গল্পকথায় মহুয়া সমাদ্দার 

পিতৃত্ব 

ফেসবুকটা আবার লগ ইন করলো সৌরভ । আজ একমাস ধরে চেষ্টা করছে মোহনার প্রোফাইল দেখতে । কিন্তু নাহ্ । ব্লক করে দিয়েছে মোহনা তাকে । কিছু একটা করতেই হবে এবার , মনে মনে ভাবলো সৌরভ ।
নতুন একটা ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে রিমি চ‍্যাটার্জি নামে  একটা ফেক আইডি খুললো সে । নেট থেকে খুব সুন্দর একটা অপরিচিত মডেলের কিছু ছবি দিয়ে একটা প্রোফাইল বানানোর পর মোহনার কিছু কমন ফ্রেন্ডকে রিকু পাঠিয়ে দিলো ।
মোহনা দারুণ চালাক মেয়ে । প্রথমেই যদি মোহনাকে রিকু পাঠায় তবে সে নির্ঘাত সন্দেহ করবে । তাই আগে কিছু মিউচুয়াল ফ্রেন্ড হোক । তারপর ওকে পাঠানো যাবে ।
কোচিং সেন্টারের সবচাইতে শান্ত মেয়ে ছিল মোহনা আর সবচেয়ে হুল্লোড়বাজ আর হুজুগে ছেলে ছিল সৌরভ ‌। সব বিষয়ে ইয়ার্কি ছিল পাক্কা । ছ’ফিটের কাছাকাছি হাইট । গায়ের রঙ তামাটে । কিন্তু এই রঙটাই যেন সৌরভকে আরও হ‍্যান্ডু বানিয়েছিল । অন‍্যদিকে , মোহনার চোখদুটো বড়ই টানতো সৌরভকে ।
ফিজিক্স অনার্সের কোচিং  ক্লাসে মোহনা আর সৌরভ এক‌ই সাথে এম. বি. স‍্যারের কাছে পড়তো । প্রথমদিকে সৌরভ মোহনাকে খুব ডিস্টার্ব করতো । মোহনা সৌরভকে আদ‍্যপান্ত একটা বাজে ছেলে বলেই ভাবতো । কিন্তু পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বের হ‌ওয়ার পরে সৌরভের রেজাল্ট দেখে  টেনেটুনে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মোহনার তো চক্ষু চড়কগাছ ! এ কি করে সম্ভব !
ক‍্যালকাটা ইউনিভার্সিটি টপার ! তারপর থেকেই কি এক অজ্ঞাত কারণে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে মোহনা ।
তারপরের বছর ফোর্টিনথ্ ফেব্রুয়ারিতে একটা গোলাপ দিয়ে মোহনাকে প্রোপোজ করে সৌরভ ।
তারপর মোহনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে নিজেকে মোহনার প্রেমে নিয়েছিল ভিজিয়ে ।
ফিজিক্স অনার্স দুজনের শেষ হলো অনেক অনেক প্রেমের সুখানুভূতি নিয়ে । এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল । কিন্তু অনার্সের পরপরই একজন টিচার পাত্রের সাথে মোহনার বাবা মা ওর বিয়ে দিয়ে দেয় ।
আসলে মোহনারা পরপর দুই বোন এবং মোহনা বড়ো । মোহনার স্বল্প শিক্ষিত বাবা এতো ভালো পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাননি । মোহনা ছুটে গেছিল সৌরভের কাছে । সৌরভ ওর গালে হাত ছুঁইয়ে বলেছিল , ” মোহনা , আই অ্যাম নট সেট্ল্ড নাউ । আই অ্যাম জাস্ট হেল্পলেস । বাট , তোর পাশে সারাজীবন আমি থাকবো । পাক্কা প্রমিস । “
মোহনার বিয়ের রজনীগন্ধা যেন অদ্ভুত একটা অসহায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল ওর মনে । বিয়ের সানাই , বেনারসি , আচার অনুষ্ঠান , শ্বশুর বাড়ির লোকের ন‍্যাকামো যেন ওর অসহ্য লাগছিল । বিয়ের পিঁড়িতে বসে লোকটাকে প্রথম ভালোভাবে দেখলো সে । “ইস্ । কেমন যেন বুড়োটে মার্কা । আবার একটা সাউথের হিরোদের মতো গোঁফ ! মানায় , আমার মতো একটা একুশ বছরের মেয়ের সাথে কখনো মানায় এরকম একটা চল্লিশ বছরের বুড়ো ! ” — নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল মোহনা ।
