• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭১)

পর্ব – ৭১

৭০

বাসন্তীবালা বলেন কি মিষ্টি গানের গলা তোর! ভাল লাগছে খুব।
 শ‍্যামলী বলে, মা, তুমি এইখানেই শুয়ে পড়ো। আমি তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিই।
বাসন্তীবালা বলেন, আমার আর ঘুম আসে না রে। শুলেই রাজ‍্যের দুশ্চিন্তা। ছেলেদুটো মানুষ হল না। তনুশ্রীর ব‍্যাগ থেকে টাকা বের করে নিয়ে নেশা করে ফিরেছিল। ওইজন‍্যে তনুশ্রী তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি তোর বাবার কাছে খবরটা ভাঙি নি‌। জামাইবাড়িতে গিয়ে এমন অসৈরণ কাণ্ড করেছে শুনলে আর বাঁচবে না লোকটা।
শ‍্যামলী খুব ধৈর্যের সঙ্গে মাকে বলল, একটু দু চোখ বোজো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। দেখি, কেমন ঘুম না আসে।
গান ধরে,
তোমায় গান শোনাব   তাই ত আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া
তার মা বলেন, মা রে, বুকের ভেতর বড্ড কষ্ট। কত করে তোদের মানুষ করেছি। তনুশ্রীকে দেখে সকলে বলত, এত ফুটফুটে মেয়ে এ চত্বরে আর নেই। লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো মেয়েটা আমার। সবাই বলেছিল, দেখো, এই মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকে মাথায় তুলে নিয়ে যাবে। তাই হয়েছে। এক কথায় তোর দিদির বিয়ে হল। অতো বড়ো ব‍্যাঙ্কের ম‍্যানেজার। কতোটা টাকা মাইনে পায়।
শ‍্যামলী গেয়ে চলে,
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক’
ওগো দুখ জাগানিয়া
বাসন্তীবালা বলে চলেন, দুজনের মধ্যে বয়সের তফাৎ একটু আছে। তা তেরো চৌদ্দ বছরের ফারাক আমাদের সময়েও থাকত। মায়েদের মুখে শুনেছি, বয়সের ফারাক বেশি হলে মেয়েদের মানতে সুবিধা হয়।
শ‍্যামলী গায়,
এল আঁধার ঘিরে
পাখি এল নীড়ে
তরী এল তীরে
তবু আমার হিয়া বিরাম পায় না কো
সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল তনুর বিয়ে হয়েছে। জানুয়ারিতে চারে পড়বে। এখনও তনুর একটা খোকা হল না। কিছু বললে বলে, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।  আচ্ছা, তোর নয় বয়েস বেশি হয় নি। ঊনিশ পার করেই বিয়ে। তাহলে তেইশ। তোর থেকে তো মোটে আড়াই বছরের বড় ও। কিন্তু জামাইয়ের তো বয়েস বসে নেই। চল্লিশ হতে যায়। কবে ছেলেকে মানুষ করবে বলতো?
শ‍্যামলী মাকে বলে, মা গান শোনো। বাসন্তীবালা বলেন, বিয়ের পর খোকা খুকু না হলে মানায়? আমাদের‌ও তো একটা আশা থাকে নাতিকে আদর করব, রোদে তেল মাখাবো, কাঁথা সেলাই করব। তা যদি একটু বুঝত মুখপুড়িটা!
শ‍্যামলী বলে, এভাবে উদ্বেগ করলে শরীর খারাপ করবে গো। তুমি একটু চোখ বোজো। এই আমি হাত চাপা দিই। গানটা কি ভাল, একটু শোনো,
আমার কাজের মাঝে মাঝে
কান্না হাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে
বাসন্তীবালা বিড়বিড় করে বলেন, শান্তুটা মানুষ হল না। কুটুমবাড়ি গিয়ে চোর বদনাম কিনল। জামাইটার কাছে তনু কতখানি লজ্জায় পড়ল  বল্ তো! তোর বাবার কাছে সব ধামাচাপা দিয়ে রেখেছি। পাড়ার কাউকে ওপরে উঠতে দিই না। সবিতাকে দিয়ে মা শেতলার কিরে করিয়ে নিয়েছি। খবরদার, দাদাবাবুকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাস্ তো এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করবি নি।
