শুনেছি ‘ক’ বলতে গিয়ে বালক নিমাই কেঁদে ভাসাত। সেই থেকেই হয়তো বাঙালি শিশুর অক্ষরপরিচয় একটা অশ্রুসজল, সামাজিক পালা হয়ে গেছে।মনে পড়ে ফুলেশ্বরী সিনেমার সেই অসাধারণ দৃশ্য। অনুপকুমার তাঁর বালক পুত্রের সঙ্গে নানান কসরত করছেন দেখে খানিকটা ভয় পেয়েই শমিত ভঞ্জ জিগ্যেস করেন – হচ্ছেটা কী? উত্তরে অনুপকুমার একগাল হেসে বলেন – ক-র আঁকড়ি টানা শেখাচ্ছিলাম!
আসলে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে এবং বাড়িতেও সেসময় অক্ষরপরিচয়টা যেভাবে করানো হত, তাকে ঠিক বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না। এর ফলে অনেক সময় হত কি, শিশু একটি অক্ষরে আটকে থাকত তো থাকতই। বিশেষ করে বাংলা অক্ষরের ক্ষেত্রে। আর বাবা-মার সেই বিপদের দিনে, পরিত্রাতা হয়ে আসতেন আত্মীয়, পড়শি, বন্ধু, অফিস কলিগ –কে নয়? আমার ক্ষেত্রে সেই পরিধিটা আরো বিস্তৃত ছিল। যেহেতু বাড়ি জিনিসটা কেবল হতে থাকে, হতেই থাকে, তাই আমার শিক্ষাদীক্ষার আদি যুগে, ব র্ণপরিচয়ের প্রথম স্থপতি যারা, তারা আমাদের বাড়ি বানাতে আসা রাজমিস্ত্রি ও মজুরের দল। অনেকগুলি অক্ষর রপ্ত করাতে তাঁদের অবদান অপরিসীম। লেখকের কাজ যে রাজমিস্ত্রির, অক্ষরের ইঁট গেঁথে গেঁথে কাহিনীর সিমেন্ট দিয়ে বেঁধে, কল্পনার রং চড়িয়ে যে কথাবস্তুর ইমারত বানাতে হয়, সেই বোধটা সেই বয়সেই চারিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। আমার জীবনের বেশিরভাগ শিক্ষাই এসেছে এই তথাকথিত অশিক্ষিত এবং আক্ষরিক অর্থে নিরক্ষর মানুষদের কাছ থেকে।
বাবার এক ছোট মাসী আসতেন গোবিন্দপুর লাঙলবেড়ে থেকে।তাঁর স্বামী পুরুতগিরি করে বৃহৎ একটি সংসার চালান। দারিদ্র্য নিত্য সঙ্গী। সেই ছোটদিদা একবার কারো মৃত্যু সম্পর্কে বলেছিলেন –আজ মরলে কাল দুদিন।
এমন নিস্পৃহ মৃত্যুচেতনা সত্যি আর কথাও পাইনি। এর সঙ্গে কি অবলীলায় মিশে যান রামপ্রসাদ-
‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে
তুমি ভুলো না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে
যার জন্যে মরো ভেবে
সে কি তোমার সঙ্গে যাবে?
সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া অমঙ্গল হবে বলে’
জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে এত কম কথায় আর কারো মুখে শুনিনি।এইভাবে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে সব্জিমাসীদের কাছ থেকে পেয়েছি লৌকিক মহাভারত, রাতের ফাঁকা ট্রেনে জি আর পি দের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়েছে কাজের মাসী, হিজড়ে দিদিরা হাতের মোটা বই দেখে খুব আদর করেছে।
ছোট থেকেই বাড়িতে এইরকম নানান হাটুরে জনের যাওয়া আসা। এখনকার গেরেম্ভারি ভাষায় যাদের বলা হয় প্রান্তিক। তবে আমার শিক্ষাদীক্ষার বিষয়টা পুরোপুরি তাদের হাতে ছেড়ে না রেখে বাবা-মা আমাকে একটা স্কুলে ভরতি করালেন। তার নাম আনন্দময়ী পাঠশালা।
এইরকম চারদিকে হাওদা খেলা স্কুলে পড়ার কতিপয় সুবিধে আছে যা এখনকার বিখ্যাত স্কুলগুলো দিতে পারে না।
যেমন ধরা যাক গরুর রচনা কখনোই মুখস্থ করতে হত না।আমার জানলামুখী বিদ্যেয় আমি বরাবর মাঠে চরা গরু দেখে দেখে গরুর রচনা লিখেছি, টুকেছিও বলা যায়। এক লাইন লিখতাম আর মিলিয়ে নিতাম। গরুর চারটে পা, হ্যাঁ ওই তো চারটে পা। পায়ে খুর আছে, হ্যাঁ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।একটি লেজ, ওই তো মাছি তাড়াচ্ছে। তবে বিজ্ঞান তখন এত উন্নতি করেনি, তাই জানা ছিল না গরুর দুধে সোনা পাওয়া যায়! ওই পয়েন্টটা মিস করে গেছি।
দ্বিতীয় সুবিধেটা বোঝা যেত আনসিন কিছু এলে। যেমন একবার সাধারণ জ্ঞানে প্রশ্ন এল আনন্দময়ী পাঠশালা কত সালে স্থাপিত? সবাই পেন্সিল চিবোচ্ছে আর আকাশপাতাল ভাবছে। আমার ধাঁ করে মনে পড়ে গেল বাইরের দেওয়ালে কয়েকটা সংখ্যা উৎকীর্ণ দেখেছি। অমনি জল খাওয়ার নাম করে দিব্যি দেখে এসে লিখে দিলাম। কাঁধে বাহারি জলের বোতল ঝোলানো বালক বালিকার দল জানে না তারা কী হারাইয়াছে!
এই হচ্ছে আনন্দময়ী পাঠশালা,
যেখানে বিদ্যে হবে কাঁচকলা
বেঞ্চিগুলো সরু সরু
মাস্টারগুলো আস্ত গরু
ক্যানিং রোড পার হয়ে নীলক্ষেত। এখানে আগে নীলকুঠি ছিল, একসময় সার্কাসও বসত। পরে রাসমাঠে সার্কাস বসতে শুরু করে, এখনও অব্দি তাই চলে আসছে। নীলক্ষেতে ফলসা লিচুর জঙ্গল দিয়ে টিনের সুটকেস ঢকঢক করতে করতে স্কুলে যাই। বিখ্যাত বয়েজ স্কুলের বিশাল অট্টালিকার পাশে ছোট্ট ইঁট বার করা দোতলা। সামনে মাঠ, পেছনে পুকুর। স্কুলে যত যাই, পালাই তার থেকে বেশি। আজ বাবা ট্যুর থেকে ফিরেছে, কাল পায়ের ব্যথা-নানা অজুহাতে পালিয়ে আসি। যাওয়ার সময় দল বেঁধে গমগম করতে করতে গেছি সমস্বরে ছড়া কাটতে কাটতে- ইস্কুল বসে গেছে/নামডাকা হয়ে গেছে, ফেরার সময় একা দলছুট। খাঁ খাঁ দুপুর। দোকানীরাও দোকানপাট বন্ধ করে বাড়িতে খেতে গেছে। কী একটা অচেনা হাওয়া আমায় ঘিরে ধরে, বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ ( এ তো ওয়াটার বটল সংস্কৃতির আগের যুগের কথা)। কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দ এই একা একা ফেরার।সেই নির্জন দুপুরগুলো হয়তো আমার ভেতরে অনেক ভাঙচুর করছিল।
পালিয়ে আসার হার যখন বেড়ে গেল, বাড়ির লোকের টনক নড়ল। নাহ, এবার একটা শক্ত হাতে দিতে হবে। ডাকা হল পূর্বপরীক্ষিত, কড়া মাস্টারমশাইকে, যাঁর নাম সরল।পদবী এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এঁর কড়াত্বের পরীক্ষা আগেই দাদার ওপর দিয়ে হয়ে গেছে। তার জন্যে যখন তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল, প্রথম দিনই সে বালক সপাটে এক চড় খেয়েছিল। কারণ মাস্টারমশাই পড়াতে আসার পরেই সে একগাল হেসে বলেছিল
‘যাক ভালোই হল মাসশাই।‘
মাস্টারমশাইয়ের বিস্মিত প্রশ্ন ‘কী ভাল?’
