নো গার্ল চাইল্ড। তিন তিনটে রানী চরু পায়েস খেল, তবু নো গার্ল চাইল্ড ।
মাদ্রীর কাণ্ড দেখে কুন্তীর একটু রাগ হল। কুন্তীর তিনটে ছেলে। সেই ছেলের সংখ্যা দিয়ে হেজিমনি বজায় রাখতে চায় কুন্তী। আর মাদ্রী তার সাথে টক্কর দিতে চায় না কি? মুখে কুন্তী আপাতত কিছু বলল না। মাদ্রী যদি একটা চিচিং ফাঁকে দু দুটো দেবতা বাগাতে পারে, সে ওঁর কিসমতের খেল। বা গ্রে ম্যাটারের সৌজন্য। পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার দায়ে আপাততঃ পৃথা কুন্তী চুপ। সে উশুল করেছিল পরে। একদিন মাদ্রীকে দেখে কামোত্তেজনা জাগে পুত্রোৎপাদন ক্ষমতাহীন পাণ্ডুর। এদিকে ডাক্তারের স্পষ্ট নিষেধ ছিল পলকা শরীরের উপর চাপ পড়ে, এমন কোনো জিনিস করা চলবে না। এদিকে মাদ্রীর প্রতি কামোত্তেজনা এসে যেতে পাণ্ডু আর টিকলেন না। মারা পড়লেন। বর পাণ্ডুর মৃত্যুর জন্যে প্রকারান্তরে মাদ্রীকেই দায়ী করে কুন্তী তাকে পাঠিয়ে দিলেন সহমরণে। যাক সে সব মন খারাপ করা কথা।
ওদিকে জায়েদের পাঁচ পাঁচটা ছেলে হয়েছে শুনে গান্ধারীর মন খারাপ। সেও ভারি সুন্দর দেখতে মেয়ে। বর দৃষ্টিগত প্রতিবন্ধী, তাই সৌজন্য দেখিয়ে গান্ধারীও চোখে রুমাল বেঁধে থাকে। মহাভারতকার বলেছেন। তো চোখে রুমাল বাঁধলে যে কানেও রুমাল ঢাকা দিতে হবে তার তো বাধ্য বাধকতা নেই। সুতরাং গান্ধারীর কান খোলা। আর সেই শ্রবণ যন্ত্র দিয়ে জায়েদের ছেলে হয়ে গিয়েছে এই কথা গান্ধারীর মরমে পশিল রে, আকুল করিল তার প্রাণ। আকুল হবার যথেষ্ট কারণ আছে। জন্মগত দৃষ্টিহীন হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে চড়তে পান নি। পাণ্ডু রাজা ছিলেন। রাজরানী হবার সৌভাগ্য গান্ধারী মিস করেছিলেন। এবারেও তার ছেলে দেরিতে হলে রাজার মা হওয়াটাও ফসকে গেল। রাগ তো গান্ধারীর হতেই পারে। আর রাগ হলে নানা মানুষ নানা ভাবে রিঅ্যাক্ট করে। অসহায় মানুষ নিজেকেই আঘাত করে। গান্ধারীর স্বামীর দৃষ্টিশক্তি নেই , পুত্রোৎপাদন ক্ষমতা নেই, কুন্তীর মতো চিচিং ফাঁক বর নেই, গান্ধারী কোথায় যাবেন? সবার দয়ার পাত্রী হয়েই বাঁচতে হবে না কি?
