তৃষ্ণা বসাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

*আমি বহুগামী, সাহিত্যে!

*আমার লেখা একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা

*পাঠক ভাবুক বা ছুঁড়ে ফেলে দিক

* কিছু বলব না বলেই লিখি

তৃষ্ণা বসাকের মুখোমুখি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

বিপ্লব গঙ্গোঃ কীভাবে এলেন লেখার জগতে? আপনার শুরুর সেই দিনগুলি
তৃষ্ণা বসাক- আসলে লেখক না হয়ে আমার কোন উপায় ছিল না। আমার বাবা একজন লেখক ছিলেন। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, পেশাগত ব্যস্ততার কারণে খুব বেশি লেখা হয়তো প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তাঁকে চোখের সামনে লিখতে দেখেছি। মোটা লম্বা পিচবোর্ডের খাতা ছিল তাঁর লেখার। সেটা দেখে আমার মনে হত এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আসলে আমি খুব বাবার ন্যাওটা ছিলাম তো। সবসময়ে তাঁর গা ঘেঁষে থাকতে চাইতাম। তাই বাবা যে কাজ করছে, সেটা তো আমাকে করতেই হবে। বাবার খাতায় বাবার কবিতার ওপর প্রথম লিখিত কবিতা লাল-নীল পেন্সিল দিয়ে- এক যে ছিল বাঁদর/ তার গায়ে ছিল চাদর- এই জাতীয় কিছু। অবশ্য তার আগে আমি মুখে মুখে ছড়া বানাতাম। প্রথম যেটা মনে আছে, একতলার টুকটুকে লাল মেঝের বারান্দায় গ্রিলের নকশা দিয়ে শীতের রোদ এসে পড়েছে, কোথাও আলো কোথাও ছায়া। আমি তার ওপর লাফাতে লাফাতে মুখে মুখে বানালাম-
আলোছায়ার সঙ্গে মোদের খেলা রে ভাই খেলা
আলোছায়ায় পা ফেলে ভাই কাটিয়ে দিই যে বেলা’
আর একদিনের কথাও খুব মনে পড়ে। বিকেলে মাঠে খেলতে যাচ্ছি, বন্ধুরা আছে, হঠাৎ আমার মাথায় এল সদ্য শেখা পরিচয় শব্দটা। আমার মনে হল শব্দ  ভাঙ্গা যায়, মাথায় কেবল খেলতে লাগল চয়, পরি চয়, পরি। সেদিনই কেমন মনে হয়েছিল আমি লেখক হব।
আমার প্রথম গদ্য বাক্য- সিমেন্ট কিনে আমাদের এবার খুব লস হয়েছে। একথা তো আপনাকে আগেও বলেছি। 
বাড়িতে মাঝে মাঝে এসব আলোচনা কানে আসত। তখনো বাড়ি ব্যাপারটা প্রোমোটাররাজের হাতে চলে যায়নি। বাড়ি হচ্ছে মানে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির থেকে থেকে সিটিং, চা, আড্ডা। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা গেরস্ত ছোঁয়া ছিল। কর্পোরেট হয়ে যায়নি।মাঝরাতে রাসমাঠে লরি এসে থামত, পাণ্ডুয়ার বালি নিয়ে। কখনো আবার রায়চৌধুরীদের আপত্তিতে রাসমাঠে ঢুকতে দেওয়া হত না লরি, সে নিয়ে কি উত্তেজনা।পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙত চায়ের কেটলি আর রোদের ঠোকাঠুকির আওয়াজে, ভেসে আসত মধ্যরাতের লরি, পাণ্ডুয়ার বালির কথা।রোদ, স্টোনচিপস, সিমেন্ট, বালি। এইসব শব্দ ঢুকে যাচ্ছিল আমার অক্ষরশরীরে। এরাই হয়তো প্ররোচিত করল ওইরকম একটা বাক্য লিখতে। সেই সপাট ঋজু গদ্য বাক্যটি আমাকে এখনও বিস্মিত করে। অথচ তারপর দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে গদ্য লিখি নি।
এরপর একটা মজার ব্যাপার হল। পাশের বাড়ির দিদি পাড়ার ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে একবার নাটক করিয়েছিল। একটা রূপকথার গল্প, যেখানে সত্য বলে এক রাখাল বালকের সঙ্গে এক রাজকন্যার প্রেম হয়।  প্রতিদিন বিকেলে গিয়ে খুব মন দিয়ে রিহার্সাল দেখতাম, বাগানের দিকের বারান্দায় সে নাটক অভিনীত হতেও দেখলাম।কিন্তু পছন্দ হল না একটুও। আমাকে কোন পার্ট দেওয়া হয়নি, সেটার জন্যে হতে পারে, কিন্তু সেটাই মুখ্য কারণ নয়। আমার মনে হয়েছিল, এর থেকে অনেক ভালো নাটক আমি লিখতে পারি। 
