ধর্মপুত্রের অধার্মিকতা লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

ধর্মপুত্রের অধার্মিকতা 

যুধিষ্ঠিরের গল্প তো কিছু কিছু বলেছি। তার সেই অজ্ঞাতবাসের কালে জতুগৃহে পাঁচ পাঁচটা নিষাদের আর তাদের মায়ের রহস্যপূর্ণ পুড়ে মরার গল্প লিখেছিলাম। জতুগৃহ থেকে বাঁচার অধিকার নিশ্চয় পাণ্ডবদের ছিল। কিন্তু তার জন্য নিষাদগুলির পুড়ে মরার ব্যবস্থা করা ঠিক ধর্মসংগত মনে হয় না। পাণ্ডবদের জতুগৃহ ত্যাগের আগের রাতে একটা গণভোজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর বেশ মতলব ভেঁজেই নিষাদগুলিকে আনানো হয়। ভূরিভোজ করে তারা ঘুমিয়েও পড়ে। তারপর পাণ্ডবরা নিজেরাই জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে সরে পড়েন। মারা পড়ে দলিত শ্রেণীর নিষাদ কয়টি। দলিত শ্রেণীর প্রতি আমাদের তথাকথিত ধর্মপুত্রের কোনো দিনই সম বিচার সমদৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। একলব্যের গল্পটি মনে করুন। পৌরব গণের অস্ত্রগুরু দ্রোণ আসলে ছিলেন একজন দক্ষ ও অনুগত আমলা। সাচ্চা আমলাতান্ত্রিক মন জানে আনুগত্য কাকে বলে। দ্রোণের বাধ্যবাধকতা ছিল পৌরবদের বাইরে কাউকে সেরা ধনুর্ধরের শিরোপা দেওয়া যাবে না। তাই, একলব্যকে শেষ করে দেওয়া ছিল দ্রোণের স্ট্র্যাটেজি। বেশ মতলব করেই দ্রোণ একলব্যের কাছে গুরু দক্ষিণা বাবদে এমন একটা জিনিস চাইলেন যাতে দলিত তরুণটির জীবন শেষ হয়ে যায়। সে সময় আমাদের ধর্মপুত্রের ধর্মবুদ্ধি নড়ে চড়ে ওঠে নি।
মেয়েদের ব্যাপারেও যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ কাজ করত না। সকলের জানা ছিল অর্জুন বীর্যশুল্কে জিতে এনেছে পাঞ্চালী যাজ্ঞসেনীকে। অমন ধনুক ধরার এলেম ধর্মপুত্রের নিজের বা বাকি পাণ্ডবদের ছিল না। তাহলে সকলে মিলে দ্রৌপদীকে ভাগ করে নিতে গিয়ে যুধিষ্ঠির নরকের দুয়ার খুলে দিলেন। কুরুসভায় ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ প্রমুখের সামনে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রেক্ষাপটে দুর্যোধন দুঃশাসন তার একাধিক পতিগমনের প্রসঙ্গ এনেছে। এই ব্যাপারটা ধর্মপুত্রের অদূরদর্শিতার নিদর্শন।
যুধিষ্ঠির জুয়ার নেশার দাস ছিলেন। জুয়া খেলতে ডাকলে নিজেকে তিনি আর সামলাতে পারতেন না। তার এই সাংঘাতিক দুর্বলতাটা জানা ছিল কৌরবদের। অন্ততঃ দুবার তারা যুধিষ্ঠিরের এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়েছে। স্ত্রীকে হিন্দুরা সহধর্মিণী বলে। স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষাকে হিন্দু একটা বড় কর্তব্য মনে করে। সেই বোধ হেলায় ভাসিয়ে দিয়ে এই অধার্মিক লোকটি নিজের ঘরের বউকে জুয়া খেলায় বাজি রেখেছে। ভেতরে কতখানি নেশার দাপট থাকলে একটা লোক এভাবে স্ত্রীকে বিকিয়ে দিতে পারে? এটা কিন্তু শেষ নয়। অজ্ঞাতবাসের দিনেও বিরাট রাজার বয়স্য হয়ে কঙ্ক নাম নিয়ে এই জুয়াড়ি যুধিষ্ঠির নিজেকে জুয়া বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দেয়। বিরাট রাজাকে জুয়া খেলতে সাহায্য করাই ছিল অজ্ঞাতবাস পর্বে কঙ্ক যুধিষ্ঠিরের পেশা। জুয়া তার রক্তে মিশে গিয়েছিল।
