ছোটগল্পে তন্ময় সরকার

মাতালের মৃত্যু

পুচোন তিন নম্বর রেলবস্তির এক নম্বর মাতাল। মদ না খেলে পুচোনের কষ্ট হয়, মাথা ধরে, ঘুম হয় না; আর দু’দিন না ঘুমিয়ে কাটানোর পর তিন দিনের দিন মাথা ঘুরে রাস্তাঘাটে পড়ে যায়। মৃগী রুগীর মত দাঁতে দাঁত চেপে ছটফট করে। এমনিতেও সে রোজ মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে, তবে সেটা সুস্থতা। বউ বহু কষ্টে কেষ্টার-মা-মাসির সাহায্যে ঘরে নিয়ে যায়, “একটু ধর না মাসি! এত ভারি শরীর আমি একা কী করে পারি!”
কেষ্টার মা আফসোস করে, “সোনার টুকরো ছেলেটা আমাদের মাল খেতে খেতে শেষ হয়ে গেল! তুই জানিস না বউ, পুচোন ছিল আমাদের বস্তির সেরা ছেলে। যেমনি ডাকাবুকো, তেমনি সহজসরল! মদ ত খেতই না, উল্টে কত লোককে যে ও মদ ছাড়িয়েছে তার হিসেব নেই! কোন্ এক ডাক্তারবাবুর সাথে ওর পরিচয় ছিল। মাতালগুলোকে ধরে ধরে তার কাছে নিয়ে যেত। আর এখনও যে-রকম পরোপকারী, তখনও তেমন ছিল। তোর মেসোর যেদিন লাইনে পা কাটা পড়ল, ও একাই নিয়ে ছুটল কলকাতা! কিন্তু বাঁচাতে পারল না!”
এসব গল্প পুচোনের বউ মাসির মুখে কত শত বার শুনেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবু মাসি আবারও একবার বলবে, সে জানে।
মাসি চোখ মুছে আবার বলল, “মিনসে মরল, আমাকেও মেরে গেল। আর চুল্লুর ঠেকটা ভুতোর লোকজন দখল করে নিল। আমি কত করে পুচোনকে বললাম, ‘বাবা, দেখ না আমার ঠেকটা উদ্ধার করতে পারিস কিনা। আমি তাহলে কিছু করে খেতে পারব।’ কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হল না। বলল, ‘তোমার ও চুল্লুর ঠেক চুলোয় যাক। ওসব নিয়ে আমি কিছু করতে পারব না। তোমার চিন্তা নেই, মাসি, তোমাকে আমি খাওয়াব।’ সেই থেকে, দেখ, আজও ও আমাকে ফেলেনি! আমার ভাগ্য ভাল যে তুই এতে অশান্তি করিস না। কেষ্টাটা ত বউয়ের পা-চাটা। শালা বউয়ের কথায় মাকে ফেলে আলাদা হয়ে গেল। আজকের দিনে নিজের মাকে কেউ খেতে দেয় না, কে আর পরের মাকে খাওয়ায়, বল?”
আজ স্পেশালি মদ খাওয়ার দিন। আজ সরস্বতীপুজোর পরের দিন। আজ তিন নম্বর রেলবস্তির ফাংশানের দিন। কিন্তু আজ পুচোন মদ খাবে না। আজ সে কোনওভাবেই মদ খেতে পারে না। পুচোন মাসিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি দেখেছ? ও এসছে?”