ব্যস, লিখতে শুরু করলাম। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার।একটি মেয়ে, সে আবার সমাজবিরোধী গুন্ডা, পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছে, তার এই পরিণতির জন্যে কারা দায়ী। আসল অপরাধী কারা? এরপর পুরো নাটকটাই ফ্ল্যাশব্যাকে। ভাবা যায়? আসলে পড়তে শেখারও আগে তো সিনেমা দেখার শুরু। আর এই ভালো গুন্ডা ও তার কৈফিয়ত সেই সিনেমাবাহিত হয়েই আমার মাথায় ঢুকেছিল নিশ্চয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আমি তখনো অভিশপ্ত চম্বল পড়িনি, কিংবা মেয়েমস্তান কেন্দ্রিক কোন সিনেমাও দেখিনি। আজকাল অনেকে বলেন আমি নাকি লেখায় বহুত মাস্তানি করি, সে হয়তো আমার আদিযুগের সেই নাটকটির প্রভাব!
অনেক ভালো জিনিসের মত সেই নাটকটিও হারিয়ে গেছে।
এরপর বহু বছর পর্যন্ত আমি শুধু কবিতাই লিখেছি। দত্তপাড়া থেকে ভারতদর্শন বলে একটি পত্রিকা বেরোত, আর স্কুল ম্যাগাজিন সুন্দরম- এই দুটো জায়গায় কবিতা বেরিয়েছে অল্প সল্প। গদ্য তখন তৈরি হচ্ছিল। সেসময় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ও ইংরেজি দুটোতেই অনেক প্রবন্ধ, ভাব সম্প্রসারণ, গল্প এসব লিখতে হত। সেসব আমি কখন রচনা বই থেকে লিখিনি। নিজে লিখতাম আর বাবার কিছুই পছন্দ হত না। একটু আলুলায়িত গদ্য দেখলে এমন বিদ্রূপ  করতেন যে সেই ট্রেনিং-এ আমার গদ্যে একটা ঋজুতা এসে গেল। এখনো সেটাই দেখেন। আমার গদ্যের শব্দ প্রায় নিক্তি মেপে লেখা। এটা যে আমি সচেতনভাবে করি তা না। ওই যে বললাম বাবার কঠোর ট্রেনিং। আর অবশ্যই প্রচুর প্রচুর বই পড়া আর শোনা। 
আপনাকে তো বলেইছি, অক্ষর পরিচয়ের আগে থেকে বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ পেয়েছি বাবার কাছে। চেকভ, মপাসা টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই। শুধু এঁদের সাহিত্য নয়, এদের জীবনও।
বাবার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। সাহিত্য সিনেমা, নাটক সব শিল্পের অন্দরমহলের গল্প এমনভাবে করতেন মনে হত চোখের সামনে দেখছি চরিত্রগুলোকে।আমি জীবনের মাত্র আঠেরো বছর বাবাকে পেয়েছি। উচ্চমাধ্যমিক দেবার দু মাস আগে হঠাৎই মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে বাবা চলে গেলেন। সরস্বতী পুজোর দু দিন আগে। আজো মনে আছে স্পষ্ট, মারা যাবার আগের দিন, একটা শীতের দুপুর, বিশে জানুয়ারি, ১৯৮৮ সাল, বাবা আমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন কালকূটের পৃথা। মা এসে বকছেন ‘এত ছোট মেয়েকে তুমি এসব কী পড়ে শোনাচ্ছ?’ বাবা বলছেন ‘ওকে আমি তৈরি করে দিয়ে গেলাম’ খুব সত্যি কথা। বাবা আমাকে প্রকৃতই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমি নিজে পড়লে এত বই আমার পক্ষে একজীবনে পড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।
বাবার মৃত্যু আমার জীবন র‍্যাডক্লিফের ছুরির মতো দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে গেল। আমার কবিতার স্বর বদলে গেল। সেই প্রথম মোড় ঘোরানো কবিতা পিতৃতর্পণ, যা বাবা মারা যাবার পরদিন বসে লিখি। দীর্ঘ কবিতা। মা সেটা লিখিয়ে দেওয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন
বাবা চলে যাবার পর আমি কবিতাকেই বেশি করে আঁকড়ে ধরলাম। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স। ডাক্তারি আর এঞ্জিনিয়ারিং –দুটোতেই পেয়েছিলাম। মা চাননি আমি হস্টেলে থাকি, তাই ডাক্তারি পড়া হল না।যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকলাম। আমি কোনদিন কোন সঙ্ঘে থাকিনি, কবিতা নিয়ে কফি হাউসে বসায় বিশ্বাসী ছিলাম না। বরাবর একা একাই থেকেছি। এর মধ্যে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমার পাশের বাড়ির এক দাদা, ভবানীদা, আমার ডায়েরি থেকে কবিতা টুকে দেশে দিয়ে এসেছিল, একদিন এঞ্জিনিয়ারিং -এর ফাইনাল ইয়ারে টাইমস অব ইন্ডিয়াতে  ইন্টারভিউ দিতে গেছি, এক বন্ধু বলল ‘তোর কবিতা দেশে বেরোচ্ছে এবার’ তখন চা দিয়েছিল। চমকে তো আমার চা টা পড়ে এক কাণ্ড। ১৯৯২ সালের ২০শে জুন আমার প্রথম কবিতা দেশে বেরোল। সামগন্ধ রক্তের ভিতরে। আর পয়লা জুলাই আমি ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে সরস্বতী প্রেসে যোগ দিলাম। