• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩১)

পর্ব – ১৩১

শেষ বিকেলে রমানাথ শ‍্যামলীকে বললেন, ছাতে গিয়ে নিরিবিলিতে একটু গল্প করবে?
শ‍্যামলী বলল, আমার ছাতে গেলেই গান গাইতে ইচ্ছে করে।
রমানাথ বললেন, বেশ তো, গাইবে।
শ‍্যামলী বলল, আমার একজন বন্ধু আছেন নেদারল্যান্ডস এর আমস্টারডাম শহরে।
রমানাথ বললেন, কে বলো তো, আমি কি চিনি?
শ‍্যামলী বলল, না এখানে ওই নির্দিষ্ট মানুষটা বিষয় নয়। তাঁর লেখা নিয়ে বলছি। উনি ওখানে গিয়েছেন ছবি আঁকতে।
রমানাথ বললেন, বেশ।
শ‍্যামলী বলল, ওই দেশের খুব নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন রেমব্রাণ্ট। কিন্তু সর্বকালের সেরা বুঝি ভিনসেন্ট ভ‍্যান গঘ।
রমানাথ বললেন গঘ? সেই কান কেটে ফেলেছিলেন?
শ‍্যামলী ম্লান হেসে বলল, ওই গঘের একটা ছবি ছাতে এলে আমার মনে উঁকি দেয়।
রমানাথ বললেন, কি ছবি?
 শ‍্যামলী বলল, স্টারি নাইট।
রমানাথ বললেন, রাতের তারা খচিত আকাশ?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ। মারা যাবার আগে একটা চিরস্মরণীয় আঁকা। গঘ তো মারা গেলেন ১৮৯০ তে। জুলাই মাসে। আর স্টারি নাইট আঁকলেন ১৮৮৯ এর জুন মাসে।
আজ কার্তিক মাস। শনিবার। শুক্লপক্ষের একাদশী। তাই চাঁদ যেন অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছে। খুব স্বাভাবিক। কেননা, কাছেই পূর্ণিমা। আজ চন্দ্র রয়েছে শতভিষা নক্ষত্রে। শুক্র রয়েছে জ‍্যেষ্ঠা নক্ষত্রে। শনিগ্রহ রয়েছে বিশাখা নক্ষত্রে। তো চাঁদ আমরা জানি পৃথিবীর একটা উপগ্রহ। কিন্তু আমাদের দেশের সেযুগের লোকজন চাঁদকে খুব গুরুত্ব দিত। ওই যে আকাশে অত বড় করে দেখা যায়। সাতাশ দিনের একটু বেশি সময়ে চাঁদ আকাশে নিজের পুরো গোল চেহারাটা মেলে ধরে। তো সাতাশ দিনে সাতাশটি নক্ষত্রের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে চাঁদ। অথচ নক্ষত্র কত বড়, আর কতদূরে।
রমানাথ অবাক হয়ে শোনেন। শ‍্যামলী বলে আমাদের শাস্ত্রে বলে যোগীরা রাতে ঘুমান না। মহাভারতের অর্জুন‌ও নাকি রাতে ঘুমাতেন না তাই ওঁর একটা নাম ছিল গুড়াকেশ। রাতের অপেক্ষা করে থাকেন সেরা জ‍্যোতির্বিজ্ঞানীরা। রাতের আঁধারে তারায় তারায় কি লেখা আছে তাঁরা পড়েন। তারপর রাত একসময় শেষ হতে যায়। তখনও সূর্য ওঠার অনেক দেরি। এমনকি তার লাল আভাটুকুও ফোটে নি, তখন একরকম আলো, ভারি আবছা একরকম আলো দেখা যায়। ওকে জোডিয়াক‍্যাল লাইট বলে। সূর্য আর গ্রহগুলির মাঝে যে মহাশূন্য, সেখানে অনেক গুঁড়ো গুঁড়ো অতি সূক্ষ্ম ধুলো থাকে। সৌর আলো তাতেই ঠিকরে উঠে ওই হালকা আলো আকাশে আঁকে। ভিনসেন্ট ভ‍্যান গঘ অ্যাসাইলামে থেকে অমন একটা প্রত‍্যূষের ছবি আঁকলেন। কিন্তু গঘের এই আঁকাটায়  চাঁদের আকার নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।
রমানাথ বললেন, তাই?
শ‍্যামলী বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটা গানে এ রকম লিখেছেন,
যখন এসেছিলে অন্ধকারে
চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥
হে অজানা, তোমায় তবে   জেনেছিলেম অনুভবে–
গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥
তুমি গেলে যখন একলা চলে
চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।
তখন দেখি, পথের কাছে
মালা তোমার পড়ে আছে–
বুঝেছিলেম অনুমানে
এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥
ভ‍্যান গঘ ভাল বেসেছিলেন একটা মেয়েকে। লণ্ডনের একটা মেয়ে। সে মেয়ে গঘকে পছন্দ করে নি। গঘের তখন মোটে একুশ বছর বয়স। ওই মেয়েটা পছন্দ করল না বলে খুব আঘাত পেয়েছিলেন গঘ। নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বেশি দিন তো বাঁচেন নি। সাঁইত্রিশ বছরের জীবন গঘের। মনোকষ্ট জটিল হয়ে উঠেছে টের পেয়ে নিজে নিজেই অ্যাসাইলামে ভর্তি হলেন। ওখানেই যে ঘরে থাকতেন তার পুবের জানালার দিকে চেয়ে চেয়ে  শেষ রাতের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। ওই হল স্টারি নাইট।
 রমানাথ শুনতে থাকেন। বলেন আরো বলো।
শ‍্যামলী বলল, রাতের আকাশ মানুষকে নিজের ভিতরে তাকাতে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,
রজনীর শেষ তারা, গোপনে
আঁধারে আধো ঘুমে
বাণী তব রেখে যাও
প্রভাতের প্রথম কুসুমে..