‘না, আপনি তো আমার স্কুলেই পড়ান, এখন থেকে বাড়িতেও পড়াবেন। আর আমাকে পরীক্ষার সময় আগে থেকে সব প্রশ্ন বলে দেবেন আর আমি ফার্স্ট হব!’
ছাত্রের এ হেন সারল্য সরল মাস্টারমশাই নিতে পারেননি।তাই সপাটে থাপ্পড়। সেই কাহিনী শুনতে শুনতে বাস্কারভিলের জলাভূমিতে হাউন্ডের প্রবাদের মত আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যেত।তাই প্রথম দিন থেকেই বাঘের গুহায় ভেট পাঠানো ছাগলছানার মত থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পড়তে বসি। সকাল সাড়ে আটটা থে সাড়ে নটা –সময়টা যেন রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির পাতা থেকে হুবহু উঠে আসা। সেই চরাচর মুছে দেওয়া বৃষ্টি,কম্পিত হৃদয় বালকের আশা, আজ বুঝি মাস্টারমশাই আর আসতে পারবেন না। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, তার সব আশা এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়ে গলির মুখে ছাতা মাথায় মাস্টারমশাইয়ের সুপরিচিত মূর্তিটি। হায় এরকম আমার কতবার হয়েছে। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে আটটায় মাস্টারমশাই ঢুকতেন, যদি কোনদিন একচুল কাঁটা এগিয়ে যেত, জানলা দিয়ে রাসমাঠের দিকে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে আছি।আজ যেন না আসেন, আর তখনি দেখতাম শীত গ্রীষ্ম বরষা উপেক্ষা করে তিনি হেঁটে আসছেন এ বাড়ির দিকে।
আমাকে মারার কোন দরকার পড়েনি। বকুনি খেয়েছি বাড়তি টাস্ক করে রাখার জন্যে! এই ঘটনাও পৃথিবীর ইতিহাসে আর ঘটেছে কিনা জানা নেই। আমার দুর্গতি দেখার জন্যে নিচের ভাড়াটেদের দুই নিষ্ঠুর শিশু (শিশুদের মত নিষ্ঠুর খুব কমই হয়) জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, মাস্টারমশাই তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ গোলগোল করে যেই বলতেন ‘বাঘের চোখ দেখেছিস?’ অমনি দুদ্দাড় দৌড় দিত।
পরে একবার এক বন্ধু বলেছিল তাদের ক্লাসের কোন এক নিরীহ অতি নরম মনের মাস্টারমশাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে তারা বলেছিল ‘বাব্বা, জানিস, অমুক স্যার কি কড়া!’
শুনে খুব আহত হয়েছিলেন সেই স্যার। তাদের ডেকে বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলেছিলেন ‘আমাকে কড়া স্যার বললে তোমরা!’ সরল মাস্টারমশাইকে এমন কিছু বললে কী ঘটত তা কল্পনা করলেও আমার হাড় হিম হয়ে যায়। হায়, সরল মাস্টারমশাই যদি জানতেন, অনেক বড় হয়ে যাবার পরেও তাঁকে দূর থেকে আসতে দেখলে ধাঁ করে অন্য রাস্তায় ঘুরে গিয়েছি কতবার। দু মিনিটের পথ, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অজানা অচেনা জটিল গলিপথ ঘুরে আধঘণ্টায় ফিরেছি, কখনো কখনো যেখানে ফেরার, ফিরতেই পারিনি!