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে পাওয়া আমার প্রথম চাকরি। কবিতা প্রকাশ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ভবানীদা দেশ সম্পাদকমণ্ডলীকে সম্ভবত ইম্প্রেস করতে চেয়েছিল একটা বাচ্চা মেয়ে কত ভালো কবিতা লেখে দেখিয়ে। তাই আমার নামের পরের লাইনে লিখে দিয়েছিল ২২+। সে নিয়ে নাকি দেশ দপ্তরে তুমুল হাসাহাসি হয়। সে কথা শীর্ষেন্দুদার মুখে পরে শুনেছি।কয়েকবার ডাকে পাঠানো কবিতা বেরোবার পর দেশ দপ্তর থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। শীর্ষেন্দুদা সবাইকে ডেকে বলেছিলেন ‘এই সেই তৃষ্ণা ভট্টাচার্য, ২২ +’ তখন আমি ভট্টাচার্য পদবীতে পরিচিত ছিলাম।  ১৯৯৭ পর্যন্ত সেইটা ছিল। সেসময় আনন্দবাজার অফিস এমন লোহার বাসরঘরের মতো ছিল না। ভেতরে গিয়ে আমার তো তারকাহতের অবস্থা। সুনীল শীর্ষেন্দু, জয় গোস্বামী, হর্ষ দত্ত। পাশাপাশি সানন্দা আনন্দমেলা প্রবাসী আনন্দবাজার। সেসব জায়গাতেও প্রচুর লিখেছি। এইসময় গল্পও লিখছি চুপি চুপি। একদিন সাহস করে রবিবাসরীয় আনন্দবাজার বিভাগে দিয়ে এলাম রমাপদ চৌধুরীর টেবিলে। সেটা বেরিয়েও গেল কয়েক মাসের মধ্যে। ১৯৯৫ সালে। ‘আবার অমল’যদিও এর আগে আমি গল্প লিখেছি, সেগুলো কোথাও পাঠাইনিআবার অমল গল্পটা একটা অদ্ভুত ধাক্কা থেকে লেখা। সেসময় আমি বরানগরে সরস্বতী প্রেসে চাকরি করতে জেতাম।বারুইপুর লোকাল ধরে শেয়ালদা, তারপর নর্থে ডানকুনি লোকাল ধরে বরানগর, অথবা মেন লাইনের ট্রেন ধরে বেলঘরিয়া নেমে অটোতেবারুইপুর লোকালে লেডিজে যেতাম। খুব মজা হত। আড্ডা, গান, তার মধ্যে আমার হাতে একটা বই ঠিক থাকত। সোনারপুর থেকে একটা মেয়ে উঠত, ছোটখাটো, খুব সাধারণ চেহারা, প্রাইভেট ফার্মে সামান্য চাকরি করত। তাকে দেখে আমি ভাবতাম অবিবাহিত,সদ্য কলেজ শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে। একদিন সে পার্স থেকে একটা বছর ছয়েকের  খুব সুন্দর দেখতে বাচ্চার ছবি বার করে দেখাল, বলল তার ছেলে। আমি তো হতবাক। পরে সে জানাল সে খুব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একটি রাজপুত্রের মতো ছেলে তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল বাড়ির অমতে। বছর দুয়েক সুখের সাগরে তাকে ভাসিয়ে একদিন হঠাত সে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। খুব জোরে বাইক চালাচ্ছিল বাইপাসে, হেলমেট ছাড়া। গতি ছিল তার প্যাশন। শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন সাহায্য পায়নি, বাপেরবাড়ির কাছেও তারা স্বাগত নয়। পড়াশোনাও সামান্য জানে। নিজের চেষ্টায় সে এই চাকরিটুকু জোগাড় করেছে, ছেলেকে স্কুলে ভরতি করেছে। তার ওপর রয়েছে একা মেয়েকে সহজলভ্য ভাবার উৎপাত। মেয়েটির আইশ্যাডো তার চোখের কালিকে ঢাকতে পারেনি। আমি কেমন একটা নাড়া খেয়ে গেছিলাম। জীবনের পরতে পরতে যে এমন কত বিস্ময়, ধাক্কা লুকিয়ে থাকে সেই প্রথম যেন উপলব্ধি করেছিলাম। সেই  গল্পটি আমার কথাকার জীবনের বীজ বপন করেছিল। মানে কথাসাহিত্য যে মানুষের কথা, তার আনন্দ বেদনা পরাজয় পরাভব, উত্তরণের কথা বলে-এই কথাটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এরপর আমার পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত করল দুটি গল্প। পতাকার দুটো রঙ আর সংখ্যালঘু। দুটোই বোধহয় দিবারাত্রির কাব্যে বেরিয়েছিল। আর প্রথম কবিতার বই – বেড়াল না নীলঘন্টা? ২০০২ সালে আর প্রথম গল্পের বই ছায়াযাপন ২০০৯ সালে বেরল। 