রাগে ক্ষোভে নিজের তলপেটে আঘাত করলেন গান্ধারী। ধিক এই নারীজন্ম, ধিক এই নিষ্ফলা যৌন আকুতি … আঘাতের ফলে গান্ধারীর পেটে একটা মাংস পিণ্ড গজালো। মাংস পিণ্ড ক্রমে বড় হয়। গান্ধারী কি ভাবলেন কে জানে, যৌনমিলন ছাড়াই সন্তান? সে কি করে হয়? ব্যাসের ডাক পড়ল। সেই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। সেই যিনি সঙ্গম করে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন অম্বিকা গর্ভে আর পাণ্ডুর জন্ম দিয়েছেন অম্বালিকা গর্ভে আর বিদুরের জন্ম দিয়েছেন দাসী গর্ভে , নিজে যিনি জন্মেছেন মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর কন্যা অবস্থায় ঋষি পরাশরের যৌন সঙ্গমে, সেই ব্যাসকে ডেকে আনা হল।
ব্যাস তাঁর পুত্রবধূ গান্ধারীর তলপেট থেকে সেই মাংসপিণ্ড মোচন করলেন। তার পর সেই পিণ্ড কুচি কুচি করে কেটে একশো খানি আলাদা আলাদা পাত্রে পুষ্টিকর রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে রেখে দিলেন। কালে সেখান থেকে গান্ধারীর পুত্রগণ জন্মালো। আর জন্মালো একটি কন্যা। তার নাম দুঃশলা।
আপনারা কি এর পরেও বলবেন টেস্ট টিউব বেবির সৃজনশীল শিল্পী আমাদের ব্যাসদেব নন?
মহাভারতের কথা অমৃত সমান। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগ সেটা। যে পরমাণু বিদ্যুৎ এর নাম করে সব বড়লোক দেশ বোমা বানাবার নিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, কোনো রকম রাখঢাক না করে, ইউরেনিয়ম প্লুটোনিয়মের চক্করে না পড়েই মহাভারতীয় বিজ্ঞানীরা বজ্র তৈরী করেছিলেন। মহাভারতকার বলেছেন অথর্ব মুনির ঔরসে ও কর্দম কন্যা শান্তির গর্ভে দধীচির জন্ম হয়। বৃত্র নামে অসুর নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় বজ্র দধীচির হাড় থেকে তৈরী হবে জানা গেলে দেবতাদের “শান্তি” কামনায় দধীচি নিজের অস্থি দান করেন। হাড়ের মতো এত সুলভ জিনিস দিয়ে অসামান্য বজ্র তৈরী করেছিলেন মহাভারতীয়  বিজ্ঞানীর দল। দধীচির মায়ের নামটা দেখুন, শান্তি। পৃথিবীর সবকটা পরমাণু শক্তিধর দেশ ওই দধীচির মায়ের “শান্তি” নামটা মনে রেখে দিয়েছে। তাই সব পরমাণু গবেষণা একমাত্র শান্তির লক্ষ্যেই হয়। দধীচির বাবার নাম অথর্ব। এই নামটাও সাংকেতিক। অথর্ব মানে নির্ঘাৎ জানা আছে। পরমাণু শক্তির ব্যাপারে কেউ ট্যাঁ ফোঁ করলে তাকে কি করতে হবে ওই “অথর্ব” শব্দে তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন মহাভারতকার। কেউ কোনো আন্দোলন করতে পাবে না, তথ্য জানতে চাইতে পাবে না। পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষায় কোনো অপছন্দের লোক নাক গলাতে চাইলে গণতান্ত্রিক উপায়ে তাকে “অথর্ব” করে দিতে হবে। মহাভারত যুগ যুগ জিও।