মাসি বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। না দেখে তোকে বলছি? কাল রাতে এসছে পিংকি। কি ঠাটঠমক! চিনতে পারবি না তুই দেখলে।”
কাল রাতে এসেছে পিংকি! কিন্তু পিংকি ত সবসময়ই ছিল। পুচোনের হৃদয়-ঘরে। কৈশোরের কথা। সকাল সকাল উঠে পিংকি আর পুচোনের গন্তব্য আলাদা হয়ে যেত। পুচোন যেত কাগজ কুড়াতে, পিংকি স্কুলে। এই বস্তির জনা-কুড়ি ছেলেমেয়ের মধ্যে পিংকিই একমাত্র স্কুল যেত। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। জেদ ছিল লেখাপড়া শিখে সে দেখিয়ে দেবে নন্টে কাকাকে। বোঝাবে, সে শুধুই এক বোতল মদের সমান মস্তির জিনিস নয়। সে মূল্যবান। আর আশা ছিল, অন্তত পুচোন তার প্রাপ্য মূল্য দেবে। কারণ, পুচোন ভালর দাম দেয়। পুচোন স্কুলে না গিয়েও অনেক অনেক শিক্ষিত।
নন্টে কাকা মাঝে মাঝেই পিংকিকে বলত, “আজ রাতে আয় আমার সাইকেল গ্যারেজে। তোকে এক বোতল মালের যা দাম, তাই দেব! কম টাকা না কিন্তু সেটা, পিংকি! আসবি?”
পিংকি চোখে চোখ রেখে দাঁত কটমট করতে করতে চলে যেত। মনে মনে থুতু দিত নন্টে শালার মুখে, লাথি মারত ওর নিম্নাঙ্গে। কিন্তু মুখে কোনও কথা বলত না। পিংকির যত কথা সব পুচোনের কাছে।
পিংকি পুচোনের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় রেললাইনের লোহার বেড়ায় হেলান দিয়ে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “তোরে এত ভালবাসি কেন জানিস?”
“না।”
“তুই মাল গিলিস না বলে।”
পুচোন নকল গাম্ভীর্যে বলে, “তাহলে আজ থেকে গিলব।”
পিংকি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পালটা বলে “আমি জানি তুই কোনওদিনই মাল খাবি না।”
“খেলে কী হবে?”
“খেলে তুই নন্টে হয়ে যাবি, এই পুচোনটা আর থাকবি না।”
“আর?”
“আর তোরে ঘেন্না করব।”
“আমাকে ঘেন্না করতে পারবি?”
“তোরে ভালবাসি কেন জানিস?”
“কেন?”
“তুই ভাল তাই। যখন মাল খাবি, সেই ভালটা তখন মালে খেয়ে নেবে। তখন আমার আর মালের মধ্যে তোর কাছে পার্থক্য থাকবে না। মালের মত আমাকে কিনতে চা’বি পয়সা দিয়ে, নন্টে হারামির মত!”
পুচোন অবাক হয়ে বলে, “তুই এসব কথা ইস্কুল থেকে শিখেছিস?”
“না রে।”
“তাহলে এত ভাল ভাল কথা কে শেখাল তোকে?”
“কেউ শেখায়নি”—ব’লে পিংকি কি যেন ভাবে আনমনা হয়ে। তারপর বলে, “না, না, একজন শিখিয়েছে!”
“কে?”
“নন্টে কাকা।”
পুচোন বোকার মত তাকিয়ে থাকে পিংকির দিকে। কথা ঘুরিয়ে পিংকি বলে, “ছাড় এসব। একটা ভাল কথা…”
“কী?”
“তুই স্কুল যাবি?”
“না।”
“কেন?”
“ইস্কুলে গেলে খাব কী?”
এটা শুনে পিংকি আবারও আনমনা হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, “সে-তো ঠিক… খাবি কী!”
সেই পিংকি কাল রাতে এসেছে। আজ স্পেশালি মদ খাওয়ার দিন। যদিও মদ খেতে দেরি হয়েছে বলে অন্য দিনের মত আজও খুব মাথাটা ধরেছে। কিন্তু আজ কিছুতেই মদ খাবে না পুচোন। পিংকির সামনে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে দাঁড়াতে পারবে না সে কিছুতেই। পিংকি এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক ভারভারিক্কি হয়েছে শিক্ষিত লোকদের মত। অনেক লেখাপড়া শিখেছে। পিংকি লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়। যা জেদ ছিল ওর লেখাপড়া শেখা নিয়ে! মাসি বলছিল, অনেক ঠাটবাট হয়েছে। সে তো হবেই। সব শিক্ষিত লোকেরই ঠাটবাট হয়। তাই বলে পুচোনের সামনে নিশ্চয়ই পিংকি অহংকার দেখিয়ে ভাবে-ভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে না!