প্রশ্ন- নাটক দিয়ে আপনার লেখালেখি শুরু।পরবর্তীক্ষেত্রে নাটকে আপনাকে সেভাবে পেলাম না কেন ?
উত্তর-এটা ভালো প্রশ্ন। আসলে নাটক অভিনীত না হলে তার সার্থকতা কোথায়? অনেক নাটক লেখার কথা ভেবেও তাই পিছিয়ে এসেছি। একটা কল্পবিজ্ঞানের নাটক লিখেছি যদিও। গোল্লাছুট। ছোটদের জন্যে। সেটা কোন দল অভিনয় করলে বোঝা যেত আমার নাটকটা সত্যি উতরেছে কিনা। তবে এর মধ্যে রেডিওতে আমার একটি নাটক ‘উকুন’ বেজেছে, আরও দুটি রেডিও নাটক লেখা হয়েছে সিদ্ধার্থ মাইতির তাগিদে। একটি নাটক অপেশাদার একটি দল হয়তো করবে আগামী পুজোয়। অনেক পরিকল্পনা আছেসময় সুযোগ মতো নিশ্চয় লিখব। 

প্রশ্ন-আপনার প্রায় অধিকাংশ গল্পে চেতনে বা অবচেতনে পিতৃত্বের এক নির্মল ছায়া আছে আবার অমল থেকে যাও যাও গিরি। এই ছায়াযাপনের  মনস্তাত্ত্বিক কোন পটভূমি ?
উত্তর-এর উত্তর তো পেয়েই গেছেন। আমার জীবন আমার বাবার রচনা বলতে পারেন। বাবা খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। আমাকে ছোটবেলায় মজা করে বলতেন ‘সুন্দর বটে তব অংগদখানি তারায় তারায় খচিত’ গানটা নাকি রবীন্দ্রনাথ  বাবাকে নিয়ে লেখেন। সেটা আমি বেমালুম বিশ্বাস করেছিলাম। সেই বাবাকে হারিয়ে আমার জগত খান খান হয়ে গেছিল। আমার সারাজীবন তাই বাবাকে খুঁজে চলা। রাস্তায় কাউকে দেখে চমকে উঠি এখনো। সেইটাই হয়তো লেখায় ফিরে ফিরে আসে।

প্রশ্ন- গান আপনার গল্পে  উপন্যাসে একটি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। মাথুর নদীর নাম সাতকাহন থেকে শুরু করে অজস্র লেখায় কখনো  কখনো মনে  হয়েছে একটি সুর যেন  প্রোথিত আছে আপনার শিল্পীসত্তার গভীরে। শব্দ সুরের এই সমন্বয়। এর তাৎপর্য  কী?
উত্তর-নদীর নাম সাতপুকুর হবে। কখনো কখনো মনে হয় আমার শরীর একটা গান। জন্মের আগে থেকে গান শুনে চলেছি। দাদু বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী। মা অসাধারণ গায়িকা ছিলেন। লতা মঙ্গেশকরকে গুরু মানতেন। একলব্যের মতো। মা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও গান করতেন। সারাদিন গানের ঝরনা তলায় থাকতাম। সবধরনের গান শুনতাম। ক্লাসিকাল, রবীন্দ্র, নজরুল, কীর্তন, ফোক, গণসঙ্গীত, পপ। আর অনেকরকম গানের লোক আসত, কেউই যাকে বলে নাম করা, তেমন নয়। কিন্তু গানকে পাগলের মতো ভালবাসত। আমি খানিকটা ছেলেমানুষি জেদ করেই গান শিখিনি। দেখতাম মেয়ে দেখতে এসে সবাই গান শুনে মুগ্ধ হয়, তারপর বিয়ের পর মেয়েটির গান বন্ধ হয়ে যায়। এসব দেখে আমার গান শেখার প্রতি একটা অনীহা তৈরি হয়। আমাদের বাড়িতে বলা হত তানসেন না হতে পারো, কানসেন হও।সেটাই আমার হল। আমি গানের মধ্যেই থাকি। মিউজিক দিয়ে সত্যজিৎ রায় অনেক সিনেমার ক্লাইম্যাক্স তৈরি করেছেন। আমার মনে হয় সাহিত্যেও সেটা খুব সার্থকভাবে ব্যবহার করা যায়। 