প্রাচীন ভারতে যে জেনেটিক্সের অসামান্য উন্নতি হয়েছিল, তার কোনো তুলনাই হয় না। সে কালে মুনি ঋষিরা ছিলেন সাংঘাতিক ক্ষমতাবান। তাঁদের জন্মের পিছনে জেনেটিক্সের চমৎকার দেখা যাবে। আমাদের ছোটবেলায় মেয়েদের মাসিক ছিল আলোচনা জগতের বাইরের বস্তু। ওই মাসিক হলে তাকে গুহ্য ভাষায় শরীর খারাপ বলে বোঝানো হত। ছেলেদের যে বীর্যপাত হত, সেটাও খারাপ চোখে দেখা হত। ও সম্বন্ধে বলা হত বীর্যপাত হলে আয়ুক্ষয় হয়। মুনি ঋষিরা ঊর্ধ্বরেতা বলে প্রচার থাকলেও আমাদের প্রাচীন গাল গল্প গুলি তার বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি অগস্ত্য এর কথাই ধরা যাক। বেদে এক উচ্চ পদাধিকারী দেবতা ছিলেন মিত্রাবরুণ। তিনি আদিত্য যজ্ঞে উর্বশীকে দেখে যজ্ঞ কলসের মধ্যে রেতঃপাত করেন। সেই শুক্র হতে অগস্ত্য জন্মান। ওঁর সাথে ওই একই কলস হতে আর এক নামকরা ঋষি বশিষ্ঠ জন্মেছিলেন।
রেতঃপাত নিয়ে আমাদের ছোটবেলায় কিছু ঢাক ঢাক গুড় গুড় থাকলেও প্রাচীন ভারতের মুনি ঋষিরা ও নিয়ে কোনো সংকোচ করতেন না। ব্রহ্মার মানসপুত্র ছিলেন অঙ্গিরা এবং তার পুত্র ছিলেন উতথ্য । উতথ্যের স্ত্রী ছিলেন মমতা। উতথ্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতি।
দেবগুরু বৃহস্পতি ছিলেন অসামান্য লোক। তিনি বৌদি মমতাকে গর্ভিণী জেনেও বলপূর্বক সঙ্গম করতে যান।
মমতার গর্ভে ছিলেন উতথ্যের পুত্র । তিনি নিজের মায়ের উপর কাকার বলাৎকারের চেষ্টা পা দিয়ে প্রতিহত করতে চান। মমতাও তাঁর দেবর বৃহস্পতির জোর খাটানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে ছিলেন। গর্ভস্থ পুত্রের পদাঘাতে দেবগুরু বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পতিত হয়। ভূমিতে পতিত সেই বীর্য হতে ভরদ্বাজ নামে বিখ্যাত ঋষির জন্ম।
ভূমিতে পতিত বৃহস্পতির বীর্য হতে ভরদ্বাজের জন্ম তা তো ইতিমধ্যে বলেছি।
ভরদ্বাজ ছিলেন বিখ্যাত মহর্ষি। তিনি একদিন গঙ্গাস্নানে গিয়ে ভিজে কাপড় পরা এক অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে কামাতুর হন ও তাঁর শুক্রপাত হয়। ভরদ্বাজ জানতেন যে তাঁর বীর্যপাত মহামূল্যবান। তাই সেই বীর্য তিনি দ্রোণ নামে এক যজ্ঞপাত্রে রক্ষা করেন।
সেই পাত্রের নাম ছিল দ্রোণ। তাই থেকে ওই বীর্যজাত পুত্রের নাম হল দ্রোণ।
দ্রৌপদীর জন্ম বৃত্তান্তটি খেয়াল করুন গো বাবু মশায়রা। ও মেয়ে না কি যজ্ঞের আগুন থেকে সোজা উঠে এসেছিল। । সে সব দিনে ত্বকের রং কটা না হলেই তাকে অবছেদ্দা করতে হবে, এমন নিয়ম সিভিল সোসাইটি তে ছিল না। দ্রৌপদী ছিল কালো মেয়ে। তাই তার আরেক নাম কৃষ্ণা। যজ্ঞের আগুন থেকে উঠে এসেছিল বলে তার আরেক নাম যাজ্ঞসেনী । সে পাঞ্চালী, কেননা, সে পাঞ্চাল রাজকুমারী। এই অব্দি বেশ লাগে। জেনেটিক্সের পাঠ শুরু হয় তখন যখন দেখি, কৃষ্ণা দ্রৌপদী যৌবনবতী হয়ে জন্মাচ্ছেন। লোকে ছোট্টটি হয়ে জন্মায়। ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদে। এই দ্রৌপদী মেয়েটা একেবারে সাবালিকা হয়ে জন্মালো। আপনারাই বলুন, এর মধ্যে জেনেটিক্সের চমৎকার নেই?
দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন মহা ত্যাঁদড়। কেউ তপস্যা করছে দেখলেই ইন্দ্রের ইনসিকিওরিটি ফিলিং হত। তাইতে ইন্দ্র সুন্দরী অপ্সরী পাঠিয়ে তার তপস্যা ভাঙানোর চেষ্টা করতেন। দধীচি নামে সেই যে নামজাদা মুনি ছিলেন, যাঁর হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি হয়েছিল, সেই দধীচির সাথে ইন্দ্রের সম্পর্ক মধুর ছিল না। ইন্দ্র ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতেন। তো একবার দধীচি খুব তেড়ে ফুঁড়ে তপস্যা করছেন। ইন্দ্র চাপে পড়েছেন। সিংহাসন গেলে আর ফিরে পাবার চান্স নেই। তো দধীচিকে টাইট দিতে ইন্দ্র অলম্বুষা নামে অপ্সরীকে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যস, অপ্সরী দেখে দধীচির রেতঃপাত হয়ে গেল। অপ্সরী তো ধরা দেয় না। মুনির বীর্য পড়ল সরস্বতী নদীর জলে। সেই নদী জলেই জন্মালো এক মুনিকুমার। নাম তার সারস্বত।
ময়ূরের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে নয়, স্রেফ ময়ূরের চোখের জল পান করে ময়ূরী ডিম পাড়ে, ভারতের জাতীয় পক্ষীর প্রজনন বিষয়ে এমন অত্যাশ্চর্য মত প্রকাশ করে এক জজ সাহেব খুব আওয়াজ খেয়েছিলেন। সবাই তাঁর বুদ্ধি শুদ্ধি নিয়ে হাসি তামাশা করেছিল।
কিন্তু প্রাচীন ভারতে চোখের জল প্রজননের কাজে লাগত। একবার ব্রহ্মা সুমেরু পর্বতে সভা বসিয়েছেন। শত যোজন লম্বা সে সভা কক্ষ। হঠাৎ ব্রহ্মার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ল। ওমা, সেই জলের ফোঁটা থেকে বেরিয়ে এল এক বানর। তার নাম দেওয়া হল ঋক্ষরজা।
দেখা গেল, চোখের জল যদি ব্রহ্মার হয়, তা হলে বানর জন্মায়। আর ওই টেকনিকে ময়ূরের চোখের জলের সৌজন্যে কিছু হবে না কেন?
১০
সেই যে ব্রহ্মার চোখের জল থেকে ঋক্ষরজা নামে বানরের জন্মের কথা বলছিলাম, ব্রহ্মা তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুমেরু পর্বতের আশে পাশে ঘুরে ঘুরে ফল মূল খেতে।
তো সেই ঋক্ষরজা বানরটা তাই করছিল। হঠাৎ একটা সরোবর দেখে জলের ভিতর কি আছে ডিং মেরে দেখতে গেল ঋক্ষরজা। নেহাত কৌতূহল আর কি। জলে নিজের ছায়া দেখে বাঁদুরে বুদ্ধিতে ঋক্ষরজা ভাবল যে তার সমগোত্রীয় প্রাণী তাকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। আর যায় কোথা। বাঁদুরে বুদ্ধিতে সরোবরের ছায়ার সাথেই লড়তে গেল ঋক্ষরজা। ওমা, যেই ঋক্ষরজা যেই জলে ঝাঁপ দিয়েছে, তখুনি এক অপরূপা সুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল ঋক্ষরজা।
১১