পিংকি পুচোনকে ভালবাসত। ভালবেসে সারাজীবন থাকতে পারত পুচোনের পাশে। হয়ত সেটাই চেয়েছিল পিংকি। কিন্তু যেদিন ভুতো জোর করে পিংকিকে ওর সাট্টার ডেরায় ঢুকিয়ে দরজা দিল, তারপর দিন পিংকির বাবা পিংকির বিয়ে দিয়ে দিল এক ভিনদেশি কাঁসারিয়ালার সাথে। পিংকি আর ফেরেনি কোনওদিন এই তিন নম্বর বস্তিতে।
পিংকি চলে গেছে। নন্টে কাকা টিবি রোগে কেশে কেশে একদিন চিতেয় পুড়ে ভষ্ম হয়েছে। ভুতো মার্ডার হল গত ইলেকশানের আগে। উঠে গেছে মিটমিট করে ল্যাম্প-জ্বলা সাট্টার অবৈধ ঠেক। এখন বস্তি শান্ত। শুধু অশান্ত পুচোনের হৃদয়। পিংকি যেন পুচোনকে একটা ভালর শিকলে বেঁধে রাখত। সে শিকল খুলে গেছে পিংকির চলে যাওয়ার সাথে সাথে। বন্ধনমুক্ত লাভার মত দিগ্বিদিক ছুটে যাওয়া অশান্ত পুচোনের হৃদয় রোজ রাতে পুড়ে পুড়ে নিভে যায় বোতলের তলানিটুকু শুষে নিয়ে! ধিকিধিকি অর্ধদগ্ধ হৃদয়কে মদ ঢেলে নিভিয়ে পুচোন ঘুমিয়ে পড়ে।
বউ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কি গো! আজ খেলে না যে!”
পুচোন কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “এমনি। চ, ফাংশোনে যাই।”।
ক্লিন-শেভড্ ছিপছিপে কাল পুচোন সস্ত্রীক ফাংশানের মাঠে গিয়ে দাঁড়াল। বউয়ের পাশে দাঁড়ান পুচোনের চাতক-চোখ খুঁজে চলেছে পিংকিকে। কোথায়? আসেনি কী ফাংশানে? এসব মাতলামো আর উচ্ছৃঙ্খলতা যদিও পিংকির কোনওদিনই পছন্দ ছিল না। মদ খেয়ে নাচা আর বেলাল্লাপনা করা দেখলে পিংকির গা জ্বলে যেত। তাই আজ পুচোন মদ খায়নি। পিংকির সামনে মদ খেয়ে সে দাঁড়াতে পারে না।
উদ্দাম সংগীত চলছে। সবাই টালমাটাল। এলোপাথাড়ি নাচের ফোয়ারা, আলোর অহেতুক ঝলকানি। এই অসংযত উৎসাহের মধ্যে দাঁড়িয়েও হতাশ হল পুচোন। পিংকি আসেনি ফাংশানে। ঘরে ফিরে যাওয়াই ভাল। খুব মাথা ধরেছে।
ফিরে যাচ্ছিল, ঠিক তক্ষুণি তাকে দেখতে পাওয়া গেল! ঐ তো! কি সুন্দর দেখতে হয়েছে পিংকি! মায়া-মায়া চোখ, ঠোঁট লিপস্টিকে লাল, চেহারায় সেই শিক্ষিত লোকদের মত ভারভারিক্কি ভাব!