প্রশ্ন-মেয়েদের কথা তাদের অন্তস্বর  তাদের সার্বিক রসায়ন  প্রযুক্তি থেকে আরম্ভ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর অবস্থানের কথা উঠে এসেছে আপনার কবিতায় গদ্যে গবেষনায় ফেমিনিজম আজ বহুচর্চিত বিষয়। ইকোফেমিনজ নিয়ে প্রচুর হৈ হট্টগোল  আওয়াজ। নারী স্বাধীনতা নিয়ে  অন্যন্য সাহিত্যিকদের (বিশেষত নারী বাদী  সাহিত্যিক) মতো আপনার মধ্যে কোন প্রগলভ প্রদর্শনী  নেই। এই নীরব এবং নিবেদিত কাজের কি যথার্থ মূল্যায়ন  হয়েছে ?
উত্তর-সারা পৃথিবীতেই দেখি শক্তিমানের পেশী প্রদর্শন আর দুর্বলের শোষিত হওয়া। একটা ক্ষমতার খেলা। টাকার, লিঙ্গের আধিপত্যকামী ব্যবস্থা। নারীর অবস্থা ভোগবাদী সমাজে আরও খারাপ হয়েছে, এত সরল নয় ব্যাপারটা। মেয়েরা নিজেরাই নিজের শরীরকে ব্যবহার হতে দিচ্ছে। আমার লেখায় যেমন সে কথা আসে। তেমনই অনেক প্রান্তিক পুরুষের কথাও তো থাকে। 
আমার কাজ লিখে যাওয়া। কারো মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে লিখি না, নিজের কমপালশন থেকে লিখি। কে প্রদর্শন করেন আমি বলতে পারব না। প্রকৃত কাজ সবসময়ই নীরব ও নিবেদিত। আমি আলাদা কিছু নই।

৬ 

প্রশ্ন-  কৃতি ইঞ্জিনিয়ার হয়েও অনেক দায়িত্বশীল পদে কাজ করেও  নিজের দক্ষতা দেখিয়ে সফল হয়েও  এক সময় কেন মনে হল সাহিত্যের জন্য পুরোপুরিভাবে  নিজেকে নিবেদন করা দরকার ? স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে আপনার কি মনে হয়েছে এতে সাহিত্যের জন্য আপনার দায়বদ্ধতা বেড়েছে? না কি দুটো পাশাপাশি  চালিয়ে গেলেই ভালো হত?কোন অনুশোচনা?
উত্তর-চাকরি তো আমি বহুবার ছেড়েছি। প্রথমবার একটা সরকারি প্রেসে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ছিলাম। সেই প্রেসে ছিল একটা বিশাল লাইব্রেরি। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাক ধরে ধরে বই পড়তাম। সমারসেট মম, ফ্রয়েড, হেমিংওয়ে। একদিন সারারাত জেগে সমারসেট মমের মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স পড়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর তো আরও কত অর্থকরী পেশা ছেড়েছি। ২০১৩ তে সাহিত্য অকাদেমি ছাড়ার পর থেকে পুরো সময়ের লেখক। সাহিত্যের জন্য দায়ব্দধতা বেড়েছে বা কমেছে এই প্রশ্নটাই আমার কাছে অবান্তর। মাছ কি তার চারপাশের জলকে নিয়ে এসব ভাবে?এটা ঠিক যে আমি আমার পেটের ভাতের জন্যে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, এছাড়া  আমার আর কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু লোকজনের আমাকে নিয়ে সমস্যা হয়। সরকারি চাকরি ছেড়ে লিখছি শুনে তারা আমার কপালে কেউটে সাপ কামড়েছে ভাবেন, পাগল ভাবেন দুটো  একসঙ্গে চালানো যায় না। আমার মনে হয় লেখা একটা ফুল টাইম কাজ। আমি শখের লেখক নই, পিঠ চাপড়ানো পাব বলেও  লিখি না। পরিশ্রম করে লিখি এবং পারিশ্রমিক দাবী করি। স্বপ্ন দেখি বাংলায় সাহিত্য করা একটা পেশা হয়েছে যা থেকে লেখকের গ্রাসাচ্ছদন চলছে। অনেকেই হাসবেন এটা শুনে, কিন্তু এই স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, ঘুমোতে দ্যায় না। 

