• Uncategorized
  • 0

গল্পে রোনক ব্যানার্জী

অভিশপ্ত পোট্রেট

মনোজ একটু  ক্রিটিক্যাল ছেলে। সাধারণ চিন্তার বাষ্প তার মাথায় খুব কম ঘনীভূত হয়।বাস্তব জগতের বাইরেও যে একটা জগৎ আছে,এই ধারণা মাঝে মাঝেই কুড়ে খায় তাকে।তা সে জগৎ রূপকথার‌ই হোক,স্বর্গের‌ই হোক কিংবা পাতালের। ছেলেটি ভারী সুন্দর ছবিও আঁকে। তবে তার পোট্রেটগুলো কেমন অদ্ভুত ধরনের। জলরংয়ের নিপুনতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় রংয়ের সামঞ্জস্য খটকা লাগায়। একটা ঝোলা ব্যাগ, তাতে দুটো তুলি, জলরংয়ের সামগ্ৰী,আর্ট পেপার,আতসকাচ, থার্মোমিটার ও একটি চাকতি। বন্ধুমহলে তার আ্যবসার্ড চিন্তা খিল্লির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এই তো সেদিন শহরের চিত্রপ্রদর্শনীতে তার আঁকা “ডোম ও মড়ার কথোপকথন” চিত্রটি সেরা দশের তালিকায় স্থান পায়।মনোজের মা ছেলের এই খেয়ালীপনা,উদ্ভট জীবনশৈলি একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু তার বাবা ছেলের ক্রিয়েটিভিটি, ইনোভেশনকে সমর্থন করেন ও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেন। মনোজের প্রেমিকার নাম বিদীশা। পদার্থবিদ্যার টিউশনে আলাপ, একনজরে বিদীশাকে ভালো লাগে মনোজের,মনের চাঞ্চল্য সহ্য করতে না পেরে একদিন সন্ধ্যেবেলা টিউশনে তাকে প্রেমপ্রস্তাব দিয়েই ফেলে।তারপর‌ই ঘটে অঘটন,চরম অপমানিত হতে হয় তাকে বিদীশা ও বন্ধুদের কাছে। দু’বছর পর কিন্তু বিদীশা নিজেই প্রেমের প্রস্তাব দেয় মনোজকে,মনোজ যথারীতি প্রপোজাল গ্ৰহণ করে।এবার আশা যাক প্রশ্নচিহ্নে? আচ্ছা একজন আর্টিস্টের কাছে থার্মোমিটার, চাকতি, আতসকাচ এগুলো কোন কাজে আসবে?মনোজ কি থার্মোমিটার দিয়ে চিত্রগুলোর শারীরিক তাপমাত্রা মাপবে না আতসকাচ দিয়ে চুলের মধ্যে উঁকুন আছে কি না সেটা পরীক্ষা করবে। আগেই বলেছি অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে মনোজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে নিরন্তর।খালি চোখে যেসব প্রাণী ধরা পড়েনা,ইন্দ্রিয়গ্ৰাহ্য অনুভূতির সাহায্যে অনেক সময় তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। থার্মোমিটারের উষ্ণতার হেরফের দেখে মনোজ ধারণা করে এইসমস্ত অদৃশ্য বস্তুর উপস্থিতি। এমন অকাট্য,উন্মাদ ছেলেটাকে নিজে থেকে প্রত্যাখানের পর‌ও ভালোবেসেছিলো বিদীশা। ওদের প্রেমটাও অন্যরকম,রাস্তার ধারের স্ট্রিটফুডের দোকানে একটিবার‌ও ওদের আসা হয়নি, কিংবা কোনো ফাইভস্টার ক্যাফেতেও একসাথে কফি খেতে আসেনি ওরা, সিনেমাহলে বসে কোনো একটি রোমান্টিক গানে পরস্পর পরস্পরকে কখনো জড়িয়ে ধরেনি একটিবার। এমনকি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় রবিরশ্মির শেষ খেলাতেও তাদের আবীরে লুটোপুটি হতে দেখা যায়নি,গান পাগলিনী নর্তকীর মতো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েও ওরা পুকুরের স্থিরতার মতো অবিচল থেকেছে। প্রশ্বাসের বিনিময়‌ও তাদের মধ্যে হয়নি। একদিন সন্ধ্যেবেলা মনোজ খবরের কাগজটা চোখ বোলাতে হঠাৎ দেখতে পেলো একটি কোণে লেখা রয়েছে “মাদকসক্তির জেরে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে গলায় কোপ দিয়ে মেরে ফেলেছেন।” সেখানকার অধিবাসীদের বক্তব্য স্ত্রীর অন্যপুরুষের সঙ্গে মেলামেশার দৃশ্য স্বামী নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে তারপর একদিন মাদকদ্রব্য পান করে স্ত্রীর এই কুকর্মের শাস্তিস্বরূপ তাকে হত্যা করে।এমন সময়ে বিদীশা তার পাশে বসে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে মনোজের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। একাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন মনোজ বিদীশাকে প্রেমপ্রস্তাব দিয়েছিলো, কিন্তু তখন বিদীশা ও তার বান্ধবীরা মিলে মনোজের এমন হাল করেছিলো যে পাড়াময় সকলেই তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতো,ছেলের জন্য বাবাকেও অকথা কুকথা শুনতে হয়েছিলো। তারপর উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে মনোজ পদার্থবিদ্যায় স্নাতক স্তরে ভর্তি হয় এবং বিদীশার বিয়ে হয়ে যায় শহরের একটি অভিজাত পরিবারে। সুখের সংসারে কিছুই অভাব ছিলো না তাদের। স্বচ্ছল পরিবারের ব‌উ হয়ে যেনো হাতে স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিলো বিদীশা। সন্তানসম্ভবা বিদীশার সন্তান প্রসবের সময় একটি ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন দেখা গেলো, দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিশুকে জন্ম দেওয়ার অব্যবহিত পরেই বিদীশা মারা যায়। মৃত বিদীশার অশরীরি ফিরে আসতে চাইলো মনোজের মনে, একসময়ের প্রিয়তমার আত্মার সঙ্গে প্রেম করতে সম্মত হয়েছিলো মনোজ,বিদীশার উপস্থিতি মনোজকে হাসিখুশি রাখতো,অশরীরির সাথে এমন মিলনের কথা কেউ জানেনা, ওদের একাত্মতা যৌক্তিক রক্তচক্ষুর বাইরে,সূক্ষ্ম বিশ্লষণের উর্দ্ধে। মনোজের দর্শন, চিন্তা-ভাবনার বিস্তার এত‌ই দুর্গম যে তার প্রেমিকা, প্রেয়সী কখনোই ইহজগতের বাসিন্দা হতে পারে না, তাই তার ভালোবাসার মানুষটিও মনোজগত-অতিন্দ্রীয় জগতের রাজকন্যাই হবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।