বিয়ের পর শশুর বাড়ীতে এসে দেখলো শুধুই শাশুড়ি মা আছে ঘরে । বিয়ের দিন দুই পরেই দুই ননদ তাদের নিজেদের বাড়িতে চলে গেছিল । বাসর রাতে মোহনা ওর বরকে সাফ জানিয়ে দেয় , ” আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি । প্লিজ ডোন্ট টাচ্ মি । ও এখনো সেট্ল্ড হতে পারে নি । তাই জন্য‌ই আমার এই বিয়ে । ন‌ইলে কি আর আপনার মতো … ” — আরও কিছু বলতে গিয়েও বললো না সে ।
মোহনার বর কৌশিক চুপচাপ অন্য পাশে ফিরে শুয়ে পড়লো । একটা বোধ হয় দীর্ঘশ্বাস পড়লো । আর মোহনা হোয়াটস অ্যাপে সৌরভের সাথে চ‍্যাট করতে লাগলো ।
বিয়ের পর দুবছর কেটে গেছে । সৌরভ অনার্সের রেজাল্টে  পরীক্ষায় বসেই এস.এস.সি. তে বসে টিচারের চাকরি পেয়ে গেছে ।ডিসটান্সে মাস্টার্স ইগনু থেকে মোহনা ও করেছে ওর স্বামী কৌশিকের জোরাজুরিতে । যদিও কৌশিকের সাথে কোনও শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি মোহনার , তবুও একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্ব ওদের মধ্যে রয়েছে ।
সৌরভের সাথে আজকাল বাইরে দেখা করে মোহনা । মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক রয়েও যায় দুজনে । মোহনার স্বামীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা শরীরের সুধা  সৌরভ যেন একনিশ্বাসে পান করে । সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা মোহনার সারা শরীরকে অবশ করে দেয় ।
পরপর দুমাস পিরিয়ড হয়নি মোহনার । ব‍্যাপারটা মোহনার মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেলেও মোহনার শাশুড়িমা নীতাদেবী ঠিক খেয়াল করেছিলেন । বৌমার আজকাল মাছের প্রতি তীব্র অভক্তি , সব খাবারেই হলুদের গন্ধ পাওয়া ইত্যাদি নীতাদেবীকে বলে দিয়েছিল যে সে ঠাকুমা হতে যাচ্ছে ।
কৌশিককে ঘরে ডেকে নীতাদেবী বললেন , ” কুশ , আজ বৌমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবি । ড. রায়ের সাথে আমি অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেই রেখেছি । বিকেলে চারটের মধ্যে চলে যাবি । তুই বাবা হচ্ছিস । “
কৌশিক তো মায়ের কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না । “মোহনা মা হতে চলেছে ! হাউ ইস্ ইট পসিবল ? আমার সাথে তো সেরকমষ কোনো রিলেশন হয়‌ই নি আজ পর্যন্ত ! ওহহ ! তারমানে সেই ছেলেটার সাথে … ওহহ গড্ । ” — মনে মনে যেন ভেঙে পড়তে থাকে কৌশিক । কিন্তু সব যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে ভীষণ আনন্দ হ‌ওয়ার ভাণ করলো মায়ের কাছে ।
মোহনা ডাক্তার দেখিয়ে এসেই সৌরভকে ফোন করে খবরটা দিলো । “সৌরভ , ক‍্যান ইউ ইমাজিন , তুই বাবা হচ্ছিস !  ইয়েস , আই অ্যাম প্রেগনেন্ট । তোর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে । এই তোর ইচ্ছে করছে না ? কিরে ,চুপ করে আছিস কেন সৌরভ ? এখন তো তুই চাকরি করিস , আর তো আমাদের কোনো চিন্তা নেই বল ? এই সৌরভ , তুই কথা বলছিস না কেন ? ” — আনন্দে , উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল মোহনা । কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো সৌরভ কোনো রেসপন্স না করেই ফোনটা কেটে দিল ।