প্রশ্ন-আপনার গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের সমাবেশ। সমাজের উপরিতল থেকে প্রান্তিক জনসমাজ। বিবিধ স্তর এবং তাদের মানসিক অবস্থানের ভিন্নতা। এত মানুষের অন্তর্নিহিত মনোরসায়ণ। কীভাবে লেখেন ? পর্যবেক্ষণ  নাকি তাঁদের সাথে আত্মিক অন্বয়ের  ফলশ্রুতি।
উত্তর-সাহিত্যের মূল কথা সমানুভূতি। যাদের কথা লিখছি তাদের সঙ্গে একাত্মবোধ না করলে, তাদের বাড়িঘর, বারান্দায় আসা রোদ, তাদের খাওয়া খাবারের স্বাদ নিজের জিভে বুঝতে না পারলে তাদের নিয়ে লেখা উচিত নয় আমি মনে করি। 
পারিবারিক সূত্রে, বিশেষ করে মায়ের জন্যে আমি ছোটবেলা থেকেই বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। মা খুব মানুষদের আপন করে নিতে পারতেন। তারা বেশিরভাগই প্রান্তিক মানুষ। কেউ হয়তো সেলুনে চুল কাটে, কেউ মুসলমান দুধওয়ালি, কেউ ভিক্ষা করে, কেউ মাতাল, কেউ চোর। মানবসমুদ্রে অবগাহন এইভাবে হয়ে গেছিল। হয়তো সেই কারণে লেখায় একটা অরগ্যানিক ভাব থাকে। 

প্রশ্ন-বিচিত্র বিষয় এমনকী নির্বিষয়ী চিন্তাসূত্রও আপনার গল্পের  নিউক্লিয়াস হয়ে ওঠে কীভাবে একটি গল্প আপনার কাছে আসে এবং এর সাথে আপনার  চিন্তার সংশ্লেষণই বা  কীভাবে ঘটে ?
উত্তর-আমার কাছে বিষয় মানে কোন ঘটনা না, একটা চিন্তার ঝলক আসে, সেই চিন্তাটাই বিষয়কে খুঁজে নেয়। চিনির কেলাস যেমনভাবে তৈরি হয়, সেইভাবে একটু একটু করে উপাদান জমতে থাকে। এটা  কী করে হয় জানি না। হয়তো দুহাজার শব্দের একটা গল্প আমার লিখতে ছমাস লাগতে পারে। তার মানে এই নয় যে আমি খুব আস্তে আস্তে লিখি। এক একটা লেখা ওইরকম সময় নেয়। আসলে আমার লেখা তো একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা। তার খিদে তৃষ্ণা আছে, নিজের জীবন আছে। সে কতটা সময় নেবে, কোথায় যাবে আমি জানি না। আমি জাস্ট একটা মিডিয়াম। লেখাটাই নিজেকে লেখে। তবে যাতে সেই  ঠিক লেখাটা আমার কাছে আসে, সেটার জন্যে আমি মনকে কিছু ট্রেন করতে চেষ্টা করি। নিজের খুব গভীরে একটা কুয়োতলা আছে। সেখানে চুপ করে বসে থাকতে হয়, অন্য যা কিছু বাড়তি, যা কিছু আমাকে দিকভ্রষ্ট করবে তার দিকে মনকে যেতে দিই না। আমি অনেকটাই মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়া তাঁতীর মতো, আমার অন্য কিছু কারার উপায় নেই।গল্প যেভাবে আসে তার একটা ছোট উদাহরণ দিই। একদিন খবরের কাগজে একটা ছোট খবর ছিল। বলা হয়েছিল ফ্লাইং সেক্স ওয়ার্কারের সংখ্যা বাড়ছে। এই ফ্লাইং শব্দটা থেকে আমার মনে হল এই উড়ন্ত অবস্থান কত অনিশ্চিত, হঠাৎই ফিজিক্সের একটি তত্ত্ব মনে পড়ল-হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব, যাতে বলা হয়েছে চলন্ত কোন বিন্দুর গতি আর অবস্থান একসঙ্গে বলা সম্ভব নয়। এইসব মিলিয়ে গল্পটা গড়ে উঠল।কারখানা থেকে অসুস্থতার জন্যে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়া এক বইমগ্ন শ্রমিক, যার স্ত্রী এমন ফ্লাইং সেক্স ওয়ার্কারের কাজ করতে রোজ বিকেলের ট্রেনে মফস্বল থেকে কলকাতা আসে আর রাতের শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরে। কি ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা তার যাপনে। এইভাবে গল্পটা তৈরি হল।  

