ছোটগল্প বনবীথি পাত্র 

বন্ধন

মার্চ মাস পড়ে গেছে , তাও সকালের দিকটায় এখনো বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগে। ঘুমের মধ্যেই একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিতে মন চায়। আজকেও ঘুমের মধ্যেই চাদরটা জড়িয়ে নিয়েছিল সন্দীপ , বেশ একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন আমেজ । তখনি অ্যালার্মটা বেজে উঠলো । একবার-দুবার বেজে যাওয়ার পরেও পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল সন্দীপ , কিন্তু ঋতুর ডাকে শেষ অবধি উঠতেই হলো । ধ্যুৎ ভোরে ওঠার অভ্যাসটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে । পুরো চারটে মাস , সময়টা তো আর কম নয় । চটপট উঠে রেডি হয়ে নেয় সন্দীপ । ঋতু চা , সাথে টিফিন সব তৈরি করে ফেলেছে এরমধ্যেই । রিক্সা আগেই ঠিক করা ছিল , ততক্ষণে রিক্সা এসে গেছে । ডাক্তারবাবুর নির্দেশ , আর তিনমাস না গেলে সাইকেল চালানো যাবে না । ঘুমন্ত নিধিকে একটু আদর করে বেরিয়ে পড়ে সন্দীপ । অনেকদিন পর এই ভোরবেলাটা দেখতে বেশ লাগছে । যাক্ ফার্স্ট বাসটা ছেড়ে যায়নি এখনো , নাহলেই আবার পরের বাসের জন্য চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো । বাসে উঠে একটা মনমতো জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে যায় । চেনা মুখের মানুষগুলোর সাথে হালকা হাসির বিনিময় , কাউকে কাউকে এতদিন না আসার কারণ ও বলতে হলো সংক্ষেপে ।
বাস চলছে । ঠান্ডা-ঠান্ডা হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে । অনেকে পাশের জানলা বন্ধ করে দিয়েছে । চেনা পথ-চেনা ছবি , গত সাড়ে পাঁচবছর ধরে একই পথে রোজকার যাতায়াত ; তবু এতদিন পর বলেই বোধহয় একটা দৃশ্যও আজ চোখের নজর ছাড়া করতে মন চাইছে না সন্দীপের ।
সেদিনও অন্যদিনের মতোই স্কুল ছুটির পর প্রায় ছুটে এসে ট্রেকারটা ধরেছিল সন্দীপ । ভিড় ট্রেকারের পিছনদিকে কোনরকমে সেঁধিয়ে দিয়েছিল শরীরটাকে । ট্রেকার থেকে নেমে 4.25 এর বাসটাও পেয়ে গিয়েছিল , এমনকি জানলার ধারের একটা সিটও পেয়েছিল । মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা সেদিনই শেষ হয়েছে , পরীক্ষার খাতাগুলোয় ছিল সঙ্গে। রোজ সেই ভোরে উঠে সাড়ে তিনঘন্টা জার্নি করে স্কুল করে , আবার অতটা রাস্তা ফেরা। ক্লান্তিতে চোখটা বোধহয় বুজে এসেছিল সন্দীপের । একটা বিকট আওয়াজে চোখ খুলে তাকাতেই মুহুর্তে সব অন্ধকার । জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালে , প্রায় বাইশ ঘন্টা পর। ছোটখাটো আঘাতের সঙ্গে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ডানপায়ের চোটটা । সন্দীপ যে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে আশায় করেনি ওর বাড়ির কেউ । ডাক্তার-ওষুধ-ইঞ্জেকশন-অপারেশন-ফিজিওথেরাপি , কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল তিনটে মাস । আরো একমাস বাড়িতে বিশ্রাম নিতে নিতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল সন্দীপ । ডাক্তারের অনুমতি পাওয়া মাত্র  হেডস্যারকে ফোন করে ওর আজকে জয়েন করার কথা জানিয়ে দিয়েছে । যদিও হাতের ক্রাচটা এখনো কিছুদিন সাথে রাখতে বলেছেন ডাক্তারবাবু , তবু আজ অনেকদিন পর নিজেকে বেশ সাবলম্বী লাগছে সন্দীপের ।
সাড়ে পাঁচবছর আগে যখন এই বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরীটা পেয়েছিল , আদৌ চাকরীটা করতে পারবে কি না কতবার ভেবেছিল সন্দীপ । সেদিন শুধুমাত্র আর্থিক প্রয়োজনে চাকরিটা নিতে বাধ্য হয়েছিল সন্দীপ । ভেবেছিলো পরে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করবে , কিন্তু এখানকার মানুষগুলোর সাথে এমন মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেছে যে ট্রান্সফারের ভাবনাই আর মাথায় আসেনি । এখানে না এলে জানতেও পারতো না এখনকার দিনে এমন গ্রামও আছে! তখন বিদ্যুৎও ছিল না গ্রামে , বছর দুয়েক হলো বিদ্যুৎ এসেছে গ্রামে । রুক্ষ মাটি, চাষআবাদও ভালো ভাবে হয়না। গ্রামের নিরক্ষর মানুষগুলো তবু কঠিন পরিশ্রমে সেই জমিতেই ফসল ফলায়। আর কিছু মানুষ নিকটবর্তী শহরে আসে