পরের দিন সকালেই সৌরভের সাথে দেখা করতে ছুটলো মোহনা । কিন্তু মোহনাকে অবাক করে দিয়ে সৌরভ বললো , ” অ্যাম সরি মোহনা । অন্য কারো বাচ্চার বাবা হবার বিন্দুমাত্র রুচি আমার নেই । আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না । আমায় ক্ষমা করিস । ” — বলেই রাস্তায় মোহনাকে একা ফেলে সৌরভ চলে গেল নিজের গন্তব্যে । মোহনা হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারেনি কিছুক্ষণ । তারপর সে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এলো ।
ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘন্টা দুই ভীষণ কাঁদলো মোহনা । তারপর , কৌশিককে বললো , ” তোমাকে আমি একটা সত্যি কথা বলতে চাই । সত্যিটা তোমার জানা দরকার । যে কারণে তুমি এতো আনন্দে আছো , সে আসলে … ” — মোহনার ঠোঁটে একটা আঙ্গুল চেপে ধরে কৌশিক বললো , ” যে সন্তান তোমার গর্ভে সে শুধু আমার সন্তান , শুধু আমার মোহনা । তুমি তোমার ওপর আমার সব অধিকার কেড়ে নাও , আমি কোনও প্রতিবাদ করবো না , কিন্তু এই সন্তানকে  আমার থেকে আলাদা করতে চেয়ো না প্লিজ । তোমার কাছে কোনও দিন‌ও কিচ্ছু চাইনি , কিন্তু আজ শুধু তোমার সন্তানের ওপর বাবার অধিকার আমায় দাও মোহনা প্লিজ। আমার মা অনেক আশা নিয়ে আছে , এই বয়সে তাকে ঠকিয়ো না মোহনা ।” — বলেই চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
চরম বিস্ময়ে মোহনা কৌশিকের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো । “একজন বাবা সন্তানকে গর্ভে দিয়ে সন্দেহ করে মুখ ফিরিয়ে নেয় , আর একজন অন‍্যের সন্তানকে পিতৃস্নেহে বড়ো করতে লালায়িত হয় । হায় ঈশ্বর ! ” — ভাবতে লাগলো মোহনা ।
স্বামীর এবং শাশুড়ির ভীষণ যত্নে মোহনার কোল জুড়ে মেয়ে এলো । মোহনার শাশুড়ি দুজনের নাম মিলিয়ে ডাক নাম রাখলো ” কুমু “। সৌরভের ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে মোহনা সৌরভকে শুধু ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে ব্লক করেনি , নিজের জীবন থেকেও ব্লক করে দিয়েছে ।
কৌশিকের কোলে মেয়েকে রেখে পাশের ঘরে ঢুকে মেয়ের সাথে কৌশিকের এবং নিজের অনেক কটা ছবি  ফেসবুকে পোস্ট করলো মোহনা । রিমি চ‍্যাটার্জি বলে একটি অপরিচিত মেয়ে অনেক মন্তব্য করেছে । কিন্তু একটা ছবিতে মেয়টা কৌশিকের সাথে কুমুর ছবিতে লিখেছে ” কাকের বাসায় কোকিল ” ।
দাউদাউ করে মাথায় আগুন নিয়ে অনলাইন কল করলো মেয়েটিকে । যা ভেবেছিল ঠিক তাই । সৌরভ ।   মোহনা ফোন করতেই সৌরভ বললো , “মোহনা তোর মেয়ে তো পুরোপুরি দ্বিতীয় সৌরভ হয়েছে !  আই অ্যাম সো হ‍্যাপি । প্লিজ ফরগিভ মি মোহনা । আই ওয়ান্ট টু কাম ব‍্যাক ফর‌এভার  । আই ওয়ান্ট টু স্টার্ট আ নিউ লাইফ ।  প্লিজ গিভ মি আ চান্স । প্লিজ । প্লিজ । “
মোহনা গলা শক্ত করে বললো , “এক্সকিউজ মি , মি. সৌরভ দাশগুপ্ত । মাই ডটার লুকস লাইক হার পাপা কৌশিক রায় । দিস ইস হার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইডেন্টিটি । অ্যান্ড লিসেন , কাকের বাসায় কাকের বাচ্ছা । কোকিলের নয় । দ‍্যাট কাকু(কোকিল) ইস ডেড টু মি । “
কথা বলে ফোনটা রাখতে গিয়ে  মোহনা দেখলো কুমু পরম নিশ্চিন্তে কৌশিকের কোলে ঘুমিয়ে আছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।