প্রশ্ন-ধুলোমুঠি  যা পরবর্তীক্ষেত্রে বাড়িঘর উপন্যাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আপনার প্রথম উপন্যাস। এর প্রেক্ষিত যদি বলেন।  
উত্তর-ধুলোমুঠি আমি লিখি ২০০২ সালে বেশ কয়েক মাস ধরে টানা। সেইসময় আমার মেয়েকে গর্ভে ধারণ করছিলাম। ডাক্তারের নির্দেশে পুরো বেড রেস্টে ছিলাম। ওই নিরবচ্ছিন্ন অবসরের ফসল ধুলোমুঠি। যেমন আবার অমল, তেমনই এর কাহিনীটাও একটি মেয়ের মুখে শুনে খুব ধাক্কা লাগে, যার সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল। ছেলেটির ক্যানসার হয়েছে সেটা লুকিয়ে। আমি ওইটুকুই নিয়েছিলাম, আপনি জানেন এই কাহিনীর আরও অভিমুখ আছে। আরেকটি পুরুষ চরিত্র আছে, এক প্রৌঢ়, তার নিরাশ্রয়তা, গার্হস্থ্য হিংসা, প্রেমের ছকভাঙ্গা রূপ, এবং বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাস। ২০০২ তে শুরু হলেও শেষ করি ২০০৬ সালে। একুশ শতকের পুজো  সংখ্যায় ওরা একটা উপন্যাস চায়। সেই তাগাদায় শেষ হয়। আমার প্রথম উপন্যাস। যা গ্রন্থাকারে বেরোয় বোধহয় ২০১০ সালে।  

১০

প্রশ্ন-পরে তো বেশ কিছু উপন্যাস লিখলেন অনুপ্রবেশ  এখানে টাওয়ার নেই চরের মানুষ যেখানে হাংরি মুভমেন্ট থেকে সমকালীন  ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব পর্বান্তর এসেছে কখনোও কি মনে হয় না এই স্বল্প পরিসরে আপনি যা বলতে চাইছেন তা বলতে পারছেন না আরও  অনেক কথা বলা দরকার যা সুদীর্ঘ উপন্যাসে ছাড়া বলা সম্ভব নয় ?
উত্তর- এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে চরের মানুষ অনেকটাই বড়, অবশ্য আমি এর চারটি পর্ব ছ বছর ধরে লিখেছি। ২০১৩ থেকে ২০১৯।
যদিও দৈর্ঘ্য দিয়ে উপন্যাসের বিচার হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না।কিন্তু এটাও ঠিক, কিছু লেখা অনেকখানি জায়গা দাবী করে। ইতিহাসের বিশেষ কিছু অধ্যায় নিয়ে কাজ করতে চাই, একটা অ্যাডাল্ট কল্পবিজ্ঞান লিখতে চাই।একটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উপন্যাস শুরু করেছি, আমার বয়সভর এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে। একটা গল্প বেওয়ারিশ, পড়েছেন কিনা জানিনা, ওটা ছিল শিল্পের দুর্দশা নিয়ে, আর এই উপন্যাসে আমি শিক্ষাজগতটা ধরবার চেষ্টা করছি। মহাভারত নিয়ে একেবারে সাধারণ প্রান্তিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা কাজ করছি।

১১

প্রশ্ন- বেড়াল না নীলঘন্টা আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আপনার কবিতায় এবং গল্পে বেড়ালের বিভিন্ন অনুষঙ্গ  এসেছে। এর কি বিশেষ কোন তাৎপর্য  আছে ?
উত্তর-কে জানে! কবিতার বিশ্লেষণে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। ওই সময় একটা বেড়াল আমাকে খুব অনুসরণ করত, একদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখেছি ও খাটের হেডস্ট্যান্ড থেকে আমার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ওকে দেখলে আমার কেমন যেন গা ছমছম করত। কী যেন রহস্য আছে, ক্রমে মনে হল, ও হয়তো এই ছকবাঁধা জীবনের বাইরে যে অপার রহস্যময়তা, তার ডাক দিচ্ছে আমাকে। অসীম অনন্তের ডাক, বেড়ালের তো নটা জীবন, সেই নাছোড় জীবনের ডাক দিচ্ছে। বেড়াল না নীলঘন্টা? আমার প্রথম বই, একুশ শতক থেকে  বেরোয় ২০০২ এর অক্টোবর। এর দুমাস পরে আমার মেয়ে হল। আমার মেয়ের নাম (সৌতি) রেখেছিলেন শিল্পী ও কবি শ্যামল জানা, আর কবিতার 
বইটির প্রচ্ছদও তাঁর করা।