দিনমজুর খাটতে । মহিলারা বেতের জিনিস তৈরি করে সদরে বিক্রি করে । দারিদ্রতার সাথে ওদের এই জীবন-সংগ্রামে লেখাপড়া শেখার কোন জায়গাই ছিলনা। এখন তাও তো ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ামুখী হয়েছে কিছুটা । যদিও মেয়েদের লেখাপড়া ঐ সেভেন-এইট অবধি । তের-চোদ্দতে পড়লেই বিয়ে হয়ে যায় এখানকার মেয়েগুলোর । যাদের পেটের দুমুঠো ভাতের জোগান নেই ঠিকমতো , তাদের আঠারো বছরের নীচে মেয়ের বিয়ে না দেওয়ার আইন বোঝাতে যাওয়া মূল্যহীন । মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে একটা পেটের ভাত কম জোগাতে হবে , সেটাই ওদের কাছে আসল কথা । স্কুলে মিড ডে মিল চালু হওয়াতে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসার ঝোঁকটা অনেকটা বেড়েছে । এবছর তো প্রথম দুজন মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাতে বসেছে সন্দীপদের স্কুল থেকে । নিজের মনে মনে একটু অনুশোচনা হয় , এমন সময়ে পা ভেঙে পড়ে থাকলো মাধ্যমিকের আগে ছেলেমেয়েগুলোকে একটু অঙ্কটা দেখিয়েও দিতে পারলো না । কেমন পরীক্ষা দিল ওরা কে জানে! হেডস্যারের কাছে অবশ্য ফোনে খোঁজ পেয়েছে , পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই হয়েছে ওদের ।
ছেলেমেয়েগুলো বড্ড ভালোবাসে সন্দীপকে । আজ এতদিন পরে ওকে পেয়ে ওদের খুশিটা কল্পনা করতে গিয়েই চোখের কোণটা ভিজে ওঠে সন্দীপের । বিশেষ করে মনে পড়ছে সাঁজির কথা । সবাই হয়তো ওর অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনেছে , কিন্তু সাঁজি কি বুঝেছে কিছু! নাকি রোজ শুধু বোবা চোখে খুঁজে গেছে সন্দীপকে ?
মেয়েটাকে তো কোনদিন স্কুলে দেখেনি , তবু প্রতিদিন স্কুলে প্রার্থনার সময় হাতজোড় করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো সন্দীপ । একদিন চুপিচুপি গিয়ে হাতটা চেপে ধরতেই ছুটে পালানোর সে কি চেষ্টা । নাম জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে । স্কুলের দারোয়ান রামশরণ বলেছিল , “ইতো বাবুলালের বিটি সাঁজি আছে । জম্ম থিকেই বোঙাটো আচেক কথাটো বলবেক ক্যামনে । মাটো তো কবেই মরেচে, বাপটো সারাদিন শহরটোতে কাম করে আর আঁধারটো হলেই হাঁড়িয়া খেয়ে পড়েটো থাকে । উ তো গাঁটোতে ইধার-উধার ঘুরেটো বেড়ায় সারাদিন । রাতে বাপ ভাতটো ফুটাইলো দুটো খায় । আর যিদিনটোতে বাপ ভাতটো রাঁধেনা , সিদিন মুড়ি-বাসাতাটো খিয়া থাকে ।”
সাঁজির চোখদুটো দেখে সেদিন-ই কেমন একটা মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিল সন্দীপ । স্কুলের খাতায় নাম না থাকা সত্ত্বেও দুপুরে মিড-ডে-মিল খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সাঁজির জন্য । সাঁজিও প্রতিদান দিতে ভোলে না। কোনদিন একথোকা বুনোফুল , কোনদিন বা একটা কাঁচা পেয়ারা বা রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কাচের গুলি এনে উপহার দেয় সন্দীপকে । শহর থেকে মাঝে মাঝে ওরজন্য একটু বিস্কুট-চকলেট-কেক নিয়ে যায় সন্দীপ । কি খুশি হয় সাঁজি ঐগুলো পেয়ে , ভাষাহীন আওয়াজে কত ভালোবাসাই না জানাতে চায় । ওর ঐ বোবা মুখের ভাষাহীন আওয়াজটায় যেন স্যার ই বলতে চায় সন্দীপকে । এই ক’বছরে দেখতে দেখতে সাঁজি বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে , কিন্তু ওর চোখদুটো এখনো সেই আটবছর আগের মতই সরল । জীবনের কোন জটিলতা যেন ঐ চোখদুটোকে ছুঁতে পারে না ।
বাস থেকে নেমে কেষ্টর চায়ের দোকানে যায় সন্দীপ । ওর অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা জানে অনেকেই । তাদেরকে সবিস্তারে
ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে হলো একভাঁড় চা খেতে খেতে । ভিড় ট্রেকারে উঠতে পারবে না । চেনাশোনা একটা ফাঁকা ট্রেকার দেখে উঠে বসে সন্দীপ ।
ট্রেকার থেকে নেমে কাঁচারাস্তাটুকু পায়ে হেঁটেই আসতে হয় । স্কুলের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা প্রতিবারের মতোই ফুলে ফুলে ভরে গেছে । স্কুলে ঢুকতে গিয়ে কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে । রামশরণ তো বারান্দার এই টুলটাতেই বসে থাকে , আজ নেই কেন ?