শ‍্যামলী গায়, আমায় পরশ করে
প্রাণ সুধায় ভরে
তুমি যাও যে সরে
তোর বাবা মেতে উঠলেন গুরুদেব নিয়ে। এখানে মন্দির, সেখানে আশ্রম। আর ছেলেরা পড়াশুনা ছেড়ে দিল। এত কাঁদি ঠাকুরের কাছে, ও গো, ঠাকুর, তুমি যদি সত্যি হ‌ও তো ছেলে দুটোকে একটু সুমতি দাও!
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন বাসন্তীবালা।
শ‍্যামলী গায়,
বুঝি আমার ব‍্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাকো।
অনুযোগের সুরে বাসন্তীবালা বলেন,   হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলী, আগে তুই কত জায়গায় যেতিস, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, আবৃত্তি…. কতো প্রাইজ আনতিস, দেয়াল ঘড়ি, জাপানি টি পট, ফুলদানি, এখন আর কিছু পাস্ না মা?
শ‍্যামলী বলে ব‌ইও তো কতগুলো পেয়েছি মা।
বাসন্তীবালা বলেন, তা পেয়েছিস, কিন্তু ঘর সাজানোর জিনিস দেখে সবাই আহ্লাদ করত।
এখন আর ওসব দিকে সময় পাস্ না, মা গো?
শ‍্যামলী বলে, না মা, আমি এখনও বলি। কিন্তু এখন আমি ভেতরের কথা বলি। ওরা যা শুনতে চায়, সে কথা ঠোঁটের ডগায় সাজিয়ে গুছিয়ে বলার সময় আমার পেরিয়ে গেছে মা। এখন আমার নিজের সাথে নিজের কথা। আমি আর কারো দিকে চেয়ে কিছু বলি না মা। তাই ওদের পছন্দ হয় না। আমায় কেউ ভালবাসে না মা।
বাসন্তীবালা বলেন, তা বললে হবে কেন? পাঁচজনের মধ্যে থাকতে গেলে তোমাকে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে।
শ‍্যামলী বলে, মা আমি সে দায় পেরিয়ে গিয়েছি। আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি, ওইসব হাততালির চেয়ে অনেক বড় কিছু আমায় গড়ে নিতে হবে। সাজানো গোছানো কথায় সে জিনিস হবার নয়।
এমন সময় আধো কাক ডেকে উঠলে শ‍্যামলী জানালা ফাঁক করে দেখল পুব আকাশে অরুণ আলো উঁকি দিয়েছে।
বাসন্তীবালা বলেন, তোকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না শ‍্যামলী। তোকে রমানাথ কত ভালবাসে। কত খোঁজ নেয় তোর। তুই ঘুরিয়ে তাকে একটা ফোন করিস্ না। কাউকে এত অবছেদ্দা করা ভাল?
শ‍্যামলী উদগ্রীব হয়ে বলল, ক‌ই মা, কবে তিনি ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন?
বাসন্তীবালা বললেন, এই তো, আজ‌ই সে ফোন করেছিল। বলল, আসার খুব ইচ্ছে, কিন্তু, তার ব‍্যবসার খুবই চাপ। পুজোর মুখে ফুরসৎ পায় না।
শ‍্যামলী উৎসুক হয়ে বলে, তারপর ওঁকে কি বললে মা তুমি?
বললাম, কারখানায় ফোন করে দ‍্যাখো। আমরা বাপ মা হয়ে মহারাণীর দেখা পাই না, তোমার ভাগ‍্যে থাকলে পাবে!
শ‍্যামলী হাসে। বলে, ছি মা, তুমি এভাবে বলতেই পারো না।
রাগ দেখিয়ে বাসন্তীবালা বলেন, কেন বলব না শুনি? আজ তুই কারখানায় ছিলি? কোথায় কোথায় ঘুরিস আজকাল, একটু বলার প্রয়োজনটাও মনে করিস না। আমি বলছি না, যে এত বড় হয়ে সর্বদা পারমিশন নিতেই হবে। তবু মায়ের প্রাণে ইচ্ছে তো করে, আমি জানব, আমার মেয়ে কোথায় আছে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।