তো জলে ডুব দিতেই বানর ঋক্ষরজা হয়ে গেল পরমা সুন্দরী কামিনী। আহা, ভূভারতে অতো সুন্দর মেয়ে আর কই? মেয়ে দেখলেই যাঁদের জিভে লালা ঝরে, সেই দেবতাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ইন্দ্র ও সূর্য এগিয়ে এলেন। ইন্দ্র সেই সুন্দরী রূপবতীর চিকুর অর্থাৎ চুলে রেত:পাত করলেন। আর সূর্য ওই কন্যার গ্রীবায় রেত:পাত করলেন।
মেয়ের মাথার চুল থেকে জন্মালো বালী, আর গ্রীবা দেশ থেকে জন্মালো সুগ্রীব।
প্রাচীন ভারতে জেনেটিক্সের উৎকর্ষ প্রমাণ করতে এই বাঁদুরে কাণ্ডটা মনে রাখুন।
১৩
অহল্যার মতো জ্যান্ত মেয়েকে না মেরে ফেলে পাথর বানিয়ে রেখেদিলেন গৌতম মুনি । আর ইন্দ্রের গায়ে বানিয়ে দিলেন এক হাজারটি যোনি । তার পর সেই যোনি গুলি হয়ে গেল চোখ। এটা নিশ্চয় মহা প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসার চমৎকার ।
এবার মহা প্রাচীন ভারতের আর এক মেয়ের সাথে আর এক মহা মুনির প্রেমের কথা বলি। সেই মুনির নাম পরাশর।
তো পরাশর যার প্রেমে, মানে দৈহিক টানে মজলেন, (আমি প্লেটোনিক বা অলোক সম্ভব প্রেমের কথা বলছি না। স্বর্গীয় , মানে দেবতাদের প্রেমের কথা বলছি। সেই সূর্য, ইন্দ্র , সেই সব অতি কামুক দেবতাদের গল্প।) সেই অঘটন ঘটন পটীয়সীর নাম সত্যবতী। তো আমাদের সত্যবতী হলেন রাজার মেয়ে। তবে রাজাটি তেমন কুলীন নন, তিনি মৎস্য রাজ। মৎস্য রাজকন্যা সত্যবতী স্মার্ট মেয়ে। রীতিমতো নৌকা চালায়। চোখ মুখের ডৌল ভারি চমৎকার । তো পরাশর তারই প্রেমে, মানে দৈহিক টানে মজলেন ।
একদিন সত্যবতী নৌকা বাইছে। পরাশর তার নৌকায় পার হবেন। মাঝ নদীতে এসে পরাশর তার প্রেমের, মানে স্বর্গীয় প্রেম, অর্থাৎ নিপাট যৌন আবেদন পেশ করে বসলেন সত্যবতীর কাছে। সত্যবতী স্মার্ট মেয়ে। দেহ নিয়ে তার অতো ঘিন ঘিনানি ছিল না। আর মেয়েটি বেশ একটু প্র্যাগম্যাটিক গোছের ছিল। সে দেখল দেহ যদি না দিই, তা হলে ব্যাটা বামুন আমায় ভস্ম করে দেবে বা পাথর বানিয়ে দেবে। ওরা হল গিয়ে মোর ইকুয়ালের দল। ওরা যা করবে সেটাই ঠিক । মুনি ঋষিদের তখন সিণ্ডিকেট রাজ চলছে। তো চালাক চতুর মৎস্য রাজ কন্যা পরাশরকে বললো যে দ্যাখো আমি মেছোদের ঘরের মেয়ে কি না, আমার গায়ে মাছের ভারি গন্ধ। তুমি আমার গায়ে ভালো গন্ধ করে দিও তো। যৌন কামনায় অস্থির পরাশর মুনি বললেন হবে হবে সব হবে। আগে তুমি আমায় দেহ দাও। সত্যবতী বলল আর শোনো ইয়ে, মানে তোমার সঙ্গে তো আমায় যৌন বিহার করতে হবে, কিন্তু তার পরে আমার বিয়ে হবে কি করে? আমি তো সঙ্গমের পর আর অক্ষত যোনি থাকব না। তো তুমি আমায় আবার নিখুঁত কুমারীটি , মানে একেবারে ভার্জিন মেয়েটি করে দিও। কামতাড়নায় অস্থির মুনি পরাশর তাতেও রাজি। তিনি একেবারে ছটফট করছেন যৌন তাড়নায়।
এমন সময় সত্যবতী বললো, দিনের আলো ফটফট করছে, এই সময় এই রকম ফাঁকা যায়গায় আমি গা খুলি কি করে বল তো ঠাকুর? আমি কি ভাদ্র মাসের কুকুর বেড়াল?