তাহলে আজ হয়তো সন্দীপ-ই একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে । ছেলেমেয়েও বেশি আসেনি মনে হচ্ছে এখনো । অন্যদিন তো সব মাঠেই ছোটাছুটি করে , আজ কেমন একটা চুপচাপ ভাব ।
স্টাফরুমে পৌঁছেই ঘটনাটা জানতে পারে সন্দীপ । গতরাতে কারা যেন অত্যাচার করে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে গেছে সাঁজিকে । মুহুর্তে চমকে ওঠে সন্দীপ । মেয়েটার জন্য মনটা কষ্টে ভরে যায় । আর দেরি না করে তখনি সাঁজিদের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় । ইতিহাসের শিক্ষক মৃদুলবাবুও আসে সন্দীপের সঙ্গে । মৃদুলবাবুর কাছেই শোনে মাস দেড়েক আগে নেশার ঘোরে পুকুরে পড়ে গিয়ে মারা গেছে বাবুলাল । তারপর থেকে সাঁজি তো একাই থাকে ওদের ঘরে ।
টিনের একচালার ঘর । ঘরের সামনে গোটা গায়ের মানুষের মেলা । কোনরকমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সন্দীপ । ওকে দেখে রামশরণ , গাঁয়ের আরো চেনা মানুষগুলো এগিয়ে আসে । সবার মুখে এককথা , জানোয়ারগুলো ছিঁড়েখুড়ে খেয়েছে বোবা মেয়েটাকে ।
অন্ধকার ঘরের চৌকিটার এককোণে ডানাভাঙা পাখির মতো কুঁকড়ে বসে আছে ফুলের মতো মেয়েটা । ছেঁড়া তেলচিটে ময়লা বিছানার চাদরটাতেই ঢেকে রেখেছে নিজেকে । একরাতের নিষ্ঠুরতা মেয়েটাকে লজ্জা পেতেও শিখিয়ে দিয়েছে ।
চোখে চোখ পড়তেই হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে ডাকে সন্দীপ । কেমন যেন ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে আছে । তবে কি এই চারমাসে সন্দীপকে ভুলেই গেছে সাঁজি!
আরো একটু এগিয়ে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতেই যেন সন্দীপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁজি । দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলে সমানে । ভাষাহীন স্বরে আজ যেন ওর স্যার ডাকটা আরো বেশি স্পষ্ট ।
মুহুর্তে অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে যায় সন্দীপের । নিধি তখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে । ছুটির সময়ে কোন কারণে সেদিন ওকে নিতে যেতে একটু দেরি হয়েছিল সন্দীপের ।  সন্দীপকে দেখতে পেয়ে সেদিন এভাবেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিধি , এভাবেই কেঁদেছিল সন্দীপকে জড়িয়ে ধরে ।
নিধির থেকে কতই বা বড়ো সাঁজি ? স্যার না হয়ে নিধির মতো সাঁজির ও কি বাবা হতে পারে না সন্দীপ! পারে না কি অনাথ বোবা মেয়েটার সব দায়িত্ব নিতে!
সন্তানস্নেহে সাঁজিকে আরো শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরে সন্দীপ । এই বন্ধন – এই নির্ভরতাটুকুই যে এখন বড়ো বেশি দরকার মেয়েটার ….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।