• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৭)

পর্ব – ১৭

১১৬
কারখানায় সবে কাজ শুরু হয়েছে। এই সাত সকালে গ্যারাজের সকলে শ্যামলীকে দেখে অবাক হয়ে গেল । সবাই জানে শ্যামলী মর্নিং কলেজে যায়। পড়া হলে লাইব্রেরীতে কাজ করে। তার পর ফেরার পথে গ্যারাজে ঢুঁ মারে । স্টক মেলায় রোজ । ক্যাশ বইয়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে গুণতি করে দ্যাখে । যা টাকা থাকে, তখন একবার নিয়ে যায়, আবার সন্ধ্যের পরে এসে স্টক মেলায় । টাকা হিসেব করে। শ্যামলীকে ভোরে আসতে দেখে মিস্ত্রীরা অবাক হয়ে গেল । আরো অবাক হয়ে গেল তার সাথে রিকশায় হারমোনিয়াম দেখে ।
রিকশাটাকে দাঁড় করিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকল শ্যামলী।কয়েকজন মিস্ত্রীকে ডেকে নিল সেখানে। বললো “ আমি বুঝতে পেরেছি রাম নারায়ণ মিশ্রের লোকেরাই জোর খাটিয়ে বিনে পয়সায় গাড়ি সারিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ওরাই হেড মিস্ত্রীকে মেরেছিল। আমি থানায় ডায়েরী করেছিলাম। পুলিশ কিছু করেনি। এখন আমি চুপ করে থাকলে অত্যাচার আর বাড়বে । আমি আজ লড়াই করতে বসব। তোমরা কেউ চাইলে আমার সাথে থাকতে পারো । আমি অন্যায় দেখে চুপ করে বসে থাকবো না।
শ্রমিকেরা জানতে চাইল “কি করতে চাও তুমি ছোড়দি ।“
শ্যামলী বলল “গেলেই দেখতে পাবে। তোমরা কেউ না গেলে আমি একলাই যাব।“
জনা দুয়েক নাছোড় শ্রমিক জানতে চাইলো “কি করতে চাও বলবে না?”
শক্ত হয়ে মেয়ে বললো “না। বলবো না। গেলে দেখতে পাবে। তোমাদের মধ্যে যার ইচ্ছে হবে আমার সাথে যেতে পারো।“
দু একজন শ্রমিক সতর্ক স্বরে জানতে চাইলো “থানা পুলিশের হুজ্জোত হবে না তো?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে শ্যামলী বললো “যার যার ভয় আছে, তারা যেয়ো না। গণ্ডগোল হতেই পারে। তবে আমি নিজে থেকে যেচে কোনো অশান্তি পাকাবো না।“
সকাল সকাল একটি মিছিল শুরু হয়ে গেল। একটি রিকশা ভ্যানে হারমোনিয়াম রেখে “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম “ গাইতে গাইতে হাঁটতে লাগলো শ্যামলী । পিছনে পিছনে মজুরেরা। তারা জানে না কি ধরণের লড়াইতে নামা হচ্ছে। সকাল বেলা রামধুন গান গাইতে গাইতে একটি সদ্য তরুণী মেয়ের পিছন পিছন শ্রমিকেরা হাঁটছে দেখে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না।তবে সকালে রাম গানের কারণে কিছু ভক্ত মানুষ তাদের সাথে জুটে গেল। মিছিলটি বেশ চোখে পড়ার মতো হয়ে গেল। সবার কণ্ঠে “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / পতিত পাবন সীতারাম “।
লোহা মাফিয়া রাম নারায়ণ মিশ্রের বিশাল অট্টালিকা। বড়ো লোহার গেট সাধারণতঃ বন্ধ থাকে। তার মধ্যে ছোটো গেটের সামনে দুজন প্রহরী সর্বদা মোতায়েন থাকে। তাদের হাতে লাঠি থাকে। রামধুন গাইতে থাকা মিছিল নিয়ে গেটের সামনে গিয়ে শ্যামলী দাঁড়িয়ে পড়লো । এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেয়ে যেতে থাকলো “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / পতিত পাবন সীতারাম। “ শ্রমিকেরা কেউ কেউ বেশ বুঝতে পারছিল যে লোহা মাফিয়া রাম নারায়ণের নাম ধরে গান গাইছে শ্যামলী । কিন্তু বাহ্যতঃ রামধুন বলে কেউ চট করে কিছু বলতে সাহস করবে না। গাইতে গাইতে বেশ ঝোঁক এসে গেল সকলের । ইতিমধ্যে ভীড় আরো বেড়ে গেল। শ্যামলীর সাথে গলা মিলিয়ে জনতা গাইছে “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / পতিত পাবন সীতারাম। “ রাম নারায়ণ মিশ্রের বাড়ির জানলা খুলে লোকজনেরা কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। বন্ধ থাকা বিরাট লৌহ কপাটের ছোটো গেট খুলে দারোয়ান এসে শ্যামলীকে গান থামাতে বললো । বলল যে বাড়ির লোকের অসুবিধে হচ্ছে । শ্যামলী মিষ্টি হেসে বললো সকালে ঠাকুরের নাম করা খুব ভালো। যে গায়, তার থেকেও যার কানে যায়, তার অনেক পুণ্য হয়। দেহাতি দারোয়ান রামভক্ত হলেও সে আন্দাজ করছিল এই রামধুন হঠাৎ রাম নারায়ণ মিশ্রের বাড়ির সামনেই করার পিছনে কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে শ্যামলীর । সে যতোটা সম্ভব ভাল ভাবে শ্যামলীকে বললো বাড়ির গেট ছেড়ে সরে যেতে । শ্যামলী বললো “ গান চলবে ।“ শ্রমিকেরা ধুয়ো তুললো “চলবে চলবে।“ জনতা ধুয়ো তুললো “চলছে, চলবে।“ দারোয়ানটিকে শ্যামলী বললো – “তুমিও আমাদের সাথে গাও ।“ শ্রমিকেরা বললো “গাও গাও।“ জনতা বললো – “ গাও গাও । তোমাকেও গাইতে হবে। “ দারোয়ান পালাতে পথ পায় না। সদর এঁটে , রাস্তার দিকের জানালা বন্ধ করে লোহা মাফিয়া রাম নারায়ণের বাড়ির লোকেরা পুলিশকে ফোন করলো। সমবেত জনতা সমস্বরে গেয়ে চলেছে “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / পতিত পাবন সীতারাম। “ অল্প বয়সী শ্রমিকেরা গানের তালে তালে নাচ করতে লাগলো । শ্যামলী তাদের উৎসাহ দিতে আরো গলা ছেড়ে গাইতে লাগলো “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / পতিত পাবন সীতারাম। “।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।