জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ১১)

মায়া – মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ১১

খাতা খুলে গান গেও না

‘হযবরল’-র ন্যাড়াকে মনে আছে? আমাকে আজকে গান গাইতে বোলো না, আমার গলাটা আজ ভালো নেই? এরকম অনেক ন্যাড়াকে এবং নেড়িকে দেখতে দেখতে এবং সহ্য করতে করতে বা না করতে করতে আমরা বেড়ে উঠেছি। দেখেছি পাঁচটার কম উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে পারেন না, এমন অ-সুর জমিদার নন্দনকে, আবার অন্ত্যজ পরিবারের দুখে কাওরার গলায় গোষ্ঠগোপালের অসাধারণ গান চোখে জল এনে দিয়েছে।গ্রামেগঞ্জে গানের বায়না আসতে শুরু করেছিল দুখের। খ্যাতির তুঙ্গ মুহূর্তে, তার দলে যে নাল বাজাত, তারই হাতে খুন হল সে। এখনও কানে বাজে ‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া’। ছিলেন হিমাংশু মাস্টার, যাঁকে বিজয়া সম্মিলনীতে গান গাইতে দিত যুগের যাত্রী ক্লাবের ছেলেরা একদিন সবার জন্য মুড়ি ঘুগনি ও বোঁদের বিনিময়ে!  তিনি স্টেজে উঠে গাইতে গিয়ে কথা ভুলে যেতেন, ‘যে দীপ নিভিয়ে নিভিয়া নিভিয়া’ –আর গান এগোত না। এতে ভারি আমোদ পেত ছেলেরা।মঞ্চের সামনে বসে হেসে খুন তারা। একবার মাস্টারের বুড়ি মা ছেলেদের ডেকে বলেছিলেন ‘আমার ছেলে গান গাইতে পারে না, ও সেটা বোঝে না, তোমরা তো বোঝ, কেন ওকে নিয়ে মজা করো তোমরা?’ আমার গানজীবনে হিমাংশু মাস্টারের মায়ের কান্নাভেজা মুখ একটা সার্থক অণুগল্পের মতো রয়ে গেছে। দূর থেকে আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় একি মোর অপরাধ?’ শুনে ক্ষিপ্ত সেজমাসী সেই ‘অপরাধী’কে ডেকে বলেছিলেন ‘দেখেছিস এই গ্রামে এইরকম একটা মেয়ে?’ সে বেজায় দুখী দুখী মুখ করে উত্তর দিয়েছিল ‘দূর সেজদি, এ গ্রামে একটা মেয়েই নেই, তায় এইরকম মেয়ে!’ সেই কথাটা চৈত্রপবনের মতো শনশন করে বয় কোন কোন দুপুরে।
বেড়ে উঠেছি এমন একটা বাড়িতে, যেখানে বলা হত, তানসেন না হতে পারো, কানসেন হয়ো। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা গানের ব্যাপারে বড্ড নাক উঁচু, তাতে সন্দেহ কি? মনে আছে ললিতা ধর চৌধুরীর কী একটা গান শুনে আমার নমাসি বলেছিল ‘গলার আড় ভাঙ্গেনি, কেন যে এরা গান গাইতে আসে?’ এক বিষয় নিয়ে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে শোনানো হত সেই বিখ্যাত গায়কের গল্প যিনি নাকি চল্লিশ বছর ধরে টোড়ী রাগ নিয়ে  চর্চা করার পরেও আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘ইত্নি সাল টোড়ি গা রহা হু, ফির টোড়ি ঠিক সে নেহি নিকলতি!’ অধ্যাবসায়ের উদাহরণ হিসেবে বলা হত প্রবাদপ্রতিম তবলিয়ার গল্প যাঁর ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজের নমুনা ঘাম হয়ে জমে থাকত কৌটোয়। পথের পাঁচালি নিয়ে আলোচনার সময় বাবা স্মরণ করিয়ে দিতেন, চিনিবাস ময়রার পেছন পেছন অপু দুর্গা এবং কুকুরটি যাবার অবিস্মরণীয় দৃশ্যে রবিশংকর কোন রাগ বাজিয়েছিলেন, আর দুর্গার মৃত্যুর পর হরিহর ফিরে এলে কেনই বা তারসানাই। ঝিন্দের বন্দী বা ক্ষুধিত পাষাণের মিউজিক নিয়ে যেমন আলোচনা ছিল, তেমনি সাউন্ড অব মিউজিকের অসাধারণ গানগুলো, কিংবা তার অনুপ্রেরণায় (অন্য জুতসই শব্দ না পেয়ে হোর্ডিং থেকে এই শব্দটাই  পেড়ে নিতে হচ্ছে!)জয়জয়ন্তীর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরারোপ, এগুলো জানাটাও বাধ্যতামূলক ছিল। সিলেবাসের অংক ইংরেজি ইতিহাস ভূগোলের পড়ার চাইতে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এইসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখা। ভালো কথা বলতে জানা, যাকে বাবা বলত টেবিল টক, রসবোধ –এগুলো যথেষ্ট তারিফ পেত। আর এইরকম এক আড্ডায় বাবা বুঝিয়েছিল আপ টু ডেট কথাটার প্রকৃত তাৎপর্য। আপ টু বলা হচ্ছে যখন, তার একটা সূচনা পর্ব থাকবে। তাই আপ টু ডেট থাকা মানে শুধু হাল আমলের খবরাখবর রাখা নয়, সেই বিষয়ে আগে কী হয়েছে সেই ইতিহাসটাকেও মাথায় রাখা। সেটাই প্রকৃত আধুনিকতা।