মুনি তখন যোগ বলে ঝঞ্ঝা সৃষ্টি করে তার কাঙ্খিত আড়াল তৈরি করে দিলেন। যৌন তৃপ্তির পর সত্যবতীর গর্ভাধান হল। জন্ম নিলেন মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। সেই ব্যাস যিনি মহাভারত লিখবেন। মা সত্যবতীর অনুরোধে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম দেবেন।
ব্যাস মানে বেদের যিনি বিভাগ করেছিলেন। এমন আরো কয়েকজন ব্যাস ছিলেন।
১৪
তা হলে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে খোদ ব্রহ্মার নাতি বিশ্রবা মুনি আর পরমা সুন্দরী কৈকসীর যৌন মিলনে রাবণ জন্মালেন। জন্মালেন কুম্ভকর্ণ , বিভীষণ আর শূর্পণখা, এবং এরা ভাই বোন সব কজন রাক্ষস, আর তার মধ্যে মায়ের কান্নাকাটিতে বিভীষণ এর ধর্মবুদ্ধি ছিল।
মুনির ছেলে মেয়েরা রাক্ষস হল কেন?
শাস্ত্রকার বলছেন প্রদোষ কালে যৌন মিলনের জন্য।
কি সাংঘাতিক! তাহলে কৈকসী কি চার রাক্ষস সন্তানের জন্য চার বার গর্ভ ধারণ করেছিলেন? না কি, এক বারের যৌন সঙ্গমেই চার চারটে রাক্ষস জন্মের সূচনা হয়েছে? বিশ্রবা মুনি যদি এতই জানতেন, তাহলে জেনেশুনে রাক্ষস গুলির জন্মদোষ এড়াতে প্রদোষ কাল কে পাশ কাটালেন না কেন?
আমাদের গল্পের পিছনে কিন্তু উঁকি মারছে সুমালী। রাবণের মাতামহ। সে কিন্তু রাক্ষস ।
আমরা কি এভাবেও ভাবতে পারি যে, পিতা মুনি হলেও মা রাক্ষস কন্যা ছিলেন বলে সন্তানেরা সব কয়টা রাক্ষস হল। সে কি মাতৃতান্ত্রিক ব্যাপার স্যাপার? মায়ের পরিচয়েই সন্তানের পরিচয়?
এমন কিন্তু উদাহরণ আরো একটা মনে পড়ছে। বন্ধুরা বিদুরের কথা ভেবে দেখুন। সেই বিদুর, মহাভারতকার যাকে সর্বদা ধর্মাত্মা বলে চিনিয়েছেন। ধর্মাত্মা , কিন্তু তাকে কেউ কোনোদিন পাত্তা দেয় নি। বিদুরের কথার সামাজিক রাজনৈতিক ওজন দেখতে পাই না কুরুবর্ষে।
কিন্তু কেন? ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু যে ভাবে মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের ঔরসে জন্মেছেন, বিদুরও তো সেভাবেই জন্মেছেন। এক মহর্ষি বেদব্যাস তাঁদের জন্মদাতা পিতা। তা হলে বিদুর পাত্তা পান না কেন কুরুবর্ষে ?