পিংকি! পুচোনের স্বপ্নের পিংকি এগিয়ে আসছে পুচোনের দিকে! বুকের ধুকপুকোনিটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে।
“অ্যাই পুচো! অ্যাই! কদ্দিন পরে তোরে দেখলাম!”
বুকে বুক ঠেসে দিয়ে দুহাতে পুচোনের গাল চেপে ধরে বলল, “চ না, তোর সাথে একটু নাচি!”
উগ্র হুইস্কির গন্ধ পিংকির মুখে, চোখদুটো ঢুলুঢুলু, লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট—যেন রক্তখেকো ডাইনি!
পুচোনের বউ তেড়ে এল, “এই মাগী! কী করছিস তুই! সর্!”
পিংকি জড়ানো গলায় বলল, ” তুই সর্, শালি! তুই তো সেদিনের! এ আমার অনেক পুরানা ইয়ার! চ না, পুচো, নাচি!”
পুচোনের বউ রেগেমেগে জিজ্ঞেস করল, “এই মাগীটা কে গো? চেন তুমি একে?”
পুচোন দু’হাতে বুক থেকে পিংকিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “না। মাল গিলে শালি ভুল বকছে!”
পাশ থেকে বিশু একটা বিয়ারের বোতল এগিয়ে দিল পুচোনের দিকে, “খাবি?”
হাত দিয়ে সরিয়ে দিল পুচোন। বিয়ারের বোতলটা মরা পিংকির পঁচাগলা মুখটার মতই কুৎসিত দেখাচ্ছে। বউকে বলল, “চ, ঘরে যাই। খুব মাথা যন্তন্না হচ্ছে।”
পিংকি মুখ বেঁকিয়ে চলে যেতে যেতে কিসব ইংরেজি গালাগাল দিচ্ছিল, “কাওয়ার্ড! শালা হেনপেকড্!”
রাত বেড়েছে। থেমে গেছে ফাংশানের উন্মত্ত কলরব। নাচনেওয়ালা-নাচনেয়লিরা ঘুমে ঢলে পড়েছে অবসাদ আর ক্লান্তির কাছে হার মেনে। কিন্তু পুচোন নির্ঘুম, চিৎ হয়ে পড়ে আছে ঝুপড়ির শক্ত বিছানায়। উঠে পড়ে। দরমার বেড়ার দরজা খুলে বাইরে তাকায়। রেলের উঁচু সোডিয়াম ল্যাম্পের হলুদ আলো ছলকে পড়ে বিছানায়। বউয়ের ঘুমন্ত মুখে এক নিশ্চিন্ততার মৃদু হাসি যেন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে পুচোন।
রেললাইনের লোহার বেড়াটার উপর হাত রেখে দাঁড়ায়। এখানে একদিন কত কত বার দাঁড়িয়েছে পুচোন আর পিংকি! যে পিংকি কানে কানে ফিসফিস করে বলত, “তোরে এত ভালবাসি কেন জানিস?”
“কেন?”
“তুই ঐ লুচ্চাগুলোর মত মাল খেয়ে যার-তার গায়ে ঢলে পড়িস না, তাই!”
মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ ঠাণ্ডা হাওয়ায় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক। সোডিয়ামের হলুদ আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে রেল-গোডাউনের পাশের শিরিষ! তার পাতা বেয়ে টপটপ ঝরছে কুয়াশার জমাট জল। নাকি শিরিষের কান্না! বহুবছর পরে অবাধ্য আজ পুচোনের দু’চোখ। হৃদয়ের টকবগ করে ফোটা লাভা আর নিভবে না কিছুতেই। এই অশান্তি, এই জ্বালা, এই বুকের ওপর চেপে বসা পাথরের মত ব্যথা— অসহনীয়! ঝাপসা হয়ে আসে হলুদ-আঁধারি দৃশ্যপট। দু’ হাতের তালুতে মুখ চেপে ধরে পুচোন। কান্নামাখা গলায় অস্ফুটে ভেসে আসে, “কেন? কার পাপে?…”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।