১২ 

প্রশ্ন-কবিতা গল্প উপন্যাস অনুবাদ প্রবন্ধ আলোচনা এবং শিশুসাহিত্য সাহিত্যের বিভিন্ন ভূমিতে আপনার বিচরণ এতে আপনার কাজের এবং মনোনিবেশের কোন ক্ষতি হয় কি? নাকি এই বিভিন্নতা আপনার ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে। 
উত্তর-বিপ্লব, আমি বহুগামী, সাহিত্যে! যেগুলি বললেন, সেগুলি লিখতে ভালো লাগে বা পারি বলেই লিখি। কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী সেভাবে পারিনা। আপনার মতো রিভিউও পারি না। আমি শুধু এতরকম লেখা লিখি তাই নয়, একইসঙ্গে আমার একাধিক গল্প, একাধিক উপন্যাস, একাধিক প্রবন্ধ লেখা চলে, অনেকটা কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পীদের মতো কাজ করি। কোন প্রতিমার হাত, কোনটার মুখ গড়ে রেখে দি, যে তাড়া দ্যায় তারটা আগে শেষ করি। আর তাগাদার বাইরের  লেখাগুলো নিজের ছন্দে চলে। এইভাবেই লিখতে আমার ভালো লাগে। একটা লেখা নিয়ে আমি থাকতে পারি না। 

১৩

প্রশ্ন-অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আপনি প্রচুর কাজ করেছেন। সাহিত্যের কি যথার্থ অনুবাদ সম্ভব ? অনুবাদের মধ্য দিয়ে  বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির সাথে বাংলার এই যে সমন্বয় এতে আমাদের সাহিত্য কতখানি পরিপুষ্ট  হচ্ছে ?
উত্তর-সাহিত্যের অনুবাদ কখনোই পুরোটা হবে না, মূল ভাষার সুবাস কিছুটা হারিয়ে যাবেই এটা ধরে নিয়েই এগোতে হবে।কারণ অনুবাদ আমাদের দ্বিতীয় ভাষাবিশ্বের অংশীদার করে, এটা মস্ত লাভ। সীমন্তহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আমরা কলকাতা ট্রান্সলেটর ফোরাম করেছি। একটা খেদের কথা, অনেক বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ বাংলায় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভারতীয় ভাষা থেকে প্রায় কিছুই হচ্ছে না। আমি এই জায়গাটায় কিছু অনুবাদের চেষ্টা করছি, মূলত মৈথিলী আর মালয়ালম ভাষা থেকে।

১৪

প্রশ্ন-গল্প নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা  হয়েছে। শাস্ত্রবিরোধী গল্প লেখা হয়েছে একসময়। এই এক্সপেরিমেন্ট সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতখানি জরুরি
আজকের সাহিত্যের অভিমুখ নিয়ে কিছু কথা জানতে চাই।  আপনি সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে তার সম্ভাবনা নিয়ে কীরকম আশাবাদী ?
উত্তর-পরীক্ষানিরীক্ষা সবসময়ই স্বাগত, তবে ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলাবার চেষ্টা ভালো নয়, একটা লেখা পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলবে, তার কমফোর্ট জোন থেকে বার করে নিয়ে যাবে, সেটা জরুরি।
এই তো আপনি খুব ভালো লিখছেন, কবিতা গল্প উপন্যাস সবই সমান দক্ষতায়, আরও অনেক তরুণ মুখ উঠে আসছে। আমি আশাবাদী।

১৫

প্রশ্ন- কেন লিখতে এলেনঅন্য আরও  অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও   শেষ প্রশ্ন সেই গল্প বা উপন্যাস যা লেখার স্বপ্ন আপনি লালন করেন প্রতিনিয়ত। তার ভাবনা এবং বিচ্ছুরণ  যৎসামান্য যদি বলেন
উত্তর-লিখতে এলাম কারণ আমি অন্য কোন কাজ পারি না বা অন্য কোন কাজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই না, লেখায় যেমন পাই। এমন নয় যে আমি কিছু বলব বলে লিখি। আমি আসলে কিছু বলব না বলে লিখি। আমি যেভাবে নিজেকে আবিস্কার করতে করতে যাচ্ছি, সেই ইশারাগুলো পাঠকের জন্যে রেখে যাই। পাঠক সেই নিয়ে বলুক, ভাবুক বা ছুঁড়ে ফেলে দিক। পাঠকই আমার ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরের ভরসাতেই এতগুলো বছর ধরে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় না থেকেই লিখে যেতে পারছি। আমি এখন বিশ্বাস করি আমি কোথায় লিখছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কী লিখছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। 
একটা বিশেষ পিরিয়ড নিয়ে কাজ করতে চাই। আপাতত এটুকুই বললাম। আবার কথা হবে। 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়-অনেক অনেক ধন্যবাদ। সফল  পূর্ণ হোক আপনার প্রতিটি স্বপ্ন
তৃষ্ণা বসাক- আপনাকেও ধন্যবাদ। এত কথা বলিয়ে নিলেন। আপনি ভালো থাকবেন। আরও ভালো লিখবেন- এই কামনা করি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।