এইরকম একটা মাহোলে বেড়ে উঠে আমি প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে বুঝে গিয়েছিলাম তানসেন নয়, কানসেনই হব। তার একটা কারণ যদি হয় মায়ের অসামান্য কণ্ঠস্বর ও গায়কীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত তুলনা, দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে আমার আত্মীয় বন্ধু সমাজে গান জানা মেয়েদের পরিণতি। মেয়ে দেখতে আসা, মেয়ের গান শুনে মোহিত হয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া, তারপর তার গান বন্ধ হয়ে যাওয়া। এইসব দেখতে দেখতে আমার গান শেখা ব্যাপারটাই অত্যন্ত অর্থহীন মনে হয়েছিল।মহতী বিনষ্টি। মা আর দাদু বহু চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তবে সব ব্যর্থতারই ভালো দিক আছে। গান সদর দরজায় ঢুকতে না পেয়ে, খিড়কিপুকুরঘাট দিয়ে অন্দরমহলে ঢুকে এসেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সমস্ত শরীরটাই গান। ঠুংরী, কাজরী, চৈতী, ভাওয়াইয়া, জাজ, রক, ফিল্মি, নন ফিল্মি, সুফি, নজরুল, অতুপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, রামপ্রসাদী –এইসব গান আসলে আমার একেকটা প্রত্যঙ্গ।
অভিমন্যু যেমন মাতৃগর্ভে থাকার সময় ব্যূহ রচনা শিখে যায়, আমিও মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই গানের সাগরে ভেসেছি, গান ছিল আমার গর্ভজল।  আগেই বলেছি মা অসাধারণ গাইতেন। ১৯৫৩ সালে লতা মঙ্গেশকর প্রথম বাংলায় গান করেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুর আর পবিত্র মিত্রের কথায় আকাশপ্রদীপ জ্বলে বাংলা গানের একটি মাইলস্টোন। গ্রামের একটিমাত্র পুজোমণ্ডপে বাজা সেই গান শুনে এক দশ বছরের বালিকা, একলব্যের মতো লতাকে গুরু হিসেবে বরণ করেছিল। সেইসব গান শুনতে শুনতে আমার বড় হয়ে ওঠা। রান্না করতে করতে, জানলা দরজা মুছতে মুছতে মা গান গেয়ে চলত। আক্ষরিক অর্থে আমাদের বাড়িটা ছিল গানের ঝরনাতলা।আর সব ধরনের গান, কোন ছুতমার্গ নেই। লতা মঙ্গেশকরের গান তো বটেই, আরও কয়েকজনের গান মার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।  কলেজের  সোশালে মা বিখ্যাত হয়ে গেছিল আলপনা বন্দ্যপাধ্যায়ের ‘ছোট্ট পাখি চন্দনা’ গেয়ে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কানে আসত ওই যে ছোট্ট পাখি চন্দনা যাচ্ছে। একজন কোন কথা বলত না, রফিক তার নাম, মায়ের নীরব ভক্তদের মধ্যে ছিল। যার অপূর্ব হস্তাক্ষরে শুভেচ্ছা লেখা সঞ্চিতা দেখেছি বাড়ির অন্য বইয়ের মধ্যে। মায়ের বিয়ের উপহার। তারপর যে গানটি আসছে, সেটি সুমন কল্যাণপুরের ‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে। কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে’ সুমন কল্যাণপুরকে নিয়ে কত কথা কানে আসত। লতা নাকি ষড়যন্ত্র করে তাকে উঠতে দিল না। সত্যি মিথ্যে জানি না। সুমন সত্যি খুব ভালো গাইতেন, তবে কিংবদন্তী হতে গেলে অনেকগুল ফ্যাক্টর কাজ করতে হয়। সেই যোগাযোগগুলো, যাকে বলা যায় স্বাতী নক্ষত্রের জল। সেই যে একজনের ভারি ব্যামো, কবিরাজ বলল, বিশেষ এক অমাবস্যা তিথিতে মড়ার খুলিতে সাপের বিষের সঙ্গে স্বাতী নক্ষত্রের জল পড়লে তবে ওষুধ তৈরি হবে, তবে অসুখ সারবে। এমন যোগাযোগ তো অসম্ভব। ভেবে মুষড়ে পড়েছিল লোকটি। তার অসুখ আর সারবে না। অথচ এক অদ্ভুত মুহূর্তে এই যোগাযোগগুলো ঘটে গেল। মড়ার খুলিতে বিষ ঢেলে গেল সাপ, আর সেই মুহূর্তেই তাতে পড়ল স্বাতী নক্ষত্রের একফোঁটা জল। তৈরি হল জীবনদায়ী ওষুধ। সুমন কল্যাণপুরের বেলায় হয়তো সেইগুলো ঠিকঠাক হয়ে ওঠেনি।