জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ১২)

মায়া – মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ১২

রং-ঢং

মাহিনগর মালঞ্চ, অ্যাটলাসের মোড়। এখানে একটি বাড়িতে মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে নিয়ে যেত মা। একটা উঠোন ঘিরে ছড়ানো বাড়ি, গৃহস্বামী আলিপুরে চাকরি করেন, তাঁকে দাদু বলি আর তাঁর কাছে বড় এলাচ খাবার বায়না করি। তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে, তাদের কাকা পিসি বলে ডাকি। সেই বাড়ির পেছনে বিশাল বাগান, সেখানে গেলেই বালক-বালিকার একটি দল তৈরি হয়ে যায়, গাছ থেকে জামরুল, কুল পেড়ে খাওয়ায় যাদের জুড়ি নেই।  অতি উৎসাহে কতবার পিঁপড়েসুদ্ধ জামরুল খেয়ে ফেলি। এক কাকু পেছনে মৌমাছি চাষ করেছেন, মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করার পর একটু ভেঙে খেতে দেন, সে এক স্বর্গীয় আনন্দ। এ বাড়ির উল্টোদিকে বিশাল পাঁচিল ঘেরা স্বার্থপর দৈত্যের বাগানের মতো বাগান। লোকে বলে মালীর বাগান। সেখানে সদর গেট দিয়ে নয়, পেছন দিকের  পাঁচিলের ফোকর গলে ঢুকেছি বরাবর। আর ডালকুকুরের মতো মালীর তাড়ায় ওখান দিয়েই পালিয়েছি । এসে দেখতাম খুকুপিসি লুচি করে রেখেছে। সঙ্গে বেগুন, আলু দিয়ে একটা অপূর্ব স্বাদের তরকারি, যার গোপন মশলা আজো খুঁজে পাইনি। খুকুপিসি সবার বড় হয়েও বিয়ে হয়েছিল সবার পরে, মেজ রেবিপিসি অনেক আগেই গিন্নিবান্নি, তার বর নরুমেসোর গলা কাঁপানো দেবতার গ্রাস আবৃত্তির কথা মনে আছে আজো। আর সবার ছোট রেখিপিসি, আমার দেখা প্রথম ফ্যাশনিস্তা, অনেক ভেবে যার বাংলা করেছি ঢঙী। তাকেই  প্রথম দেখেছিলাম চুলে রুমাল বাঁধতে, আর অসাধারণ একটা মেরুন রঙের টিপ পরত (সেই বিখ্যাত রেখা-মেরুন) রেখিপিসি, আমাকে চুপিচুপি বলেছিল পোস্টকার্ড পুড়িয়ে ছাই করে, সেই ছাইয়ে সিঁদুর মিশিয়ে নাকি টিপটা তৈরি করা।
হায়, পোস্টকার্ড তোমার দিন গিয়াছে! আর পোস্টকার্ডের ছাই দিয়ে বানানো টিপ পরে রেখিপিসি যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায়, বিশ্বায়িত বাজারে কলকে পাবে কিনা সন্দেহ। তবে সেই সময়ে, বহু উচক্কা যুবকের বুক ছাই করে দিয়েছিল সে তার উদ্ভাবনী ফ্যাশনবোধ দিয়ে।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় মলিনা দেবী, তাঁর প্রতিবেশিনী  স্বামী ভোলাতে একটু সাজগোজের পরামর্শ দিলে, জবাবে খানিকটা অসহায়মুখ করেই বলেছিলেন ‘যৌবনের রং-ঢং আর আসেনা ভাই’। সংলাপটা মনে পড়লেই ঢং করে ঘণ্টা বাজে স্মৃতির গুমঘরে। এই ঢং শব্দটা যে কতদিন শুনি না। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন ঢং চারদিকে ঢংঢং করে বাজত। আমরা ইস্কুলমাঠে ছড়া কাটতে কাটতে খেলতাম
‘ঢঙী ঢং করে
ঢঙী কচুপাতায় রং করে
ঢঙীর কানে নেই দুল
ঢঙীর মাথায় গোঁজা ফুল’
ঢঙী যখন, তখন কোন মেয়ের কথাই বলা হচ্ছে নিশ্চয়। তবে কেমন সেই মেয়ের সাজের ধরন, যার কানে দুল নেই, অথচ মাথায় ফুল গোঁজা? সেসব প্রশ্ন আমাদের মফস্বলি মাথায় কখনো উদয় হয়নি। আমাদের মতো পরিবারে চাল-ডাল-তেল-নুনের বাইরে যা কেনা হত তা হল বই। বইই ছিল আমাদের প্রসাধনী, ডিস্কভারি চ্যানেল, কিংবা বাড়ির ডিজাইনার আইটেম। এর বাইরে যা আসত, সেখানেও দেখা হত জিনিস্টা আমাদের যেন চরিত্র নষ্ট করতে না পারে, অর্থাৎ ঢঙী করে তুলতে না পারে। একেবারে বাঁধা ছিল বসন্ত মালতী, কেয়োকার্পিন আর সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন। বসন্ত মালতী নামটা বোধহয় সেই শৈশবের প্রথম লগ্নজিতা, যে কুহুস্বরের মতো গেয়ে গেয়ে পাগল করে দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে!’ বসন্ত তো তখন একমাত্র ছিল পুরাতন ভৃত্যতে – ‘কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত আমি বসন্তে মরি’ , আর ছিল ভাব সম্প্রসারণে – ‘ If winter comes can spring be far behind?’