অর্জুন নেহাত বাধ্য হয়ে তার বড়দার ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিল। থাকলই বা দ্রৌপদী সেখানে? দ্রৌপদী তো ওদের সকলের কমন বউ। সেই অপরাধে তাকে নির্বাসন? এটা আর কিছু নয়, কায়দা করে অর্জুনকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরিয়ে দেওয়া।
কুন্তী যে আসলে কর্ণের গর্ভধারিণী জন্মদাত্রী মা, এটা অনেকেই জানত। কর্ণের চেহারা দেখলেই বেশ বোঝা যেত যে আসলে সে সূতপুত্র নয়। কিন্তু দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় কর্ণকে সূতপুত্র বলে ধনুকের কাছে ঘেঁষতে না দেবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে উচিত ছিল যুধিষ্ঠিরের। জন্মের কারণে কর্ণকে সরিয়ে দেবার অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যুধিষ্ঠির একটা মানবিক নিদর্শন রাখতে পারতেন।
যুধিষ্ঠির কি খবর রাখতেন না, তার মা কুন্তী যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে কর্ণকে গিয়ে কি কি বলেছেন? কুন্তীর সস্তা প্রতিশ্রুতি দেবার ব্যাপারটা একালের রাজনীতিবিদদের প্রতিভার তুল্য।
অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুকে ওর যুদ্ধ করতেই দেওয়া উচিত হয়নি পাণ্ডব তরফের সর্বাধিনায়ক হিসেবে। একটা নাবালক ছেলে, যুদ্ধের খানিকটা কায়দা জানে, বাকিটা জানে না, একে তো মাঠে নামতে দেওয়াই চলে না। আর মিথ্যে কথা? দরকারে বেশ পাকা মিথ্যেবাদী হতে পারতেন যুধিষ্ঠির। আমরা ঠোঁটে কি উচ্চারণ করলাম সেটা বড় কথা নয়, ভেতরে কি বার্তা রইল সেটাই বিবেচ্য। অশ্বত্থামা নামে আবার হাতি হয়? হাতি নিজের নামের তাৎপর্য জানে? কেবল যুধিষ্ঠিরের সত্যবাদিতার প্রচারের উপর দ্রোণের অগাধ বিশ্বাসকে ধর্মপুত্র ডুবিয়ে দিলেন। নইলে দ্রোণকে হারানো যেত না। মতলবের ঘাটতি ছিল না ভীষ্ম বধের আয়োজনেও। পিতামহ ভীষ্মকে বাগে পেতে শিখণ্ডীকে ব্যবহার আর অস্ত্রহীন ভীষ্মকে আঘাত করতে যুধিষ্ঠিরের সম্মতি ছিল।
সবচাইতে খারাপ লাগে এটা ভাবলে যে দ্রৌপদীকে যৌন ঈর্ষা করতেন যুধিষ্ঠির। তিনি ভাবতেন দ্রৌপদী ভীমসেনকে বেশি ভালবাসেন। তার পায়ে হেঁটে স্বর্গ যাত্রায় পড়ে যাবার সময় একথা যুধিষ্ঠির বলে নিজের নীচতা প্রকাশ করেছেন। পাঞ্চালী কম ভালবাসে জেনেও তার দেহভোগ করতে ধর্মপুত্রের বাধে নি। তার গর্ভে সন্তান আনতেও অসুবিধা হয় নি। সেই যৌন ঈর্ষার দাপটেই কি দ্রৌপদীকে বাজি রাখেন ধর্মপুত্র? সবার সামনে তাকে টেনে আনার রাস্তা করে দেন যিনি, তিনি ধর্মপুত্র? কোন ধর্মে বলা আছে জুয়া খেলা ভাল, জুয়া খেলতে গিয়ে বউকে বাজি রাখা ভাল, বউএর শ্লীলতাহানি চোখে দেখে চুপ করে থাকা ভাল?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।