কিন্ত অল্প হলেও  রয়ে গেছে তাঁর কিছু চিরকালীন গান। যেমন ‘মনে করো আমি নেই।’ আর অদ্ভুত ব্যাপার, এই গানটি গাইলেই, মার পুত্র, নেহাত বছর ছয়েক বয়স হবে, হারমোনিয়ামের ওপর উঠে তারস্বরে কান্না জুড়ত। তার মনে হত, মা বুঝি মরেই গেল। মার গলায় বিশেষ কোন গান শুনে এমন করিনি আমি কখনো। তবে অনেক পরে মা যখন লতার  ‘কী যে করি’ গানটা গাইত, আমার বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিত। ওই যে ‘কী যে করি বলো এত আশা লয়ে/ বোবা হয়ে মরি এত ভাষা লয়ে’ এইখানটা শুনলে মনে হত নামী শিল্পী হবার সব উপকরণ থেকেও সংসারের চাপে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ের কান্না। যদিও মাকে কখনো এ নিয়ে আক্ষেপ করতে শুনিনি। গান গাইতে, শোনাতে ভালবাসত, কিন্তু নামী শিল্পী হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, যাকে বলে কিলার ইন্টিংক্ট। সবসময়ই গান গাইত। এমনকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও!
একবার পাড়ায় এক বাড়িতে বিয়ে। যথারীতি কিছু লোকজন আমাদের বাড়ি রাতে শুতে এসেছে। মেঝে জোড়া বিছানা। গরম কাল। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ অন্ধকারের উৎস থেকে বেজে উঠল গান ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই , ওগো প্রহর হল শেষ/ ভুবন জুড়ে রইল লেগে তোমার আনন্দ আবেশ’! বাড়িতে চোর ডাকাত পড়লেও যার ঘুম ভাঙ্গে না, রাত নটার পর পৃথিবীটা কেমন হয়, জানে না যে, সেই আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। সবার মতো মুগ্ধ হয়ে শুনছি আমিও। একটা কথা ভুল নেই, সুর এদিক ওদিক হচ্ছে না, গান শেষ হবার পর আনন্দ আবেশ লেগে থাকে অনেকক্ষণ। ঘোর ছিঁড়ে একজন বলে ওঠে ‘বউদি এইসময় প্রার্থনা করেন বুঝি? আরেকটা গান না। কী অপূর্ব’ আমি লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমের ভান করি। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না, এই অপূর্ব গানটি মা জননী ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গেয়েছেন!
একজন গুলিখোর যেমন আরেকজন গুলিখোরকে দেখলে আহ্লাদে আটখানা হয়, তেমনি দেখতাম, গানপাগল কেউ এলে মা খুশিতে ডগোমগো, বাড়িতে বসে যেত গানের আসর, তাদের গলায় শুধু গান না, নানা খোশ গল্পও উঠে আসত। আমি হয়তো এককোণে অংকের খাতা নিয়ে বসে। গানের বলয়ের মধ্যে। খিদে পাচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে, মার ওপর অভিমানে চোখে জল আসছে,  ওদিকে মা গেয়েই চলেছে ‘ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান, আসিবে আজি বন্ধু মোর’ ওই যে, যে জায়গাটায় আছে ‘চন্দ্রচূড় মেঘের গায়, মরাল মিথুন উড়িয়া যায়, নেশা ধরে চোখে আলোছায়ায়, বহিতেছে বায়ু গন্ধে ভোর’ আমার মন খিদে, ঘুম পেরিয়ে কতদূরে উড়ে চলেছে। এই হয়তো এস্ট্যাসি। নিজের সমস্ত জাগতিক অস্তিত্বের ঊর্ধবে ওঠা আনন্দ। মা-ও সেই আনন্দসাগরে ভেসে চলেছে। আমার মা নয়, কারো স্ত্রী নয়, একদম শুদ্ধ পবিত্র একাকী এক আনন্দময় সত্ত্বা। একসময় গান শেষ হয়, মার যেন হুঁশ ফেরে। বলে ‘খুব খিদে পেয়েছে না? চল, চল খেতে দি তোকে’ কাকে বলছে? আমি তো তখন ঘুমিয়ে কাদা!

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।