এ দুয়ের বাইরে যেমন বসন্ত  করাঘাত করে ফিরে গেছে, তেমনি  ব্রাত্য ছিল সাজগোজ, ফ্যাশন অর্থাৎ যাবতীয় ঢংঢাং। তখন পোশাক বা প্রসাধনী কেনার সময় দেখা হত কতদিন চলবে। প্রায়ই জামা কেনা হত দু সাইজ বড়, যাতে আরও দুটো বছর হেসেখেলে চলে যায়। এমনকি জুতো পর্যন্ত! সেসব জামা জুতো পরে লটরপটর করতে করতে আমরা যেমন অকুতোভয়ে বিয়ে, পৈতে, শ্রাদ্ধবাসরে গিয়েছি, অতটা সাহস ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে যাওয়া শহীদদেরও ছিল কিনা সন্দেহ। সাবান কেনা হত গীতায় বর্ণিত আত্মার মতো, আগুনের কথা বাদ দিন, অন্তত জলে যা গলবে না, এবং ছুঁড়ে মেরে দু-চারটে ছিঁচকে চোর ঘায়েল করা যাবে। এমন ভ্যালু অ্যাডিশন বহুজাতিক সংস্থাগুলোও ভাবতে পারবে না। এগুলো মাখতে আমাদের ভাল লাগত কিনা সেসব আমাদের কেউ জিগেস করেনি, আমরাও ভাবিনি। আর ভেবেই বা কী করতাম? বিশ্বায়ন-পূর্ব মফস্বলে হাজার চ্যানেল দূরের কথা, টিভিই ঢোকেনি।  পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে কয়েক মাইল হেঁটে গেলেও কোন বিউটি পার্লার চোখে পড়বে না। মনে রাখতে হবে সে এক আশ্চর্য ক্রান্তিকাল! পায়ে আলতা পরানোর নাপতিনীরা উধাও হয়ে গেছেন, সে জায়গায় কোন নতুন রূপসীপীঠ তৈরি হয়নি। সব্যসাচী, অগ্নিমিত্রা এরাই বা তখন কোথায়? তাই যা পাচ্ছি, তাই সোনামুখ করে মাখা বা পরা ছাড়া আর উপায় কি?
তবে মাখতে যতই চটচটে হোক, বোরোলিন প্রিয় ছিল অন্য একটা কারণে । সেটা রোববারের বোরোলিনের সংসার। খাসির মাংস ভাত আর বোরোলিনের সংসার – রোববারের দুপুরের একদম উত্তম সুচিত্রা জুটি। আর সেখানেই শ্রাবন্তী মজুমদারের মাদক গলার প্রেমে পড়া। আমার মতো আরও অনেকেই। তবু তারাই বলত ‘মহিলা কি ঢঙী না? বড্ড ঢঙ করে কথা বলে’ তখন বুঝলাম ঢঙ কথাটা অত খারাপ না। ঢঙ মানে স্টাইল। আগেই বলেছি, বই ছিল সে সময়ের একমাত্র প্রসাধনী। শেষের কবিতা কবেই পড়া হয়ে গেছে। ফ্যাশন, স্টাইল, মুখ, মুখশ্রী গেঁথে গেছে মনে। তাই খারাপ তো লাগলই না, বরং জীবনের প্রথম বিউটি টিপস পেলাম, সে ঐ ঢঙীর কাছ থেকেই-
‘শীতকালে তেল মাখার সময় তো রোজ পাওয়া যায় না। তাই এক মগ ঈষদুষ্ণ জলে কয়েক ফোঁটা  নারকেল তেল মিশিয়ে গায়ে ঢালুন। দেখবেন সমস্ত ময়লা বেরিয়ে ত্বক একদম ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে’ আহা! শুনলেই মনেরও সব ময়লা বেরিয়ে পরিষ্কার হয়ে যেত।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যাই’ বলে একটি উপন্যাসে ছিল, নাভিতে নারকেল তেল মাখলে নাকি ঠোঁট ফাটে না, এটা মনে বেশ গেঁথে গেছিল। এইভাবেই বিউটি টিপস ঢুকে পড়ত বড়দের নিষেধের লোহার বাসরঘরে, নানা চোরাগোপ্তা ফাঁকফোকর দিয়ে।