জানেন রমানাথ, ওই শেষ তারার কথাটা খুব মনে হয়। কতটা একলা হলে একটা মানুষ এ রকম করে ভাবতে পারে। ভ‍্যান গঘ‌ও যেন ওইভাবে ভাবলেন। অতোটা একাকিত্ব বুকে ব‌ইলেন।
রমানাথকে শ‍্যামলী দেখায়, ওই দেখুন, ওকে বলে সাঁঝতারা। ভোরে ওকেই বলবে শুকতারা। আসলে ও শুক্রগ্রহ। আজকের রাতে ওই শুক্রগ্রহ আছে জ‍্যেষ্ঠা নক্ষত্রে। ওই যে দেখছেন, ও হল বৃহস্পতি। আর ওই যে শনি।
রমানাথ আশ্চর্য হয়ে বললেন তুমি চিনলে কি করে?
শ‍্যামলী বললেন, শনি গ্রহকে মানুষ বহুদিন থেকে চেনে। কিন্তু তার ওই বলয় আর টাইটান নামে তার চাঁদ আবিষ্কার করেছেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস। আর শনি গ্রহের বলয় যে অনেকগুলো, সেটা বললেন জিওভান্নি দমিনিকো কাসিনি। ১৬৭১ সালে ল‍্যাপেটাস, আর ১৬৭২ এ রিয়া নামে শনি গ্রহের দু দুটো উপগ্রহ আবিষ্কার করেন কাসিনি। আর ১৬৮৪ তে টেথিস আর দিওন নামে আরো দুটো। রাতের পর রাত জেগে টেলিস্কোপ বাগিয়ে আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের সন্ধান করেছেন তাঁরা। ওই যে জোডিয়াক‍্যাল আলোর কথা বলছিলাম গঘের আঁকা বলতে গিয়ে, ওটা আবিষ্কার করেন কাসিনি। তখন ১৬৮৩ সাল।
 রমানাথ বললেন কতদূর থেকে আলো আসছে তাই না?
শ‍্যামলী বলল , আলো যে কিভাবে চলছে, সে নিয়ে আগে অনেক বিতর্ক হয়ে গিয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এর কথা বলছিলাম, ১৬৭৮ সালেই উনি আলোর ঢেউ এর মতো চলার কথা বললেন। ১৬৯০ সালে আলো চলার রকম নিয়ে ব‌ই লিখলেন ট্রিটিজ অন লাইট। লোকজন হাইগেনস এর কথা মানতে চায় নি। কেননা, আইজ‍্যাক নিউটন ওই সময়ই বলেছেন আলো কণা হিসেবে চলে। লোকজন নিউটনের কথাটা নিয়েছে। হাইগেনস এর কথা মানতে চায় নি। আলো নিয়ে কত ভাবনা বিজ্ঞান সাধকদের। কবিদেরও। যখন রবিঠাকুর বলেন,
দেখা না-দেখায় মেশা   হে বিদ্যুৎলতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে   একি ব্যাকুলতা ॥
     গগনে সে ঘুরে ঘুরে   খোঁজে কাছে, খোঁজে দূরে–
     সহসা কী হাসি হাস’;    নাহি কহ কথা ॥
আঁধার ঘনায় শূন্যে,   নাহি জানে নাম,
কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু   দুলিছে দুর্দাম।
     অরণ্য হতাশপ্রাণে   আকাশে ললাট হানে,
     দিকে দিকে কেঁদে ফেরে   কী দুঃসহ ব্যথা ॥
তখন কত কথা ভিতর থেকে উঁকি মারতে চায়।
এমন সময় কারা যেন হেসে পালিয়ে গেল।
শ‍্যামলী সচকিত হয়ে বলল, আচ্ছা, কারা হেসে উঠল?
রমানাথ বলল, কেউ না। ওরা আড়ি পাতছিল।
শ‍্যামলী বলল, কেন, আড়ি পাতার কি আছে?
রমানাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে র‌ইল। শ‍্যামলী বলল, এবার আমি বাড়ি যাই?
রমানাথ বলল, চলে যাবে?
শ‍্যামলী বলল, যাব না বুঝি? আমায় পড়তে বসতে হবে না?
নিচে যখন নামছে শ‍্যামলী, অল্পবয়সী কতকগুলি মেয়ে প্রশ্ন ছু়ঁড়ে দিল, আমাদের দাদাকে টিউশনি পড়ানো শেষ হল?
শুনে শ‍্যামলীর মুখটা ব‍্যথায় ম্লান হয়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।