আমরা কি এভাবেও ভাবতে পারি যে, পিতা এক ব্যক্তি হলেও ধৃতরাষ্ট্রের গর্ভধারিণী ছিলেন কাশীরাজের মেজ মেয়ে অম্বিকা , আর পাণ্ডুর গর্ভধারিণী ছিলেন কাশীরাজের ছোট মেয়ে অম্বালিকা; কিন্তু বিদুর ছিলেন দাসীগর্ভজাত সন্তান। পিতৃপরিচয় নয়, কে গর্ভধারণ করলেন, সেই পরিচয় সামনে চলে এল। সারা জীবন পাত্তা পেলেন না মহাজ্ঞানী বিদুর ।
উপরের দুটি দৃষ্টান্তেই মায়ের পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় দিতে চেয়েছে মহা প্রাচীন ভারত।
১৫
আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারদের একটা ভালো গুণ ছিল। তাদের ঢাক ঢাক গুড় গুড় করার অভ্যাসটা কিছু কম ছিল। ঘোমটার নিচে খেমটা নাচা তাঁরা বিশেষ পছন্দ করতেন না। সেকালে গর্ভিণী আর গর্ভস্থ ভ্রূণের কথা কিছু বলা দরকার মনে করছি।
সকলেই জানেন, গর্ভ ধারণ করলে মায়েদের একটু বেশি যত্ন লাগে। কিন্তু আমাদের রামচন্দ্র তা করা দরকার মনে করেন নি। তিনি গর্ভিণী স্ত্রীকে বনবাস দণ্ড দিয়েছেন। নির্বাসিত হয়ে বাল্মীকি মুনির আশ্রয়ে বনে বাসকালে সীতা দু দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, লব ও কুশ। তারা বড়ো হয়ে বাল্মীকি মুনির কাছে রামগুণ গান শিখে রামের রাজসভায় গান শোনাতে এলে পিতার বুকে দরদ উথলে উঠেছে ।
দুষ্যন্তের গল্পটিও পাঠক বন্ধু অনুগ্রহ করে স্মরণ করবেন। উদ্ভিন্ন যৌবনা শকুন্তলার সাথে নিভৃতে যৌন মিলন করলেন রাজা। আর একটি অঙ্গুরীয় দিলেন। শকুন্তলা সোজা সাপটা মেয়ে। সে তো জানে না ভারতের রাজা গজাদের হারেম থাকে আর হারেমে কত যে দাসী বাঁদি থাকে তার আর ইয়ত্তা নেই। সে ভেবেছে রাজা তাকে ভালো বেসেছেন, আর ভালোবেসে দেহভোগ করেছেন। আশ্রম মাতা গৌতমী আর মুনি কণ্বের দুই শিষ্য শার্ঙ্গরব আর শারদ্বতকে নিয়ে রাজা দুষ্যন্তের রাজসভায় গিয়ে নিজের অধিকার চাইতে গিয়ে শকুন্তলা বেকায়দায় । রাজা বললেন অভিজ্ঞান কিছু আছে? আমি যে তোমার সাথে যৌন সঙ্গম করেছি, তোমায় গর্ভবতী করেছি, সেই ব্যাপারে ডকুমেন্টেশন কিছু এনেচো সোনা ?
শকুন্তলার মাথায় হাত। আরে মাথার চুলে যে রাজার দেওয়া আংটি ছিল, সেটা গেল কোথায়?
রাজসভা হো হো করে হেসে উঠলো । এভিডেন্সের অভাবে মামলা খারিজ। গর্ভবতী রমণী খোরপোষের মামলায় বেবাক হেরে গেল।
আশ্রম মাতা গৌতমী আর মুনি কণ্বের দুই শিষ্য শার্ঙ্গরব আর শারদ্বত গর্ভবতী শকুন্তলাকে নিজেদের আশ্রমে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন না। শকুন্তলার ঠাই হল অন্য এক আশ্রমে।
শকুন্তলা যথাকালে সন্তানের জন্ম দেবেন। তার নাম হবে সর্বদমন ভরত। এদিকে আংটি উদ্ধার হয়েছিল এক জেলের থেকে। সে বেচারি মাছের পেট কেটে মহা মূল্যবান অঙ্গুরীয় পেয়েছিল। সে অঙ্গুরীয় গিয়েছিল রাজার কাছে, রাজ দরবারে।
অঙ্গুরীয় দেখে রাজার মনে পড়েছিল শকুন্তলার কথা। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে খুঁজতে বের হন রাজা। আশ্রমে গিয়ে শিশুটিকে সিংহ ছানার সাথে দুষ্টুমি করতে দেখে রাজা শিশুর মধ্যে নিজের আদল খুজে পান।
রাম আর দুষ্যন্তের উভয়েরই পুত্র সন্তান। কন্যা সন্তান হলে কি হত?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।