বসন্তমালতী, কেয়োকার্পিন আর বোরোলিন – এই ত্রিশক্তির বাইরে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকল শিঙ্গার কুমকুম। সেটা দিয়ে কপালে টিপ আঁকা অত সহজ ছিল না। একে তো স্কেল ছাড়া একটা সোজা লাইনও টানতে পারিনা (পরবর্তী কালে এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এ যে কারণে মুশকিলে পড়তাম), সেখানে একটা নির্ভুল গোল আঁকা কি যে বিভ্রাট! আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ পরা তো একটা অপরাধের মধ্যে পড়ে, কারণ তাহলেই বিদ্যেবতী কন্যা ঢঙী হয়ে পড়বেন! রবিঠাকুর যে শিখিয়ে গেছেন ‘অসভ্য দেশের মেয়েরাই মুখে চিত্তির করে’
সেই আমি কিনা বাবার কাছে একটা লিপস্টিক চেয়ে বসলাম!  কারণ আর কিছু নয়, আমাদের ছোট শহরে  ততদিনে টিভি এসেছে কতিপয় ধনী বাড়িতে আর সেইরকম একজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখেছি ‘মহানগর’ সিনেমা চলছে আর মাধবী মুখার্জি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছেন। আমার সেই বালিকাবেলায় দৃশ্যটি অনূদিত হল এইভাবে- লিপস্টিক আসলে মেয়েদের নিজের সঙ্গে চলা সংলাপ। সাধ হল এমন সংলাপের আংশীদার হতে। তো বহু সাধ্যসাধনার পর বাবা এনে দিলেন একটি লিপস্টিক। রংটি যাকে বলা হত ন্যাচারাল কালার।এর থেকে বড় ধাপ্পা আর কমই আছে। সেটা পরলে ঠোঁটটা শুধু চকচক করত, তার বেশি কিছু নয়। এর আগে পর্যন্ত আমার গর্বের জিনিস ছিল সরি ম্যাডাম। এটা আর কিছু না, হেয়ার ব্যান্ড। এটাকে কেন সরি ম্যাডাম বলা হত তা কে বলবে? এখন যোগ হল একটা লিপস্টিক। এর কিছুদিন পর কলকাতা থেকে একটি মেয়ে এল । আমাদের পাশের বাড়িটা তার মামারবাড়ি। তার মামা এসে একদিন কাঁচুমাচু মুখে জানাল, ভাগ্নী পুজোয় ফলস চোখের পাতা আর ফলস নখ চেয়েছে। এই পোড়া শহরে কোথায় পাওয়া যাবে ওসব? কিন্তু পাওয়া গেল সত্যি। আমাদের শহরটা বদলাচ্ছে বুঝতে পারলাম।  এখানে এখন ফলস চোখের পাতা আর নখ পাওয়া যায়। দুদিন বাদে হয়তো ফলস.. ডেঁপো  কেউ কেউ বলল।
সব হয়তো পাওয়া যেত, কিন্তু আমাদের বরাবর জামাকাপড় কেনা হত কলকাতা থেকে। আর সেইসময়ই একমাত্র জানতে পারতাম এবারের পুজোর ইন থিং কী। প্রতি পুজোয় সে বছরের হিট সিনেমার নামে ড্রেস উঠত।  রবিঠাকুরের জোব্বা টাইপের ড্রেস হল একবার। তার নাম সনম তেরি কসম। পরার পর বন্ধুরা বলল তোর তো খুব ঢঙ বেড়ে গেছে। আর একবার উঠল নুরি চুড়িদার, নুরি সিনেমার নামে। তার কামিজের কোমরে দড়ি বাঁধা। সেই চুড়িদার মহা আনন্দে বছর দুই পরার পর  সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম চুড়িদারের একটা পা আরেকটার থেকে আধহাত লম্বা! সেটাই পরে গেছি দিনের পর দিন। সত্যি সত্যি   ঢঙী হলে  কি  এমনটা হতে পারত?

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।